লাইফস্টাইল ডেস্ক : স্বপ্ন সবাই দেখে কিন্তু কেন সব স্বপ্ন মনে থাকে না মানুষের? আর স্বপ্ন মনে রাখা কেন প্রয়োজন? এসব নিয়ে লিখেছেন সালাহ উদ্দিন শুভ্র
বাংলায় ‘স্বপ্ন’ বলতে কয়েক ধরনের অর্থ হতে পারে। যেমন সংকল্প অর্থে স্বপ্ন শব্দটির ব্যবহার পাওয়া যায়। এ অর্থে কারও স্বপ্ন থাকে হিমালয়ে ওঠার, কারও স্বপ্ন থাকে দেশের জন্য কিছু করার। সব মানুষেরই এমন কোনো না কোনো স্বপ্ন থাকে। কেউ তার সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন, কেউ পারেন না। সফল হোক বা ব্যর্থ, কেউ তার এ ধরনের স্বপ্নকে ভুলে যান না। এ স্বপ্ন জেগে জেগেই দেখা হয়।
আবার ইংরেজি ‘ড্রিম’ শব্দের বাংলা অর্থ হিসেবে আরেক ধরনের ‘স্বপ্ন’ আছে। এ স্বপ্ন মানুষ দেখে ঘুমের ভেতর। মানবজীবনের অন্যতম এক বিস্ময়কর অনুভূতির নাম স্বপ্ন। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, ঘুমের ভেতরের সব স্বপ্ন তার মনে থাকে না। পশ্চিমের দেশগুলোতে বিষয়টি বেশ গুরুত্ব দিয়েই ভাবা হয়। কারণ তারা বলছে, স্বপ্ন ব্যক্তিজীবনের গোপন কোনো ইচ্ছা বা ঘটনাকে ইঙ্গিত করে। ঘুমের ভেতর দেখা স্বপ্ন অনেকের মানসিক বিষাদের কারণও হতে পারে।
বাঙালির প্রিয় কবি জীবনান্দ দাশ ‘স্বপ্ন’ কবিতায় বলেছিলেন, মানুষ যখন থাকবে না তবে শুধু মানুষের স্বপ্ন থাকবে, তখন সেই স্বপ্নের ভেতরে তিনি থেকে যাবেন। কবির এ কথার অর্থ উদ্ধার করা কঠিন। কারণ মানুষ না থাকলে তার স্বপ্ন কোথায় থাকবে তা বুঝে ওঠা অসম্ভব। অন্তত বিজ্ঞানের হিসাবে। কারণ তারা বলছে যার যার স্বপ্ন কেবল সে-ই দেখে। ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব নিজের স্বপ্নের মর্মার্থ উপলব্ধি করা।
স্বপ্ন সবাই দেখে
স্বপ্ন সবাই দেখে, কিন্তু কয়জনের তা মনে থাকে! বিজ্ঞান বলছে, যারা স্বপ্নকে কাজে লাগাতে পারেন তারা সৃষ্টিশীলতায় সফল হন। মানুষ তার আদিম অবস্থা থেকে ঘুমের ভেতর দেখা স্বপ্নকে কাজে লাগিয়ে আসছে। যেমন কালজয়ী ডাচ চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গগ বলেছিলেন, ‘আমি স্বপ্ন দেখি যে আমি ছবি আঁকছি আর তারপর আমি আমার স্বপ্নকে আঁকি’। স্বপ্ন যে আঁকা সম্ভব তা অবশ্য বিজ্ঞান মনে করে। সে জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্বপ্নকে মনে রাখা। তবে দুঃখের বিষয় হলো মানুষ তার বেশিরভাগ স্বপ্নকে মনে রাখতে পারে না।
