বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : বহুল প্রচলিত একটি ধারণা, ‘মানুষ গড়ে মস্তিষ্কের মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহার করে। আর বাকি ৯০ শতাংশ আমৃত্যু অব্যবহৃতই থেকে যায়।’ এই ধারণা জায়গা পেয়েছে হলিউডের সিনেমাতেও। ২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘লুসি’ সিনেমাতেও বিখ্যাত অভিনেতা মরগ্যান ফ্রিম্যানকে বলতে দেখা যায়, ‘মানুষ গড়ে মস্তিষ্কের মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহার করে থাকে। যদি তারা শতভাগ মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে পারত, তাহলে বিশ্বে আকর্ষণীয় জিনিস ঘটতে শুরু করত।’ অথবা আপনি শুনেছেন, আইনস্টাইন তাঁর মস্তিষ্কের মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহার করতে পেরেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ওয়েবসাইটে ধারণাটির সূত্রপাত সম্পর্কে কিছু সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠানটির মতে, এ ধারণার সূত্রপাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের নামে ভুল উদ্ধৃতি থেকে অথবা ১৭ শতকে ফরাসি মনোবিজ্ঞানী পিয়েরে ফ্লোরেন্সের কাজের ভুল ব্যাখ্যা দেওয়ার মাধ্যমে। আমেরিকান দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম জেমসের ১৯০৮ সালে প্রকাশিত একটি বই থেকেও এ ধারণার সূত্রপাত হতে পারে। তিনি তাঁর ‘দ্য এনার্জিস অব ম্যান’ বইয়ে লিখেছিলেন, ‘আমরা আমাদের সম্ভাব্য মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতার অল্প কিছু অংশমাত্র ব্যবহার করি।’
অথবা আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী কার্ল ল্যাশলির কাজ থেকেও এ ধারণার সূত্ৰপাত হতে পারে। ল্যাশলি ইঁদুরের মস্তিষ্কের একটি বড় অংশ সরিয়ে নেন। তারপরও তিনি দেখেন, ইঁদুরগুলো বিশেষ কিছু কাজ আয়ত্ত করতে পারছে। কিন্তু আমরা এখন জানি, মানবমস্তিষ্কের সামান্য অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেটি আচরণে কেমন মারাত্মক প্রভাব ফেলে। তবে যেভাবেই এই ধারণার উৎপত্তি হোক না কেন, পরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমও কোনো ধরনের বৈজ্ঞানিক তথ্যসূত্র ছাড়াই এই ধারণা প্রচার করে এসেছে।
স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট হেলথ লাইনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ধারণাটির সূচনা কীভাবে, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে মানুষ মস্তিষ্কের কোনো কোনো অংশ অপর অংশ থেকে বেশি কাজ করতে পারে। তবে এর মানে এই নয় যে মস্তিষ্কের বাকি ৯০% অব্যবহৃত থেকে যায়। মস্তিষ্কের প্রতিটি অংশ ভিন্ন ভিন্ন কাজের জন্য নিয়োজিত। একজন মানুষ সারা দিনে তার মস্তিষ্কের সব কটি অংশই ব্যবহার করতে পারে।
বিজ্ঞানবিষয়ক ওয়েবসাইট লাইভ সায়েন্সে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মস্তিষ্কের ব্যবহারসংক্রান্ত ধারণাটি বেশ কয়েকজন স্নায়ু বিশেষজ্ঞের মত উল্লেখ করে ‘সঠিক নয়’ বলে চিহ্নিত করা হয়।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির বিবর্তনীয় নিউরোসায়েন্সের সহকারী অধ্যাপক এরিন হেচ্ট এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের সমস্ত মস্তিষ্ক সব সময়ই ব্যবহৃত হয়।’ হেচ্ট মস্তিষ্কের কার্যকলাপকে হৃদযন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন। যখন শরীর বিশ্রামে থাকে, তখন হৃদযন্ত্র যেভাবে রক্ত সরবরাহের জন্য সংকোচন-প্রসারণ অব্যাহত রাখে, তেমনি মানবমস্তিষ্কের কোষ যাকে বলে নিউরন—সর্বদা সক্রিয় থাকে।
টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রেইন হেলথ প্রকল্পের অপারেশন প্রধান ও স্নায়ুবিজ্ঞানী জুলি ফ্র্যাটান্টোনিও ধারণাটিকে মিথ বা কল্পকথা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ইউনিভার্সিটি অব আরকানসাস ফর মেডিকেল সায়েন্সে প্ৰকাশিত এক প্রতিবেদনে এই ধারণার উৎপত্তি সম্পর্কে উইলিয়াম জেমসের ‘দ্য এনার্জিস অব ম্যান’ বইয়ে লেখা লাইনটি উল্লেখ করা হয়। একজন সুস্থ মানুষের মস্তিষ্ক সব সময়ই সক্রিয় থেকে শরীরের চেতন-অচেতন সব ধরনের কাজে অংশগ্রহণ করে। এমনকি মস্তিষ্ক দৈনন্দিন কাজের জন্য মানবদেহে উৎপাদিত ২০ শতাংশ শক্তি ব্যবহার করে। কারণ, মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ ভিন্ন ভিন্ন কাজে নিয়োজিত থাকে। যেমন দেখা, শোনা, পড়া, ঘ্রাণ নেওয়া ইত্যাদি শনাক্ত ও প্রক্রিয়াকরণের জন্য মস্তিষ্কের আলাদা অংশ রয়েছে। শরীরজুড়ে বিস্তৃত নিউরনের জাল বৈদ্যুতিক সংকেত মস্তিষ্কে বয়ে নিয়ে যায়, আবার মস্তিষ্ক থেকে নির্দেশ বয়ে আনে। নিরবচ্ছিন্নভাবে এ প্রক্রিয়া চলে। এ কারণেই মস্তিষ্কে এত শক্তির প্রয়োজন হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক একাডেমিক চিকিৎসাকেন্দ্র মায়ো ক্লিনিকের স্নায়ু বিশেষজ্ঞ জন হেনলি বলেন, মানুষ মস্তিষ্কের পুরোটাই ব্যবহার করে এবং এটির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে। এমনকি মানুষ যখন ঘুমায়, তখনো মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল কর্টেক্স সক্রিয় থাকে।
