জুমবাংলা ডেস্ক: উত্তর আফ্রিকার একটি প্রধান খাবার কুসকুস। যা সুজির ছোট ছোট সিদ্ধ বল দিয়ে তৈরি করা হয়। সাধারণত তরকারির উপরে এটা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সমগ্র উত্তর আফ্রিকার রন্ধশৈলীতে কুসকুস উল্লেখযোগ্য আসন দখল করে আছে। এটি মরক্কোর জনপ্রিয় খাবার।
এছাড়াও আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মৌরিতানিয়া ও লিবিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের একটা ক্ষুদ্র অংশ এবং সিসিলির তরাপানিতে কুসকুস খুবই জনপ্রিয়। কুসকুস শব্দটি খুব সম্ভবত আরবি শব্দ কাসাকাসা বা বারবার শব্দ কেসকেস থেকে এসেছে। যা দ্বারা খাবারটি রান্না করার পাত্রটিকে বোঝায়। অঞ্চলভেদে কুসকুসের একাধিক নাম এবং উচ্চারণ প্রচলিত আছে। মরক্কোয় এই খাবারকে সেকসু বা কেস্কসু বলা হয়ে থাকে।
কুসকুসের উৎপত্তি সম্পর্কে সুনিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায় না। লুসি বোলেনস এর মতে বার্বার জাতি খ্রিস্টপূর্ব ২৩৮ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৪৯ সালের মধ্যে কুসকুস খেতো। কারণ সমাধিতে প্রাপ্ত কুসকুস্ প্রস্তুতির পাত্রগুলো বারবার রাজা ম্যাসসিনিসসার সময়কে নির্দেশ করে।
চার্লস পেরির মতে, কুসকুসের উৎপত্তিকাল যিরিদ রাজবংশের শেষ এবং আলমোহাদিয়ান রাজবংশের শুরুর মধ্যকার সময়ে, খ্রিস্টীয় একাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে। আলজেরিয়ার তিয়ারেত অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রথম মৃৎপাত্রটি নবম শতকে ব্যবহৃত পাত্রের অনুরূপ এবং এর সংগে কুসকুস রান্নার প্রাথমিক পাত্রের সাদৃশ্য আছে।
কুসকুস সম্পর্কিত প্রথম লিখিত তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়, ১৩ শতকে লিখিত রান্নাবিষয়ক গ্রন্থ ‘কিতাব আল তাবিখ ফি আল মাঘরিব ওয়াল আন্দালুস’(মাগরিব এবং আন্দালুসিয়ার রান্নার বই) এ। বইটিতে কুসকুস রান্নার একটি প্রণালী বর্ণিত আছে যা পৃথিবী জুড়ে পরিচিত। বর্তমানকালে কুসকুস উত্তর আফ্রিকার জাতীয় খাবার হিসেবে পরিগণিত হয়। গ্রানাডার নাসরিদ রাজত্বকালে কুসকুস পরিচিত ছিলো এবং সিরিয়ার একজন ইতিহাসবিদ আলেপ্পো থেকে কুসকুস সম্পর্কিত চারটি তথ্যসূত্রের উল্লেখ করেছেন।
প্রথম দিককার এই তথ্যসূত্র থেকে জানা যায় কুসকুস খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিলো। ত্রিপোলিতানিয়া থেকে পশ্চিম পর্যন্ত কুসকুস সাধারণ খাবার হিসেবে পরিগণিত হতো। অন্যদিকে সাইরেনিকা থেকে পূর্ব পর্যন্ত মিশরীয় রান্নাই প্রধান রন্ধনপ্রণালী হিসেবে প্রচলিত ছিলো, উৎসব পার্বনে কুস্কুস্ তৈরি হতো। বর্তমান সময়ে মিশর এবং মধ্যপ্রাচ্যে কুসকুস পরিচিত কিন্তু আলজেরিয়া, মরক্কো এবং লিবিয়ায় কুসকুস প্রধানতম খাবার। পশ্চিম আফ্রিকাতেও কুসকুস পরিচিত এবং এটি মধ্য আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ছে। পূর্বীয় দেশসমূহে এটা জাতীয় খাবার। ১৬ শতকে সিরিয়া থেকে কুসকুস তুরস্কে পৌঁছায় এবং তুরেস্কের দক্ষিণ প্রদেশগুলোর অধিকাংশ এলাকায় কুসকুস খাওয়া হয়।
