মূল নক্ষত্রের মতো করে প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্ক আলো বিকিরণ করে না। তাই সরাসরি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এদের খুঁজে পাওয়া একরকম অসম্ভব। নিজেরা আলো বিকিরণ না করলেও প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কে থাকা গ্যাস ও ধূলিকণা সহজে মূল নক্ষত্র (প্রোটোস্টার) থেকে আসা আলো শোষণ করে উত্তপ্ত হয়।
পরে অবলোহিত বিকিরণ (Infrared Radiation) হিসেবে এই উত্তাপ নিঃসরণ করে এগুলো। কোনোভাবে যদি এই নিম্ন শক্তির বিকিরণগুলো শনাক্ত করা যায়, তাহলে নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হবে মূল নক্ষত্র ঘিরে প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কের অস্তিত্ব।
মানুষের চোখ অবলোহিত বিকিরণের প্রতি মোটেই সংবেদনশীল নয়। তাই এদের শনাক্ত করতে হলে ব্যবহার করতে হয় বিশেষ ধরনের ক্যামেরা। প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কের খোঁজে এদের কাজে লাগাতে প্রথমে কিছুটা আয়োজনের দরকার পড়ে। যেকোনো পরিবেশে কাজ করতে পারে না ক্যামেরাগুলো।
মূলত দুটি সমস্যার কারণে এমনটা হয়। প্রথম সমস্যাটি প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কের অতি নিম্ন তাপমাত্রা সংক্রান্ত। কেন্দ্রীয় নক্ষত্র থেকে শক্তি শোষণ করলেও প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কের তাপমাত্রার মান হয় খুব কম। তাই সেখান থেকে আসা অবলোহিত বিকিরণ শনাক্ত করতে হলে ব্যবহৃত ক্যামেরার তাপমাত্রা রাখতে হবে প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কের তাপমাত্রারও নিচে। কাজটি বেশ কঠিন। স্বাভাবিক পরিবেশে ক্যামেরার তাপমাত্রা সহজেই প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কের তাপমাত্রাকে ছাড়িয়ে যায়।
দ্বিতীয় সমস্যার নাম বায়ুমণ্ডল। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল খুব সহজেই মহাকাশ থেকে আসা অবলোহিত বিকিরণ শুষে নিতে পারে। তাই প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কের সন্ধানে ব্যবহৃত বিশেষ ক্যামেরাগুলো ভূপৃষ্ঠে স্থাপন করলে কোনো ফায়দা হবে না। এদের নিয়ে যেতে হবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সীমানার বাইরে।
অর্থাৎ, মহাশূন্যে। পৃথিবীর বাইরে এগুলো স্থাপন করলে আরেকটি বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। সেখানকার হিমশীতল পরিবেশে অপেক্ষাকৃত কম কষ্টে ক্যামেরাগুলোতে প্রয়োজনীয় অতি নিম্ন তাপমাত্রা বজায় রাখা সম্ভব হয়। সাধারণত তরল হিলিয়াম ব্যবহারের মাধ্যমে এদের তাপমাত্রা নামিয়ে আনা হয় প্রায় মাইনাস ২৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কের সন্ধানে বিশেষ ধরনের ক্যামেরা ও টেলিস্কোপ সমেত দুটি স্পেস মিশন পরিচালনা করা হয়েছিল মহাশূন্যে। প্রথমটির নাম ইনফ্রারেড স্পেস অবজারভেটরি। ১৯৯৫ সালে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইসা) এ নভোমানমন্দির পাঠায় মহাকাশে। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত পূর্ণ মাত্রায় সচল ছিল এটি। ক্যামেরা ঠান্ডা করার কাজে ব্যবহৃত তরল হিলিয়াম ফুরিয়ে গেলে সমাপ্তি ঘটে এই মিশনের।
আরেকটি মিশনের নাম স্পিটজার স্পেস টেলিস্কোপ। নাসার ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত চারটি স্পেস মিশনের একটি এটি। এরই উত্তরসূরি হাবল স্পেস টেলিস্কোপ এবং হালের সর্বশেষ সংযোজন জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। যাহোক, স্পিটজার স্পেস টেলিস্কোপ মহাশূন্যে পাঠানো হয় ২০০৩ সালে। টানা ছয় বছর পুরোদমে কাজ করার পর ২০০৯ সালে এরও তরল হিলিয়াম ফুরিয়ে যায়। অবশ্য এরপরেও টেলিস্কোপটি টানা ১১ বছর সীমিত পরিসরে কাজ করে যায়। ২০২০ সালে চূড়ান্তভাবে সমাপ্তি ঘটে এ মিশনের।
ইনফ্রারেড স্পেস অবজারভেটরি এবং স্পিটজার স্পেস টেলিস্কোপের চুলচেরা বিশ্লেষণে বিজ্ঞানীরা এক মিলিয়ন বছরের কম বয়সী সব নক্ষত্র ঘিরে প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কের অস্তিত্ব থাকার নিশ্চিত প্রমাণ পান। অর্থাৎ, প্রতিটি নতুন নক্ষত্রেরই থাকে নিজস্ব প্ল্যানেটারি সিস্টেম তৈরির সক্ষমতা!
স্পেস মিশনগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে আরেকটি অবাক করা বিষয় জানতে পারেন বিজ্ঞানীরা। একদম কম বয়সী শতভাগ নক্ষত্র ঘিরে প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কের অস্তিত্ব থাকলেও, দশ মিলিয়ন বা তার চেয়ে বেশি বয়সের খুব সামান্য সংখ্যক নক্ষত্রদের ঘিরে এদের দেখা যায়। শতকরা হিসেবে এই সংখ্যা এক ভাগের বেশি হবে না। অর্থাৎ, কালের বিবর্তনে একসময় হারিয়ে যায় বা ধ্বংস হয়ে যায় প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্ক। সুতরাং, নিজস্ব প্ল্যানেটারি সিস্টেম তৈরি করতে হলে হাতে অফুরন্ত সময় থাকে না নক্ষত্রদের।
মাত্র দশ মিলিয়ন বছরের মধ্যে কীভাবে প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্ক নেই হয়ে যেতে পারে, সে বিষয়ে এবার খানিকটা ধারণা দেওয়া যাক। নানান ধ্বংসাত্মক উপায়ে বিলীন হয়ে যেতে পারে এগুলো। আবার সৃজনশীল উপায়ে শেষ পরিণতি বরণ করার সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
সে ক্ষেত্রে প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কের পুরোটাই পরিণত হতে হবে হরেক রকমের গ্রহে। অবশ্য এমনটা ঘটার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায়। আমাদের সৌরজগত এবং দূরবর্তী এক্সোপ্ল্যানেট সিস্টেমগুলো সূক্ষ্মভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন, সাধারণত প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কের প্রাথমিক ভরের মাত্র এক শতাংশ থেকে গঠিত হয় গ্রহ। বাকি নিরানব্বই শতাংশ ভরই হারিয়ে যায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।