বিনোদন ডেস্ক: একসময় নায়ক ফারুকের ছবির প্রতীক্ষায় থাকতেন চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষ। কবে মুক্তি পাবে ‘মিয়া ভাই’র নতুন ছবি তা নিয়ে আগ্রহের থাকত উত্তুঙ্গে। চলচ্চিত্রের পর্দায় নেই বহু বছর, তবু এখন তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন অগুণতি ভক্ত-অনুরাগী। অপেক্ষা তার রোগমুক্তির, প্রতীক্ষা তার দেশে ফেরার। সমকালের প্রতিবেদক এমদাদুল হক মিলটন-এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিস্তারিত।
চলচ্চিত্রের মিয়া ভাইখ্যাত অভিনেতা আকবর হোসেন পাঠান ফারুক দশ মাসের বেশি সময় ধরে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঢাকার এই সংসদ সদস্যের শারীরিক অবস্থার কখনও উন্নতি, আবার কখনও অবনতি হয়েছে কয়েক মাস ধরে। ছিল নানা শঙ্কাও। তবে কখনও হাল ছাড়েননি তার পরিবারের সদস্যরা। চালিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসা।
ফারুকের চিকিৎসার জন্য এরই মধ্যে বিক্রি করতে হয়েছে প্রায় পনেরো কোটি টাকা মূল্যের দুটি ফ্ল্যাট। ব্যাংক অ্যাকাউন্টও শূন্য হয়েছে। পাশাপাশি স্বজনদের কাছ থেকে ধার-দেনা করতে হয়েছে। জনপ্রিয় এই অভিনেতা চার মাস ছিলেন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ)। সেমি কোমায় কেটেছে আরও চার মাস। মাঝে শারীরিক অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে তাকে লাইফ সাপোর্টেও রাখা হয়েছিল। সে সময় মৃত্যুর গুজবও রটেছিল!
তবে এখন ফারুকের শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। একটু একটু করে তিনি সুস্থ হয়ে উঠছেন। পাঁচ মাস আগে তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। তার সর্বশেষ অবস্থা জানতে কথা হয় তার স্ত্রী ফারহানা ফারুকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ফারুকের শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। এখন নিজের পছন্দের সব ধরনের খাবার খেতে পারছেন। রক্তচাপ ও পূর্বের অন্যান্য যে সমস্যা ছিল, তাও এখন নিয়ন্ত্রণে। স্নায়ুতন্ত্রে নতুন কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে, যা আগে ছিল না। চিকিৎসকরা বলেছেন, এর চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি। তাই ধৈর্য ধরে চিকিৎসা চালাতে হবে।’
ফারুক কবে নাগাদ পুরোপুরি সুস্থ হবেন তা নির্দিষ্ট করে জানাতে পারছেন না চিকিৎসকরা। তবে ফারহানা আশাবাদী, দ্রুতই সুস্থ হবেন। তিনি বলেন, ‘কাজপাগল মানুষটি কাজ করতে চায়। সংসদীয় এলাকার অনেক কাজকর্ম জমা পড়ে আছে। আশা করছি, দেশে ফিরেই কাজগুলো করবেন। তার জন্য দোয়া করবেন সবাই।’
হাসপাতালে কীভাবে সময় কাটছে ফারুকের- জানতে চাইলে ফারহানা পাঠান বলেন, ‘ইবাদত বন্দেগি করছেন। আল্লাহর কাছে দোয়া চেয়ে চোখের পানি ফেলেন। সারাক্ষণই চিকিৎসকরা কেবিনে আসা-যাওয়া করছেন। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। দুই সন্তানকে ঢাকায় রেখে এক বছর ধরে একাই হাসপাতালে আছি। সন্তানদের জন্য সবসময় ফারুকের মনটা অস্থির থাকে। ভিসা জটিলতায় সন্তানরা তার বাবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারছে না। টুরিস্ট ভিসা পেলেও একটু দেখে যেতে পারত। সেটাও সম্ভব হচ্ছে না।’
ফারহানা জানান, ‘সিঙ্গাপুর মাউন্ট এলিজাবেথে চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল, সে জন্য সম্পত্তি বিক্রি করতে হয়েছে। সন্তানরা দেশে থেকে তার বাবার জন্য টাকা পাঠাচ্ছে। সহায়-সম্পত্তি সব চলে গেলেও আফসোস নেই। আপনাদের মিয়া ভাই দ্রুত সুস্থ হয়ে সবার মাঝে ফিরে আসুক, এটাই একমাত্র চাওয়া। ফারুক তো আমার একার নয়, পুরো বাংলাদেশের। দেশে সবাই তার অপেক্ষায় আছেন।’
