মহাবিস্ফোরণ ও প্রসারণ: অলবার্স প্যারাডক্সের সমাধান

মহাবিস্ফোরণ ও প্রসারণ

রাতের আকাশ কালো—এই পর্যবেক্ষণ তুচ্ছ মনে হতে পারে। কিন্তু এটাই মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের অনেক কথা বলে। এ থেকে যৌক্তিকভাবে সিদ্ধান্তে আসা যায়, মহাবিশ্ব কোনোভাবেই স্থির হতে পারে না। এখন বৈজ্ঞানিকভাবে বিষয়টা স্বীকৃত, আমাদের মহাবিশ্ব শুরু হয়েছিল ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। সেটি সত্য হলে দুটি কারণে রাতের আকাশ উজ্জ্বল হবে না, কালো হয়ে থাকবে।

মহাবিস্ফোরণ ও প্রসারণ

প্রথমটা হলো মহাবিশ্বের প্রসারণ। মহাবিশ্ব যেহেতু প্রসারিত হচ্ছে, তাই দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে আসা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রসারিত হয়ে লোহিত বিচ্যুতি দেখা যাবে। যত দূরের গ্যালাক্সি থেকে আলো আসবে, এই লোহিত বিচ্যুতির পরিমাণ হবে তত বেশি। যেহেতু নীল আলোর চেয়ে লাল আলোর শক্তি কম, তাই দূরের গ্যালাক্সিগুলো থেকে আসা আলোগুলোর শক্তিও হবে অনেক কম। কাজেই রাতের আকাশে এই আলো আমাদের চোখে ম্লান দেখাবে। মহাবিশ্ব স্থির হলে রাতের আকাশ যতটা উজ্জ্বল হতো, প্রসারণশীল হলে সে তুলনায় কম উজ্জ্বল হবে। কারণ, বহুদূরের গ্যালাক্সি রাতের আকাশের উজ্জ্বলতার পেছনে কম অবদান রাখবে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, মহাবিস্ফোরণের প্রভাবেও রাতের আকাশ কালো থাকবে। আসলে মহাবিশ্ব চিরন্তন নয়, বরং এর একটা সূচনা ছিল। তার মানে, আমাদের দৃষ্টিসীমার সব রেখাই কোনো নক্ষত্রে গিয়ে শেষ হবে না। অথচ কেপলার, অলবার্সসহ অন্যান্য বিজ্ঞানী তেমনটি হবে বলে অনুমান করেছিলেন। এর কারণ, দূরের কোনো নক্ষত্র বা গ্যালাক্সি আমরা তখনই দেখতে পাই, যখন ওই নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছানোর জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছে। সেটা না হলে কোনো নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির আলো আমরা দেখতে পাই না।

নক্ষত্র বা গ্যালাক্সি থেকে আলো আসে অবিশ্বাস্য গতিতে। সেটা আলোর গতি। যাকে বলে মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ গতিসীমা। দৈনন্দিন জীবনের মাপকাঠিতে এই গতি অবিশ্বাস্য মনে হলেও আসলে তা অসীম নয়। আলো সেকেন্ডে পাড়ি দেয় তিন লাখ কিলোমিটার পথ। ঘণ্টার হিসাবে যা প্রায় এক বিলিয়ন কিলোমিটার। কিন্তু আলো দ্রুতগতির হলেও সে তুলনায় মহাবিশ্বের পরিধিও কম নয়। এককথায়, মহাবিশ্ব বিশাল, বিপুল। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে প্রায় সাড়ে আট মিনিট। আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র আলফা সেন্টাউরি থেকে আসতে সময় নেয় প্রায় সাড়ে চার বছরের বেশি। তেমনি বহু দূরের গ্যালাক্সির আলো আমাদের কাছে পৌঁছাতে সময় লাগতে পারে কয়েক বিলিয়ন বছর।