স্বপ্ন নিয়ে মানুষ বিস্তর ভেবেছে। সভ্যতার শুরুতে স্বপ্নকে ভাবা হতো পার্থিব জগতের সঙ্গে দেবতাদের যোগাযোগের একটি মাধ্যম হিসেবে। গ্রিক এবং রোমানরা মনে করত স্বপ্ন হচ্ছে ভবিষ্যদ্বাণী। স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিয়ে বাংলায়ও বেশ পরিচিত কার্যক্রম আছে। যাকে আমরা ‘খোয়াবনামা’ হিসেবে জানি। খোয়াবনামা হলো এমন একটি বইয়ের নাম যাতে স্বপ্নের ব্যাখ্যা থাকে। বাংলায় এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা জনপ্রিয় একটি ধারণা। স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেওয়ার এক ধরনের পেশাও চালু আছে কিছু কিছু এলাকায়। স্বপ্ন দেখার পর এর কী অর্থ তা জানতে উৎসুক থাকে অনেকে। আধুনিক যুগে বিভিন্ন ধারণা তৈরি হওয়ার ফলে অনেকে নিজে নিজেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা করে থাকেন। আবার কেউ কেউ আছেন স্বপ্ন দেখার পর তা নিয়ে একদমই ভাবেন না। তারা হয়তো জানেনই না নিজের দেখা স্বপ্নের ভেতর কোনো ইশারা লুকিয়ে আছে।
স্বপ্নের আধুনিক ব্যাখ্যা
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে সিগমুন্ড ফ্রয়েড এবং কার্ল জুং স্বপ্ন নিয়ে আধুনিক তত্ত্ব তুলে ধরেন। যা বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা ও পরিচিতি পায়। ফ্রয়েডের তত্ত্ব পৃথিবীর তত্ত্ব ও দর্শন চর্চাকে পাল্টে দেয়। তার তত্ত্ব ছিল অবদমিত আকাক্সক্ষা স্বপ্ন হিসেবে দেখা দেয়। ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুসারে, স্বপ্ন হলো ব্যক্তির অবচেতন মনের একটা জানালা। স্বপ্নে যা দেখা যায়, তার অধিকাংশের পেছনেই কোনো না কোনো কারণ, ঘটনা, আশা বা ভয় লুকিয়ে থাকে। সেই কারণে স্বপ্নের অর্থ উদ্ধার করলে অনেক সময়ই নিজের মনের ভেতরে চলা কথাগুলোর মুখোমুখি দাঁড়ানো যায়।
তার দর্শন কাজে লাগিয়ে স্বপ্নের ব্যাখ্যা তৈরি করা হয়। যেমন, স্বপ্নে যদি কেউ নিজেকে বিবস্ত্র অথবা নগ্ন অবস্থায় দেখে, তার অন্যতম কারণ হতে পারে সেই ব্যক্তি কোনো না কোনো বিষয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। অথবা কোনো বিষয় নিয়ে ভেতরে ভেতরে তিনি লজ্জিত, যা অন্য কারও সামনে প্রকাশ করতে চান না। তবে প্রকাশ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আছেন। যার ফলে তার সম্মানহানি ঘটতে পারে।
বিজ্ঞান কী বলে
অবশ্য স্নায়ুবিজ্ঞান বলছে, স্বপ্ন নিছক মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ যা মানুষের এলোমেলো
চিন্তাভাবনার চিত্র যা স্মৃতি থেকে আসে। আর মানুষ যখন জেগে ওঠে তখন সে সেসব চিত্র সাজিয়ে একটা গল্প তৈরি করে। তবে বিড়ালের মতো অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীও স্বপ্ন দেখে বলে জানাচ্ছে বিজ্ঞান। বিবর্তনবাদী মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, আদিতে স্বপ্ন মানুষকে তার শত্রু থেকে প্রতিরক্ষার অনুপ্রেরণা জোগাত। অর্থাৎ, আদিম শিকারি জীবনে মানুষ যে স্বপ্ন দেখত তা তাকে নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন করে তুলত। বিষয়টার ব্যাখ্যা করলে বলতে হয়, আদিকালে ঘুমন্ত মানুষ যদি কোনো স্বপ্ন দেখে যে সে পশুর দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে, তখন সেই আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া বিষয়ে সে সজাগ হয়। এরপর যখন জেগে ওঠে তখন ওই স্বপ্ন তাকে আক্রমণাত্মক পশু থেকে সুরক্ষা বিষয়ে সতর্ক করে।
