বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : ঘর সজ্জার বেলুনগুলো চুপসে গিয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ধ্বংস, অকেজো হয়ে পড়ে আছে কৃত্রিম উপগ্রহ, মেডিকেল স্ক্যানার এবং টেলিভিশনসহ আরও নানা যন্ত্র। নক্ষত্র ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। একে একে ঝলক দিয়ে উঠে নিভে যাচ্ছে রাতের আকশে মিটমিট করে জ্বলা সব আলো।
মহাবিশ্ব থেকে হিলিয়াম নামের মৌলটি মাত্র ৫ সেকেন্ডের জন্য গায়েব হয়ে গেলে অবস্থা কেমন দাঁড়াত, তারই কিছুটা বর্ণনা করছিলাম এতক্ষণ। হিলিয়ামহীন সেই মহাবিশ্ব আমাদের দেহের ওপর কী প্রভাব ফেলত? পুরো মহাবিশ্বের অবস্থাটাই-বা কেমন হতো?
হিলিয়াম খুবই হালকা গ্যাস। পর্যায় সারণিতে এর অবস্থান দ্বিতীয় ঘরে। অর্থাৎ এর পারমাণবিক সংখ্যা ২। হালকা বা মহাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়, এমন মৌলের কথা বললেও হিলিয়াম দ্বিতীয় হবে। প্রথম অবস্থানটি ধরে রেখেছে হাইড্রোজেন। গ্রহ কিংবা উপগ্রহ—দুই জায়গাতেই হিলিয়াম পাওয়া যায়। তবে এদের সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় নক্ষত্রের বুকে। আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের প্রায় ২৩ শতাংশ ভরই এই হিলিয়াম দিয়ে তৈরি।
১৮৬৪ সালে সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের করোনা (সবচেয়ে বাইরের অঞ্চল) থেকে আসা হলুদ আলো পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে হিলিয়াম আবিষ্কার করেন ফরাসী জ্যোতির্বিদ পিয়ের জ্যানসেন। দিনটা ছিল আগস্ট মাসের ১৮ তারিখ। এর প্রায় দুমাস পর আরেক ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ নরম্যান লকিয়ার সূর্যের বর্ণালি বিশ্লেষণ করে অজানা মৌলের সন্ধান পান। দুজনে আলাদাভাবে কাজ করলেও হিলিয়াম আবিষ্কারের কৃতিত্ব দুজনকেই দেওয়া হয়।
আর হিলিয়াম নামটা দিয়েছেন লকিয়ার এবং ব্রিটিশ রসানবিদ অ্যাডওয়ার্ড ফ্রাকল্যান। গ্রিক পুরাণের সূর্য দেবতা হিলিয়াসের নামে এ নামকরণ।
যাই হোক, আগের প্রসঙ্গে ফিরি। হিলিয়াম ছাড়া দেহের জৈবিক কার্যক্রমে কোনো ব্যাঘাত না ঘটলেও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এর ভূমিকা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। বারকোড স্ক্যানারের আলো তৈরি থেকে শুরু করে চিকিৎসায় ব্যবহৃত এমআরআই মেশিন বা লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারের মতো বৈজ্ঞানিক যন্ত্র—সবখানেই আছে হিলিয়ামের ব্যবহার। তা ছাড়া, এই হিলিয়াম কিন্তু নক্ষত্রকে বিস্ফোরিত হওয়া থেকে রক্ষা করে।
প্রশ্ন হলো, ৫ সেকেন্ডের জন্য সব হিলিয়াম উধাও হলে কি মহাকাশে নক্ষত্রের আতশবাজি শুরু হবে? হিলিয়াম হঠাৎ মহাবিশ্ব থেকে হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় কিছুই টের পাবেন না। আমাদের বায়ুমণ্ডলে হিলিয়াম নেই বললেই চলে। তাই হিলিয়াম ছাড়া মহাবিশ্বে শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না।
তবে এমআরআই মেশিনের ভেতরে থাকা মানুষের জন্য বিষয়টা এত সহজ হবে না। এই মেশিন চালাতে প্রচুর শক্তি খরচ হয়। ভেতরে থাকে অতিপরিবাহী চৌম্বক। অতিপরিবাহী পদার্থ সাধারণত খুবই নিম্ন তাপমাত্রায় কার্যকর থাকে। এজন্য একে সবসময় ঠান্ডা রাখতে হয়। আর ঠান্ডা রাখার জন্য এমআরআই মেশিনের মাঝে প্রবাহিত করা হয় প্রায় মাইনাস ২৬৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার তরল হিলিয়াম। হিলিয়াম নেই হয়ে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে মেশিনের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে ঘটবে মারাত্মক বিস্ফোরণ। ফলে শুধু মেশিনের ভেতরে থাকা মানুষই নন, আশপাশে থাকা অন্যান্য মানুষও দগ্ধ হবেন। একই ঘটনা ঘটতে দেখা যাবে লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারের মতো কণাত্বরক যন্ত্রের আশপাশে থাকা বিজ্ঞানীদের ভাগ্যেও।
বেলুনে হিলিয়াম ভরে সেটাকে বাতাসে ভাসানো হয়। হিলিয়াম না থাকলে তাই এসব বেলুন আর বাতাসে ভাসবে না। চুপসে গিয়ে খসে পড়বে মাটিতে।
২.