বাল্টিমোর জনস হপকিন্স স্কুল অব মেডিসিনের স্নায়ু বিশেষজ্ঞ ব্যারি গর্ডন বলেন, ‘১০ শতাংশের ব্যাপারটি শুধু ভুলই নয়, হাস্যকরও বটে। মস্তিষ্কের মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহার করে কোনো কাজই করা সম্ভব নয়।’
স্নায়ু বিশেষজ্ঞ ব্যারি ব্যায়ারস্টেইন সাত কারণে প্রচলিত এই ধারণাকে শুধুই শ্রুতিকথা হিসেবে প্রমাণ করেন। যথা:
১. মস্তিষ্কের মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহৃত হয়ে থাকলে, কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তেমন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, মস্তিষ্কের কোনো অংশের সামান্য ক্ষতিতে বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়।
২. মস্তিষ্কের আধুনিক স্ক্যান পদ্ধতিতে দেখা গেছে, মস্তিষ্ক সর্বদা সক্রিয় থাকে। তবে কিছু অংশ হয়তো কখনো অন্য অংশের চেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে। এমনকি ঘুমের মধ্যেও মানুষের মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকে। অবশ্য কোনো অংশ গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত মস্তিষ্কের নীরব এলাকার দেখা যেতে পারে।
৩. অক্সিজেন ও শক্তি খরচের দিক থেকে মস্তিষ্ক মানবশরীরের সবচেয়ে ব্যয়বহুল অঙ্গ। এটি শরীরের প্রায় ২০ শতাংশ শক্তি খরচ করে, যদিও ওজন সমগ্র শরীরের মাত্র ২ শতাংশ। যদি এ রকম একটি অঙ্গের শতকরা ৯০ ভাগই অকেজো থাকত, তাহলে বিবর্তনের ধারায় মস্তিষ্কের নিষ্ক্রিয় অংশগুলো অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় বাদ হয়ে যেত। নৃতাত্ত্বিক প্রমাণ বলছে, বিবর্তনের শুরুর দিকে শিশুর বড় মস্তিষ্কের কারণে প্রসবের সময় বহু মায়ের ও নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। ৯০ শতাংশ অপ্রয়োজনীয় হলে বিবর্তনীয় ধারায় মানুষের মস্তিষ্ক হতো আকারে আরও ছোট।
৪. মস্তিষ্কের প্রতিটি অংশেরই আলাদা কাজ রয়েছে। পুরো মস্তিষ্ক এককভাবে কাজ না করে, বরং প্রতিটি অংশ একটি জটিল প্রক্রিয়ায় সমষ্টিগতভাবে কাজ করে। এই প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে এমন কোনো অঞ্চল পাওয়া যায়নি, যার কোনো কার্যকর ভূমিকা নেই।
৫. সিঙ্গেল ইউনিট রেকর্ডিং ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কে ক্ষুদ্র ইলেকট্রোড প্রবেশ করিয়ে প্রতিটি নিউরন পর্যবেক্ষণ করেন। যদি শতকরা ৯০ ভাগ নিউরন নিষ্ক্রিয় থাকত, তাহলে সেটি এই রেকর্ডিংয়ে ধরা পড়ার কথা।
৬. অব্যবহৃত থাকলে মস্তিষ্কের কোষের অবক্ষয়ের প্রবণতা রয়েছে। যদি শতকরা ৯০ ভাগ নিউরন কোষই অকার্যকর থাকত, তাহলে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কের অটোপসিতে বিশাল পরিসরে অবক্ষয় পরিলক্ষিত হতো।
আইনস্টাইন তাঁর মস্তিষ্কের মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহার করতে পেরেছিলেন?
বলা হয়ে থাকে, আলবার্ট আইনস্টাইন এক সাক্ষাৎকারে জনৈক সাংবাদিককে বলেছিলেন, তিনি তাঁর মস্তিষ্কের মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহার করতে পেরেছেন। কিন্তু আইনস্টাইনের এ বক্তব্যের কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে আলবার্ট আইনস্টাইনের আর্কাইভ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়, তাঁদের কাছে এমন কোনো রেকর্ড নেই। অর্থাৎ আইনস্টাইনের নামে কেউ মিথটা চালু করেছিল।
সিদ্ধান্ত
মানুষ মস্তিষ্কের মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহার করতে পারে—এই ধারণার জন্ম আঠারো শতকের শেষভাগ থেকে। তবে ঠিক কীভাবে এই গালগল্পের শুরু হলো, এ সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। এ ধারণার জন্ম যেভাবেই বা যখনই হোক, এর যেকোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, তা বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।