স্বপ্ন কেন মনে থাকে না
তবে সমস্যা হলো, সব স্বপ্ন আমাদের মনে থাকে না। ঘুমের বিভিন্ন পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্ন দেখে মানুষ। যার সব জেগে ওঠার পর তার আর মনে থাকে না। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ঘুমের ভেতর মস্তিষ্ক পরিষ্কার হয়। মানুষ ঘুমানোর পর তার স্বল্পকালীন স্মৃতিগুলো দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি প্রকোষ্ঠে জমা হয়। এটা কীভাবে হয় সে বিষয়ে বিজ্ঞান সম্পূূর্ণ জ্ঞাত নয়। তাদের অনুমান এই স্মৃতি পরিবহনের বিভিন্ন সময়ে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্ন দেখে।
সাধারণত যা হয় স্পষ্ট কোনো স্বপ্ন দেখার পর আমরা দ্রুত জেগে উঠি। তবে যত সময় গড়াতে থাকে ওই স্বপ্ন তত ফিকে হতে থাকে। একটা সময়ে যার প্রায় কিছুই আমাদের মনে থাকে না। মজার বিষয় হলো, কেউ যদি ভেবে রাখে যে এর পর থেকে এমন স্বপ্ন দেখলে তিনি মনে রাখার চেষ্টা করবেন, তাহলে হয়তো কিছু স্বপ্ন অনেকাংশে পুনরুদ্ধার সম্ভব।
সম্প্রতি সায়েন্টিফিক আমেরিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘুমের ভেতর যখন কারও চোখের পাতা দ্রুত নড়তে থাকে তখন বুঝে নিতে হবে যে তিনি স্বপ্ন দেখছেন। চোখের পাতা দ্রুত নড়ার এ পর্যায়কে ‘আরইএম’ (র্যাপিড আই মুভমেন্ট) বলে। ঘুমের এ পর্যায়ে মস্তিষ্ক জাগ্রত অবস্থার মতো থাকে। মস্তিষ্কের যে অংশে সংক্ষিপ্ত সময়ের স্মৃতি বা ‘শর্ট-টাইম মেমরি’ সংরক্ষিত থাকে তা সক্রিয় হয়। এ অবস্থা কয়েকবার ঘটে এবং এ সময়ে দেখা স্বপ্ন বেশিরভাগ মানুষ ভুলে যায়।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষক ডিয়েড্রি ব্যারেট বলেছেন, ঘুমের ভেতর প্রতি ৯০ মিনিট পর একবার আরইএম ফিরে আসে। রাতের প্রথম আরইএম চক্রটি সাধারণত কয়েক মিনিটের হয়। তবে যদি রাতে আট ঘণ্টা ঘুমান, তাহলে একজন ব্যক্তি ২০ মিনিটের জন্য ঘুমের আরইএম পর্যায়ে থাকেন। আবার কত ঘণ্টা ঘুমিয়েছেন, তার ওপর নির্ভর করে স্বপ্ন কতটা স্মরণে থাকবে। আট ঘণ্টা ঘুমালে যে পরিমাণ স্বপ্ন দেখা যাবে, ছয় ঘণ্টা ঘুমালে স্বপ্ন দেখার সুযোগ অর্ধেকেরও বেশি কমে যায়। আর ঘুমের শেষ ঘণ্টাগুলো স্বপ্ন দেখার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ঘুম থেকে ওঠার ঠিক আগের স্বপ্ন মনে থাকে।
