সকালের প্রথম কাপ চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন রফিক সাহেব, জানালার পাশে বসে। হঠাৎ চোখ আটকে গেল রাস্তার পাশে এক বৃদ্ধার দিকে – ঠেলাগাড়ি ঠেলে যাচ্ছেন, পেছনে ছেলে গালাগাল করছে। হৃদয়টা যেন থমকে দাঁড়াল। নিজের ছেলের ছবিটা মনে পড়ল, যে এখন আমেরিকায় সফল ইঞ্জিনিয়ার। বছরে একবারও ফোন করে না। চোখের কোণে জমা জল মুছতে মুছতে ভাবলেন, “এই কি সত্যিকারের সফলতা?” মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব শব্দগুলো আজ শুধু ধর্মীয় বিধান নয়, এটি মানবিকতার মৌলিক ভিত্তি। বাংলাদেশের সমাজে যেখানে ৬০% প্রবীণ নাগরিক মানসিক অবহেলার শিকার (জাতীয় প্রবীণ নাগরিক ফাউন্ডেশন, ২০২৩), সন্তানের এই কর্তব্য পালনই হয়ে ওঠে জীবনের প্রকৃত ইবাদত। এই দায়িত্ব শুধু আর্থিক সহায়তা নয়, এটি হৃদয়ের গভীর থেকে আসা শ্রদ্ধা, সময় দেওয়ার অঙ্গীকার, আর সেই উষ্ণতা যা বৃদ্ধ বয়সের নির্জনতা দূর করে।
মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব: ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মানবিক অঙ্গীকার
কুরআনের সূরা বনি ইসরাইলের ২৩-২৪ নং আয়াত স্পষ্ট নির্দেশ দেয়: “তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করো… তাদের সামনে ‘উফ’ শব্দটিও বলো না।” ইসলামে মা-বাবার প্রতি দায়িত্বকে এতটাই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে, জিহাদের সময়ও তাদের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক (সহীহ বুখারী, ৩০০৪)। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে এখনও এই শিক্ষা জীবন্ত – যশোরের কৃষক আলমগীর হোসেন প্রতিদিন সকালে বাবার পায়ে হাত বুলিয়ে দেন, শহরে চাকরি ছেড়ে গ্রামে ফিরেছেন শুধু বৃদ্ধ মায়ের সেবায়।
কেন এই দায়িত্ব অপরিহার্য?
- ঋণের স্বীকৃতি: ইসলামিক থিওলজির অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) বলেন, “মা-বাবার সেবা ঋণ শোধ নয়, এটি ঋণ স্বীকারের প্রতীক। মা সন্তানের জন্য যে রাতজাগা, বাবা যে সংগ্রাম – তার শতভাগ ফেরত সম্ভব নয়।
- আধ্যাত্মিক পুরস্কার: হাদিসে রাসূল (সা.) বলেছেন, “মা-বাবার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি, তাদের অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি নিহিত।” (তিরমিযী, ১৮৯৯)
- সমাজিক ভারসাম্য: মনোবিজ্ঞানী ড. তানভীর হক (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ) এর মতে, “যে সমাজে মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব পালিত হয় না, সেখানে মানসিক অবসাদ ও আত্মহত্যার হার ৪০% বেশি (বাংলাদেশ হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ২০২২)।
আধুনিক যুগে দায়িত্ব পালনের বাস্তব চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
শহুরে জীবনে ব্যস্ততা, চাকরির চাপ, একাকিত্ব – এসবই আজ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীর ৭০% তরুণ মাসে একবারের বেশি বাবা-মায়ের সাথে সময় কাটাতে পারেন না (বিআইডিএস জরিপ, ২০২৩)। কিন্তু প্রযুক্তি ও সচেতনতাই পারে এই ব্যবধান কমাতে।
৩টি ব্যবহারিক কৌশল:
ডিজিটাল সংযোগ:
- প্রতিদিন ১০ মিনিট ভিডিও কল (WhatsApp, Messenger)
- তাদের জন্য স্মার্টফোন ট্রেনিং – ছবি শেয়ার, মেসেজ পাঠানো শেখানো
- অনলাইন ডাক্তার কনসাল্টেশন (প্র্যাকটো, চাইল্ড)
গুণগত সময় (Quality Time):
| কার্যক্রম | সময় ব্যয় | প্রভাব | |--------------------------|-------------|----------------------------| | সপ্তাহে একবার রান্না | ২ ঘণ্টা | শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন | | ঈদ/পূজায় বাড়ি যাওয়া | ২-৩ দিন | পারিবারিক বন্ধন দৃঢ়করণ | | তাদের শখে অংশ নেওয়া | সাপ্তাহিক | মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন |
- আর্থিক পরিকল্পনা:
- অটোমেটিক মাসিক ভাতা (bKash, Nagad)
- স্বাস্থ্য বীমা (Pragati Life, Delta Life)
- জমি/সম্পত্তির ডকুমেন্ট নিরাপদে রাখা
বাস্তব উদাহরণ: চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার সাবরিনা আক্তার। মাকে নিয়ে তৈরি করেছেন “বুড়িমা’স কিচেন” ফেসবুক পেজ। এখন তার মা নিজের হাতে রান্না করা পিঠা বিক্রি করে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী, আত্মবিশ্বাসী।
মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব: অবহেলার ক্ষত ও যত্নের সুফল
যখন দায়িত্বে ঘাটতি থাকে:
- প্রবীণদের মধ্যে বিষন্নতা ৭৫% বেড়ে যায় (WHO, ২০২২)
- ডিমেনশিয়া ও হার্ট ডিজিজের ঝুঁকি বাড়ে
- সন্তানের আত্মগ্লানি পরবর্তীতে মানসিক অস্থিরতা তৈরি করে
যত্নের সুফল:
- পরিবারিক ঐক্য: নাটোরের রহিমা বেগম (৭৫)। ৩ মেয়ে পালাক্রমে মাসে ১০ দিন করে তার সাথে থাকেন। ফল? তার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে, একাকিত্ব নেই।
- সন্তানের চরিত্র গঠন: ঢাকার স্কুলশিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিনের পর্যবেক্ষণ, “যে শিশুরা দাদা-দাদীর সাথে সময় কাটায়, তাদের সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ ৬০% বেশি বিকশিত হয়।”
- আধ্যাত্মিক প্রশান্তি: কুষ্টিয়ার মো. ইলিয়াস (৪০) বলেন, “বাবার শেষ ইচ্ছা ছিল হজে নিয়ে যেতে। তা পূরণ করতে পারায় জীবনের সবচেয়ে বড় তৃপ্তি।”
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদল: আমাদের ভূমিকা
কীভাবে অবদান রাখতে পারেন?