সিসিলির ত্রপানিতে কুসকুস ঐতিহ্যবাহী খাবার। ১৫৭০ সালে রোমের বার্তোলোমিও স্ক্যাপ্পি তার রান্নার বইয়ে সাক্কুসসু নামে একটি মুরীয় খাবারের বর্ণনা করেছেন। ফ্রান্সে কুসকুসের প্রথম নিদর্শন হচ্ছে ব্রিট্টানিতে প্রাপ্ত ১২ জানুয়ারি ১৬৯৯ সালে লেখা একটি চিঠি। কিন্তু প্রভেন্সে আরো আগে থেকে কুসকুস প্রচলিত ছিলো।
পর্যটক জ্যঁ জ্যাকুয়েস বুচার্ড ১৬৩০ সালে তুওলনে কুসকুস খাওয়ার কথা লিখেছেন। কুসকুস মূলত তৈরি হয়েছিলো বাজরা থেকে। বাজরা এক প্রকার ঘাসের দানা। উপাদান হিসেবে গম কখন বাজরার স্থান দখল করেছে সে বিষয়ে ঐতিহাসিকগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন। ধারণা করা হয় ২০ শতকের কোন সময়ে এই পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে। যদিও অনেক এলাকায় এখনো ঐতিহ্যবাহী ঘাসের ব্রিজ ব্যবহার করে। ধারণা করা হয় কুসকুসের আবির্ভাব উত্তর আফ্রিকাতে। এই অংশে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহের মধ্যে দশম শতকের রান্না ঘরের উপকরণ সামগ্রীর মধ্যে কুস্কুস্ তৈরীর পাত্র পাওয়া গেছে।
প্রাপ্ত দলিলাদি থেকে ধারণা করা হয় বিশেষ পাত্রে কুসকুস রান্নার প্রণালী দশম শতকের আগেই উৎপত্তি লাভ করে পশ্চিম আফ্রিকায় যেখান মধ্যযুগে সুদানীয় রাজত্ব বিস্তার লাভ করে এবং বর্তমানের নাইজার, মালি, মৌরিতানিয়া, ঘানা এবং বুর্কিনা ফাসো অবস্থিত। এমনকি আজকের গিনির ইউকৌঙ্কৌন এবং সেনেগালে চালের কুস্কুসের পাশাপাশি মাংস বা চিনাবাদামের সস দিয়ে জনার কুসকুস রান্না করা হয়।
দক্ষিণ আলজেরিয়ার মরুভুমিতে বসবাসকারী যাযাবর জাতি কেল আহাজ্ঞার মানুষেরা কুসকুস তৈরিতে বাজরা ব্যবহার করে। তারা খুব সম্ভবত পশ্চিম আফ্রিকার সুদান থেকে এটা শিখেছে যেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটা প্রচলিত ছিলো। ইবনে বতুতা ১৩৫২ সালে মালি আসেন। তার বর্ণনা থেকে জানা যায়, যখন পর্যটক গ্রামে এসে উপস্থিত হয় তখন নিগ্রোরা বাজরা, কাঁচা দুধ, মুরগী, পদ্ম বীজের গুড়ো, চাল, ফউনি(যা সরিষা দানার মত দেখতে) নিয়ে আসে এবং তারা কুসকুস তৈরি করে। ইবনে বতুতা ১৩৫০ সালে মালিতে চালের কুসকুসের কথাও উল্লেখ করেছেন। বাজরার কুসকুস কখনো গমের কুসকুসের মত এতটা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। কারণ বাজরার কুসকুস রান্না করতে অনেক সময় লাগে এবং খেতে খুব সুস্বাদু নয়।