ব্যারেট আরও বলেছেন, একাধিক গবেষণায় পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নারী পুরুষের তুলনায় কিছু বেশি স্বপ্ন মনে রাখে এবং তরুণরা বয়স্ক মানুষের চেয়ে বেশি স্বপ্ন মনে রাখে। শিশুদের স্বপ্ন মনে রাখা সেই বয়স থেকে বেড়ে যায় যে বয়সে তারা স্বপ্নগুলো বুঝতে শুরু করে।
অপরদিকে, কিছু ব্যক্তি কখনো স্বপ্ন মনে রাখতে পারে না। আবার কেউ কেউ প্রতি রাতে কয়েকটি স্বপ্ন স্মরণ করতে পারে। যারা বেশি অন্তর্মুখী এবং আত্মকেন্দ্রিক তারা বেশি স্বপ্ন মনে রাখতে পারে। আর যারা বহির্মুখী এবং কর্মমুখী তারা কম মনে রাখে। কল্পনাপ্রবণতা এবং সম্মোহনের প্রতি সংবেদনশীলতাও স্বপ্ন মনে রাখার সঙ্গে যুক্ত। কিছু গবেষণায় সুস্পষ্টভাবে দেখা গেছে যে, যারা বেশি স্বপ্ন মনে রাখে তাদের মস্তিষ্কের কিছু মনঃসংযোগকারী অংশ বেশি সক্রিয় থাকে। অর্থাৎ তারা মনোযোগী হতে পারে নিজের কাজের প্রতি।
স্বপ্ন থেকে সৃষ্টি
জানা যায়, চিত্রশিল্পী সালভাদর দালি ইচ্ছা করেই একটি ধাতুর প্লেট নিচে রেখে তার ওপর নিজের হাতে চাবির একটি সেট ধরে রাখতেন। এ অবস্থায় একটি ছবি আঁকার ধারণা নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়তেন। এভাবে ঘুমিয়ে পড়ার একটি পর্যায়ে তার হাতের পেশিগুলো শিথিল হয়ে আসত এবং চাবিগুলো পড়ে যেত। ধাতব প্লেটে চাবি পড়লে ঝন ঝন শব্দ হতো। এ শব্দে ঘুম ভেঙে যেত দালির। আর এ সময়ের ঘুমে তিনি যে স্বপ্ন দেখতেন তার চিত্র মনে রেখে এঁকে ফেলতেন। বিজ্ঞানী থমাস আলভা এডিসনও নিজের উদ্ভাবনগুলো নিয়ে ভাবার সময় চাবির পরিবর্তে ধাতব বল ব্যবহার করতেন।
স্বপ্ন যেভাবে মনে রাখবেন
ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ক্লিনিক্যাল কাউন্সেলর লেসলি এলিস তার কাছে আসা সাহায্যপ্রার্থীদের পরামর্শ দেন যে, তারা যদি স্বপ্ন মনে রাখতে চায় তাহলে জেগে ওঠার পর একটু সময় নিতে হবে। এমনি শোয়া থেকে ওঠার আগে তারা কী স্বপ্ন দেখছিলেন তা নিয়ে ভাবতে হবে। যতটা সম্ভব মনে করার চেষ্টা করতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে স্বপ্ন স্বল্পমেয়াদি স্মৃতি থেকে দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিতে নিয়ে আসা যাবে।
এলিস জানান, পশ্চিমা সংস্কৃতিতে স্বপ্নগুলোকে পাগলামি বলে মনে করা হয়। স্বপ্নের ব্যাখ্যাগুলো খুব অর্থবহ নাও হতে পারে, তবে তা প্রায়শই আবেগকে ইঙ্গিত করে। যার অস্তিত্ব ব্যক্তির বাস্তব জীবনে রয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা এমন জিনিস স্বপ্ন দেখি যা আমরা দেখতে চাই না। যার অর্থ এসব স্বপ্ন আমাদের জীবনেরই আরেক দিক। তিনি বলেছেন, আপনার স্বপ্নগুলো মনে রাখার চেষ্টা করুন। সে জন্য স্বপ্ন দেখা কিছু কিছু উপাদান বা তথ্যকে প্রাথমিকভাবে মনে করুন। এভাবে ধীরে ধীরে পুরো স্বপ্ন স্মৃতিতে ধারণ করার সক্ষমতা আপনার তৈরি হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।