- পাড়ায় প্রবীণ কমিউনিটি সেন্টার: স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় গড়ে তুলুন মিলনায়তন
- স্কুল কারিকুলাম: “পরিবার শিক্ষা” বাধ্যতামূলক করা
- মিডিয়া ক্যাম্পেইন: সেলিব্রিটিদের অংশগ্রহণে সচেতনতামূলক অ্যাড
অনুকরণীয় উদাহরণ: সিলেটের “দাদু-দাদীর পাঠশালা” প্রকল্প। সপ্তাহে একদিন স্কুলে প্রবীণরা শেয়ার করেন জীবনের অভিজ্ঞতা। শিশুদের মধ্যে জন্মেছে স্বতঃস্ফূর্ত শ্রদ্ধা।
জেনে রাখুন (FAQs)
প্র: মা-বাবা যদি অন্যায় নির্দেশ দেন, তখন কর্তব্য কী?
উ: ইসলামে আল্লাহর অবাধ্যতায় কাউকে অনুমতি নেই। তবে সম্মান রেখে বুঝিয়ে বলুন। রাসূল (সা.) বলেছেন, “সত্য প্রকাশ কর, কিন্তু নম্র ভাষায়।” (মুসলিম, ৪৮৪৫)। মনোবিদদের মতে, শান্ত আলোচনায় ৮০% সমস্যার সমাধান সম্ভব।
প্র: বিদেশে থাকলে দায়িত্ব পালনের উপায় কী?
উ: নিয়মিত ভিডিও কল, তাদের চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ রাখুন। আত্মীয় বা বিশ্বস্ত প্রতিবেশিকে মাসিক ভাতা দিন সরাসরি দেখভালের জন্য। বাংলাদেশে এখন হোম কেয়ার সার্ভিস (Care.com.bd) পাওয়া যায়।
প্র: মা-বাবার যত্ন নেওয়ার সময় ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয় না তো?
উ: টাইম ম্যানেজমেন্ট是关键। সপ্তাহে ১০-১৫ ঘণ্টা আলাদা রাখুন তাদের জন্য। গবেষণায় প্রমাণ, দায়িত্বশীল কর্মীরা ৩০% বেশি মনোযোগী (Harvard Business Review)। দূরবর্তী কাজ (Remote Work) এর সুযোগ নিন।
প্র: ভাইবোনদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ না হলে কী করব?
উ: পরিবারিক কাউন্সিলিং নিন (জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট বিনামূল্যে পরামর্শ দেয়)। লিখিত চুক্তি করুন দায়িত্ব ভাগাভাগির। ইসলামে ভাইদের দায়িত্ব বেশি হলেও সন্তান সমান দায়িত্বশীল।
প্র: মা-বাবা যদি একসাথে না থাকেন, কার প্রতি দায়িত্ব অগ্রাধিকার পাবে?
উ: উভয়ের প্রতি সমান দায়িত্ব। তবে যার আর্থিক/শারীরিক অবস্থা খারাপ, তার প্রতি মনোনিবেশ করুন। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রায় (২০১৯) অনুযায়ী, সন্তান উভয় পিতামাতার ভরণপোষণ দিতে বাধ্য।
(শেষ অনুচ্ছেদ – কোন শিরোনাম ছাড়া)
মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব কখনও বোঝা নয়, এটি এক পরম সুযোগ – তাদের হাসি দেখার, কৃতজ্ঞতা জানানোর, সেই হাত দুটো ধরে বলার, “তোমাদের ত্যাগ বৃথা যায়নি।” আজকের এই ডিজিটাল যুগে, যখন বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে অর্থনৈতিক সূচকে, তখন আমাদের সত্যিকারের উন্নয়ন মাপা উচিত বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা দিয়ে নয়, বাড়ির বারান্দায় মা-বাবার হাসির আওয়াজ দিয়ে। মনে রাখবেন, তাদের চোখের সেই তাকানোই আপনার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান মিরর। আজই সময় ফোন করার, সময় দেওয়ার, ভালোবাসা বলার। কারণ কাল হয়তো খুব দেরি হয়ে যাবে। এই ডিভাইসে লেখাটি পড়ার পর আপনার প্রথম কাজ হোক তাদের ডায়াল করা – বলুন, “আম্মা/আব্বু, তোমাকে মনে পড়ছে।”
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।