অধ্যাপক ই. লেভি প্রোভেচাল পশ্চিম আফ্রিকার প্রাক-আরবীয় সুত্রের উপর ভিত্তি করে তার স্মারক Histoire de l’Espagne Musulmane এ প্রস্তাব করেন যে কুসকুসের উদ্ভব হয়েছে আফ্রিকায়। অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে যেমন অধ্যাপক রবার্ট হল দশম শতকের ইবনে আল-ফাকিহ এর মুখতাসার কিতাব আল বুলদান এর উপর ভিত্তি করে এই প্রস্তাবকে সমর্থণ করেছেন। কিছু কিছু অঞ্চলে কুস্কুস তৈরীতে ফারিনা অথবা অমসৃণ করে বাটা এমন বার্লি অথবা পার্ল মিলেট ব্যবহৃত হয়। ব্রাজিলে ঐতিহ্যবাহী কুস্কুস তৈরীতে ভুট্টার ময়দা ব্যবহৃত হয়।
সুজির ওপর পানি ছিটিয়ে হাতের সাহায্যে ছোট ছোট গুলি তৈরি করা হয়। গুলিগুলোকে আলাদা করে রাখতে সামান্য শুকনা আটা মাখিয়ে নেয়া হয়। এরপর এগুলোকে ছেঁকে নেয়া হয়। খুবই ছোটগুলি গুলি ছাঁকনির ছিদ্র দিয়ে আলাদা করে নেয়া হয়। এগুলোকে আবার পানি ছিটিয়ে গুলিতে রূপান্তরিত করে আটা মাখিয়ে আলাদা করে রাখা হয়। সব সুজি দিয়ে কুস্কুসের দানা বা গুলি তৈরি হওয়া না পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এটা খুবই শ্রমসাধ্য কাজ। কুসসুস ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে একদল নারী একসঙ্গে বসে দানা তৈরি করেন। এরপর রৌদ্রে শুকিয়ে কয়েক মাস ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করে। ঐতিহ্যগতভাবে শস্যের কঠিন অংশ থেকে কুসকুস তৈরি করা হয়। কঠিন এই অংশকে যাঁতায় পিষে গুড়া তৈরি করা হয়। আধুনিক সময়ে কুসকুস উৎপাদন যন্ত্র নির্ভর হয়ে পড়েছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন অংশের বাজারে কুসকুস কিনতে পাওয়া যায়।
সঠিকভাবে রান্না কুস্কুস হালকা এবং ফুঁয়োফুঁয়ো হয়, আঠাযুক্ত বা বালিবালি হয় না। ঐতিহ্যগতভাবে উত্তর আফ্রিকার লোকেরা একটি খাদ্য স্টিমার ব্যবহার করে। ধাতব নির্মিত পাত্রের নিচের অংশ অনেকটা তেল রাখার পাত্রের মত যেখানে মাংস এবং সবজির ঝোল রান্না হয়। উপরের অংশটি ধাতব নির্মিত যেখানে কুসকুস সিদ্ধ করা হয়। বাষ্পের সাহায্যে ঝোলের স্বাদ কুসকুসে চলে আসে। পাত্রের উপরের অংশে বাষ্প নির্গমনের জন্য ছিদ্র আছে। ছিদ্রটি খুব বড় হলে ভেজা কাপড় দিয়ে আটকে দেওয়া হয় যাতে বাষ্প একই রেখায় বের হতে পারে। প্রথম দিকে কুসকুস তৈরির জন্য মাটির পাত্র ব্যবহারের সামান্য প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে।
উল্লেখ্য, অধিকাংশ পশ্চিমা সুপারমার্কেটে বিক্রি হওয়া ইন্সট্যান্ট কুসকুস আগে থেকে সিদ্ধ করা এবং শুকনা থাকে। সাধারণত কুসকুসের সঙ্গে এর পরিমানের দেড় গুণ পানি মিশিয়ে পাঁচ মিনিট বদ্ধ অবস্থায় রাখা হয়। শুকনো পাস্তা এবং শুকনো শস্য যেমন চাল রান্নার চেয়ে এই আগে থেকেই সিদ্ধ করা কুসকুস সাধারণ কুসকুসের থেকে কম সময়ে রান্না করা যায়।
সূত্র: উইকিপিয়া ও অন্যান্য ওয়েবসাইট
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।