হিলিয়ামহীন মহাবিশ্বে মহাকাশে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে, তার সঙ্গে অবশ্য কোনো কিছুর তুলনা চলে না। আমাদের সূর্য বা যেকোনো নক্ষত্রের কেন্দ্রে ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে হাইড্রোজেন পরমাণু হিলিয়ামে রূপান্তরিত হয়। এই রূপান্তরের পরিমাণ কতখানি, শুনলে চমকে যাবেন। প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন টন হিলিয়াম তৈরি হয় কেবল সূর্যের বুকেই।
এই নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ার কারণে নক্ষত্রের ভেতরে প্রচণ্ড বহির্মুখী চাপ তৈরি হয়। এই চাপ নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা না থাকলে নক্ষত্র তাৎক্ষণিকভাবে বিস্ফোরিত হবে। যেমনটা হাইড্রোজেন বোমার বেলায় আমরা দেখি। ভালো বিষয় হচ্ছে, সূর্যের প্রচণ্ড মহাকর্ষ শক্তির কারণে একটা অন্তর্মুখী চাপও তৈরি হয় বহির্মুখী চাপের বিপরীতে। সৌরকেন্দ্রের চারপাশে গ্যাসের আবরণ এ ভারসাম্য বজায় রাখার কাজে সাহায্য করে। নক্ষত্র রক্ষা পায় বিস্ফোরণের হাত থেকে। হিলিয়াম না থাকলে গ্যাসীয় এ আবরণ থাকত না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নক্ষত্র বিস্ফোরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ত চারপাশে। আমাদের সূর্য বিস্ফোরিত হলে পৃথিবীর অবস্থাও যে ভালো হতো না, সে কথা বোধ হয় নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই।
সমস্ত হিলিয়াম হারিয়ে যাওয়ার অর্থ মহাবিশ্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ ভর হারিয়ে ফেলা। এই বিশাল পরিমাণ ভর হারিয়ে গেলে মহাবিশ্বে তার প্রভাব পড়ত। মহাকর্ষীয় টান হয়ে পড়ত দুর্বল। ভারসাম্য এলোমেলো হয়ে যেত। এদিকে সূর্যের বিস্ফোরণের পর পৃথিবী দৈবক্রমে বেঁচে গেলেও ভারসাম্যহীন মহাকাশে ভেসে বেড়াত ভবঘুরে গ্রহের বেশে। গ্রহ-উপগ্রহ তো বটেই, গ্রহাণুর আঘাতেও অবশিষ্ট পৃথিবীর অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার আশঙ্কা হতো খুবই বেশি।
৩.
এ পরিস্থিতি হতো মহাবিশ্ব থেকে সব হিলিয়াম স্থায়ীভাবে হারিয়ে গেলে। অথবা মহাবিশ্ব হিলিয়ামহীন হলে। তবে কোনো বিচিত্র উপায়ে শুধু ৫ সেকেন্ডের জন্য হিলিয়াম হারিয়ে গেলে মহাবিশ্বের খুব একটা ক্ষতি হতো না। সূর্য বিস্ফোরিত হওয়ার আগেই শেষ হতো এই ৫ সেকেন্ড। তখন আবার হিলিয়াম পাওয়া যেত জায়গা মতো। সূর্যও তাই বহাল তবিয়তে থাকত। মহাবিশ্বের কিছু নক্ষত্র আকার ও ভরের কারণে সূর্যের মতো সময় পেত না। বিস্ফোরিত হতো। নক্ষত্রগুলো আলোকবর্ষ দূরে হওয়ায় আমরা তা দেখতে পেতাম কয়েক বছর পর। তবে তা হতো দেখার মতো দৃশ্য। নক্ষত্র ফোটার উজ্জ্বল আলোয় হয়তো ভরে থাকত রাতের আকাশ।
তবে, যেমনটা বললাম, দীর্ঘ সময়ের জন্য বা হঠাৎ করে সব হিলিয়াম উধাও হয়ে গেলে ফলাফল মোটেও ভালো হতো না। পুরো মহাবিশ্ব জুড়ে নেমে আসত বিশৃঙ্খলা। যার প্রভাবে পৃথিবীর প্রাণবৈচিত্র্যই পড়ত মারাত্মক হুমকির মুখে। হিলিয়াম সরাসরি জীবনধারণের কাজে না লাগলেও পরোক্ষভাবে একে আমাদের সবসময় প্রয়োজন। সত্যি বলতে, এ মহাবিশ্বে কোনোকিছুই অপ্রয়োজনীয় নয়। সব কিছু যেমনটা আছে, সেভাবে আছে বলেই গড়ে উঠেছে আমাদের আজকের এই মহাবিশ্ব। পৃথিবীতে গড়ে উঠেছে অপূর্ব সব প্রাণ।
লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ ঢাকা
সূত্র: হোয়াটইফশো, ফিজ ডট অর্গ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।