আলোর এই সসীম গতির কারণে এই মুহূর্তে সৌরজগৎ থেকে সূর্য নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে আমরা তা জানতে পারব প্রায় সাড়ে আট মিনিট পর। একইভাবে বহু দূরের গ্যালাক্সির যে আলো আজ আমাদের কাছে এসে পৌঁছাল, কে জানে সেই গ্যালাক্সির আজকের অবস্থা কী! অনেক আগেই সেটা মারা গেলেও এখনই তা জানতে পারব না। মোদ্দাকথা হলো, আলোর গতি সসীম। এর মানে, মহাকাশে যতই দূরের বস্তু দেখব, তত অতীতের মহাবিশ্ব দেখতে পাব আমরা।

নির্দিষ্ট সময়ে জন্ম নেওয়া কোনো মহাবিশ্বে আলোর সসীম গতির আরেকটি অনিবার্য পরিণতি রয়েছে। আকাশে অগণিত তারা থাকলেও মহাকাশে দিগন্তের একটি সীমানা থাকবে, যার বাইরে আমরা কোনো কিছু দেখতে পাব না। কারণ, মহাবিশ্বের জন্মের পর যে সময় বয়ে গেছে, সেই সময়ে এই সীমানার বাইরের নক্ষত্র বা গ্যালাক্সি থেকে কোনো আলো এখনো আমাদের কাছে এসে পৌঁছাতে পারেনি।

আমাদের অবস্থাটা মহাসমুদ্রে একটি জাহাজের সঙ্গে তুলনা করা যায়। জাহাজের চারদিকেই দিগন্তটাকে শেষ সীমা বলে চালিয়ে দেওয়া যায়, তার পরের কোনো কিছু সেখান থেকে দেখা যায় না। তার মানে এই নয় যে মহাসমুদ্রের ওই দিগন্তসীমার বাইরে কিছু নেই, বরং তত দূর পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই। এর বাইরের কিছু আমরা আর দেখতে পাই না। মহাবিশ্বের দিগন্তের বাইরেও ঠিক একই অবস্থা।

এ রকম একটি নির্দিষ্ট দিগন্তসীমা পর্যন্ত গ্যালাক্সি ও নক্ষত্র দেখতে পাওয়ার কারণে রাতের আকাশ আমরা কালো দেখি। কাজেই সিদ্ধান্তে আসা যায়, মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া কোনো মহাবিশ্বে রাতের আকাশ কালো হবে অন্তত দুটি কারণে। প্রথমত, মহাবিশ্বের সসীম বয়স এবং তার প্রসারণ।

কাজেই কেপলার, হ্যালি বা অলবার্স যাকে প্যারাডক্স মনে করেছিলেন, সেটি আদতে কোনো রহস্যই নয়। সে রহস্যের সমাধান দেয় একটি মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া মহাবিশ্ব। আরেকটি ব্যাপারেও তাঁরা ভুল করেছিলেন। তাঁদের ধারণা ছিল, রাতের আকাশ সাধারণ নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল হওয়া উচিত। কিন্তু তাঁরা হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন, নক্ষত্রও মারা যায়। কবিদের ভাষায়, আকাশ থেকে তারা খসে পড়া। কবি জীবনানন্দ দাশ বলেন, ‘নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়, হয় নাকি?’

সাধারণত ১০ বিলিয়ন বছর (১০,০০০,০০০,০০০ বা ১০১০) বা তার চেয়ে কম সময়ের মধ্যে একটি নক্ষত্র তার ভেতরের জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলে। এক হিসাবে দেখা গেছে, নক্ষত্রগুলো যদি রাতের আকাশকে সাধারণ কোনো নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল করে তুলতে চায়, সে জন্য যে পরিমাণ বিকিরণ দরকার, তার জন্য নক্ষত্রদের আয়ু হতে হবে প্রায় ১০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ বছর বা ১০২৩ বছর (১–এর পর ২৩টি শূন্য)। কিন্তু নক্ষত্রদের আয়ু সে তুলনায় অনেক অনেক কম। তার বহু আগেই জ্বালানি ফুরিয়ে মারা যায় নক্ষত্ররা। কাজেই অলবার্স প্যারাডক্স আসলে কোনো প্যারাডক্সই নয়। সেটা আসলে আমাদের জানা বা বোঝার ভুল।