সকাল ৭টা, ঢাকার আজিজ মার্কেটের একটি ফ্ল্যাটে। মা-বাবার চোখে একফোঁটা জলের আভাস দেখলেই যে মানুষটির হৃদয় ভেঙে টুকরো হয়, সেই সন্তান আজ মা-বাবার খোঁজখবর নেয় না মাসের পর মাস। এই নির্মম বাস্তবতা বাংলাদেশের শহর-গ্রামে প্রতিদিনের চিত্র। মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব নামক এই পবিত্র বন্ধনটি কেন শিকড় থেকে ছিন্ন হচ্ছে? রক্তের টানে গড়ে ওঠা সম্পর্কের এই অবহেলা কি শুধু ব্যর্থতা, নাকি সমাজের মৌলিক সংকট?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই উঠে আসে ইসলাম, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থের অমোঘ বাণী—সন্তানের কল্যাণে মা-বাবার ত্যাগের মহিমা। পবিত্র কুরআনের সূরা বনী ইসরাঈলে আল্লাহ্ ঘোষণা করেন:
“তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো।” (১৭:২৩)
অন্যদিকে, মনুসংহিতা (৩/২২৭) বলে:
“মাতা স্বর্গ, মাতা ধর্ম, মাতাই সর্বোচ্চ তপস্যা।”
কিন্তু শাস্ত্রীয় নির্দেশনার বাইরেও এই দায়িত্ব পালনের তাৎপর্য কোথায়?
মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব: শেকড়ের টান ও আত্মিক শান্তির ভিত্তি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা (২০২৩) চমকপ্রদ তথ্য দেয়: যেসব সন্তান নিয়মিত মা-বাবাকে সময় দেয়, তাদের মধ্যে ডিপ্রেশনের হার ৪৭% কম। অথচ বাংলাদেশে ৬০% প্রবীণ নাগরিক একাকিত্বে ভোগেন—একটি ট্র্যাজেডি যার মূলে সন্তানের অবহেলা।
মনোবিজ্ঞানী ড. ফারহানা মান্নানের মতে:
“মা-বাবার সেবা শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, এটা আমাদের মনস্তাত্ত্বিক অ্যান্টিবায়োটিক। যারা বাবা-মায়ের পায়ে হাত বুলায়, তাদের মস্তিষ্কে অক্সিটোসিন হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়—যা উদ্বেগ কমায়, আয়ু বাড়ায়।”
বাস্তব উদাহরণ: রাজশাহীর কৃষক মো. হারুন অর রশিদ। মেডিকেল কলেজে পড়া মেয়ে তানিয়াকে নিয়ে তার গর্বের শেষ নেই। কিন্তু মাসে একবার ফোন না করায় হারুনের চোখে জল আসে লজ্জা ঢাকতে গিয়েও।
কেন এই দায়িত্ব অপরিহার্য?
- ঋণের স্বীকৃতি: মা-বাবার ত্যাগের বিনিময়ে এই পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্ব
- আধ্যাত্মিক শান্তি: ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার সুফল
- পরিবারিক বন্ধন: ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মূল্যবোধ শিক্ষা দেওয়া
- সামাজিক দৃষ্টান্ত: সমাজে দায়িত্বশীল নাগরিক গঠন
চাঞ্চল্যকর তথ্য: বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘের রিপোর্ট বলছে, ২০২৫ সাল নাগাদ দেশের ১২% জনগোষ্ঠী হবে প্রবীণ। কিন্তু সরকারি সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা তাদের নির্ভরশীল করে তোলে সন্তানের উপর।
কীভাবে পালন করবেন মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব: বাস্তব জীবনের রোডম্যাপ
অর্থনৈতিক সুরক্ষা:
- নিয়মিত ভাতা: পেনশন বা সঞ্চয় নেই? মাসিক বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করুন তাদের চাহিদা
- স্বাস্থ্য বীমা: টাটা AIG বা পপুলার লাইফের সিনিয়র সিটিজেন প্ল্যানে যোগ করুন
- জরুরি তহবিল: আলাদা সঞ্চয় রাখুন তাদের চিকিৎসার জন্য
শারীরিক যত্ন:
- নিয়মিত চেকআপ: কিডনি, ডায়াবেটিস, প্রেসার মনিটরিং
- সহজ লাইফস্টাইল: ঢাকার মতো শহরে বাস করলে বাথরুমে গ্র্যাব বার, নন-স্লিপ ম্যাট লাগান
- পুষ্টিকর খাবার: ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ ডায়েট প্ল্যান
মানসিক সঙ্গ:
- টেকনোলজি ব্রিজ: শেখান ভিডিও কল, মেসেজিং অ্যাপ
- সপ্তাহের রুটিন: রবিবার ব্রেকফাস্ট, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার চা
- স্মৃতিচারণ: পুরনো অ্যালবাম নিয়ে আড্ডা, গল্প শোনা
আধ্যাত্মিক সেবা:
- ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া
- হজ/তীর্থযাত্রার ব্যবস্থা করা
- নামাজ/প্রার্থনায় সাহায্য করা
বাস্তব কেস স্টাডি: চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী রিয়াদ আহমেদ। বাবাকে নিয়ে প্রতিমাসে কর্ণফুলী এক্সপ্রেসওয়ে ড্রাইভ, মায়ের জন্য রোজ সকালে ফুল আনা—ছোট ছোট রিচুয়ালে বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটান তিনি।
গুরুত্বপূর্ণ: দায়িত্ব পালনে “সময় নেই” অজুহাত অগ্রহণযোগ্য। গবেষণা বলে, সপ্তাহে মাত্র ৫-৭ ঘণ্টা উৎসর্গ করলেই মা-বাবার মানসিক স্বাস্থ্যে বিপুল উন্নতি হয়।
সামাজিক ও আইনি দৃষ্টিকোণ: বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে প্রবীণ নাগরিক নীতিমালা ২০১৩ স্পষ্ট নির্দেশ দেয়:
“সন্তানদের আইনগত দায়িত্ব রয়েছে মা-বাবাকে ভরণপোষণ দেওয়ার। অবহেলা করলে ৩ বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা হতে পারে।”
সমস্যার জটিলতা:
- গ্রামে জমি নিয়ে বিবাদ
- শহুরে জীবনের ব্যস্ততা
- ভাইবোনের মধ্যে দায়িত্ব পালনের অসাম্য
সমাধানের পথ:
- পরিবার পরিষদ: নিয়মিত সভা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া
- মধ্যস্থতা: স্থানীয় চেয়ারম্যান বা ইমামের সাহায্য নেওয়া
- সরকারি সহায়তা: বয়স্ক ভাতা এর জন্য আবেদন
সফল উদ্যোগ: নারায়ণগঞ্জের যৌথ পরিবার ব্যবস্থা। ৩ ভাই মিলে বাবা-মায়ের জন্য আলাদা ফ্ল্যাট কিনেছেন, নার্স রেখেছেন—প্রতিদিন কেউ না কেউ সময় দেন।
যারা মা-বাবাকে হারিয়েছেন: তাদের জন্য বিশেষ নির্দেশনা
মৃত মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব থেমে যায় না মৃত্যুতেও:
- দান: তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানে সাহায্য করা
- দোয়া: নিয়মিত ইসালে সওয়াবের নামাজ/প্রার্থনা
- অনুশাসন পালন: তারা যে নৈতিকতা শিখিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন
- স্মৃতি সংরক্ষণ: ফটো অ্যালবাম, ব্যক্তিগত ডায়েরি প্রকাশ
মনোবিদ ড. তানভীর হাসানের পরামর্শ:
“অনুভূতি লুকিয়ে রাখবেন না। মা-বাবার ছবির সামনে বসে কথা বলুন, চিঠি লিখুন—এটা গভীর মানসিক শান্তি দেয়।”
জেনে রাখুন
১. মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব কি শুধু আর্থিক?
না। মানসিক সঙ্গ, শ্রদ্ধা, শারীরিক সেবা সমান গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা মেডিকেল কলেজের গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৮% প্রবীণ আর্থিক সাহায্যের চেয়ে সন্তানের সময়কেই বেশি প্রাধান্য দেন।
২. মা-বাবার সাথে মনোমালিন্য হলে করণীয় কী?
প্রথমে ক্ষমা চাইতে হবে, এমনকি আপনি ভুল না করলেও। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ বা কাউন্সিলরের সাহায্য নিন। মনস্তাত্ত্বিক বলতে গেলে, পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা ব্যক্তিগত বিকাশের চাবিকাঠি।
৩. কর্মব্যস্ত জীবনে কীভাবে সময় বের করব?
ছোট ছোট অভ্যাস গড়ুন: অফিস যাওয়ার পথে ফোন, লাঞ্চ ব্রেকে ভিডিও কল, সপ্তাহান্তে একবেলা খাওয়া। গবেষণা বলে, দিনে ১৫ মিনিটের অর্থপূর্ণ যোগাযোগই সম্পর্কে আমূল পরিবর্তন আনে।
৪. ভাইবোনেরা দায়িত্ব এড়ালে কী করব?
খোলামেলা আলোচনা করুন, দায়িত্ব ভাগ করে নিন। আইনি পথে যাওয়া শেষ বিকল্প—বাংলাদেশে পিতামাতার ভরণপোষণের দায় আইনত সব সন্তানের সমান।
৫. মা-বাবা অসুস্থ হলে কীভাবে মানসিক চাপ সামলাব?
প্রফেশনাল কেয়ারগিভার নিয়োগ করুন, নিজের জন্য সময় রাখুন, সাপোর্ট গ্রুপে যোগ দিন। সিলেটের ‘প্রবীণ সেবা সংঘ’-এর মতো সংস্থা মানসিক সহায়তা দেয়।
৬. ধর্মে মা-বাবার সেবার কী গুরুত্ব?
ইসলামে মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। হিন্দুধর্মে পিতৃদেবতা বিষ্ণুর সমতুল্য। বৌদ্ধ ধর্মে পিতামাতাই “প্রথম শিক্ষক”। সব ধর্মেই এটাকে সর্বোচ্চ পুণ্যের কাজ বলা হয়েছে।
মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব কখনোই একতরফা লেনদেন নয়—এটা হৃদয়ের সেই অদৃশ্য সুতো, যা আমাদের শেকড়ের সাথে বেঁধে রাখে। আজ যখন আপনার মা একটু বেশি কথা বলেন, বা বাবা অস্বস্তিকৃতভাবে টাকার কথা তোলেন, বুঝবেন—তারা সময়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা একাকী সৈনিক। তাদের হাত ধরে ফেলুন, চোখে চোখ রাখুন, বলুন: “আপনারা আমার জীবনদাতা, আজ আমি আপনাদের পাশে আছি।” এই মুহূর্তেই ফোন করুন, বসে থাকুন তাদের পাশে, প্রশ্ন করুন শৈশবের সেই গল্পগুলো—কারণ কাল হয়তো খুব দেরি হয়ে যাবে। মা-বাবার মুখের হাসিই আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা। তাদের পাওয়ার এই সুযোগকে হেলায় হারাবেন না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।