তিনি আরও জানান, ‘চিকিৎসকরা ফারুককে যখন আইসিইউতে রাখার পরামর্শ দেন ওই সময় আমাদের হাত একেবারে খালি ছিল। অনেক চেষ্টা করে করোনার কারণে উপযুক্ত দামে ফ্ল্যাটও বিক্রি করতে পারছিলাম না। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফারুকের চিকিৎসার জন্য প্রথমেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তার দেওয়া টাকা দিয়েই আইসিইউর প্রথম মাসের বিল পরিশোধ করেছি। সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।’
ফারুকের একমাত্র ছেলে রওশন হোসেন পাঠান শরৎ বলেন, ‘দীর্ঘদিন আব্বু সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন। তার চিকিৎসার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে বারিধারার দুটি ফ্ল্যাট বিক্রি করেছি। সেখানে আমরা থাকিনি। এর আগেই বিক্রি করতে হলো। আব্বু হাসপাতালে বেশিদিন থাকলে আরও টাকা লাগতে পারে। স্বজনদের কাছ থেকেও দেনা করেছি। আব্বুর সুস্থতার জন্য শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করব। সরকারও সহযোগিতা করেছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। যেটুকু সহযোগিতা পেয়েছি, তাতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। বিপদের সময় তিনি আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।’
শরৎ বলেন, ‘আব্বুর সঙ্গে মাঝে মাঝে যোগাযোগ হয়। তিনি আমাদের দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করেছেন। তার রোগমুক্তির জন্য শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে দোয়া চাচ্ছি।’
সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে আট বছর ধরে চিকিৎসাসেবা নেন ফারুক। সর্বশেষ ২০২০ সালে অক্টোবর মাসের শেষদিকে চিকিৎসা শেষে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে আসেন তিনি। এর কিছুদিন পর করোনায় আক্রান্ত হন। চিকিৎসকেরা আগেই বলে দিয়েছিলেন, পুরোনো বেশ কিছু শারীরিক জটিলতা থাকায় মাঝে মাঝে ফারুকের শরীর খারাপ হতে পারে। সে জন্য তিন মাস পরপর রুটিন চেকআপে থাকতে হবে।
গত বছরের মার্চে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সিঙ্গাপুরে যান ফারুক। এরপর থেকেই অসুস্থতা অনুভব করছিলেন তিনি। চিকিৎসকের পরামর্শে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। ওই সময়ে চিকিৎসকরা জানান, রক্তে দুটি সংক্রমণও রয়েছে। মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত একদম অচেতন ছিলেন তিনি। এক মাসের বেশি সময় ধরে কথা বলতে পারেননি ফারুক। এপ্রিলে তার অসুস্থতা আরও বাড়তে থাকে। জুনে তার অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করে। তবে খুব ধীর গতিতে। পরে তাকে আনা হয় কেবিনে। গত ১৮ আগষ্ট ছিল তার জন্মদিন। হাসপাতালের বিছানায় কেটেছে তার এই বিশেষ দিনটি। যদিও ১৯৭৫ সালে জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর আর কখনই নিজের জন্মদিন উদযাপন করেননি এই অভিনেতা।
এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ দিয়ে চলচ্চিত্রে আসেন ফারুক। এ ছবিতে তার নায়িকা ছিলেন কবরী। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র খান আতাউর রহমানের পরিচালনায় ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ও নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’ ছবিতে অভিনয় করে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন তিনি। তার অভিনীত ‘সুজন সখী’ ও ‘লাঠিয়াল’ ব্যাপক প্রশংসিত হয়। অর্জন করেন ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা। ‘সখী তুমি কার’ ছবিতে শাবানার বিপরীতে শহুরে ধনী যুবকের চরিত্রে অভিনয় করে সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ান তিনি। ১৯৮৭ সালে ‘মিয়াভাই’ চলচ্চিত্রের সাফল্যের পর তিনি চলচ্চিত্রাঙ্গনে ‘মিয়াভাই’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
‘নাগরদোলা’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘কথা দিলাম’, ‘মাটির পুতুল’, ‘সাহেব’, ‘ছোট মা’, ‘এতিম’, ‘ঘরজামাই’ ‘সূর্যগ্রহণ’, ‘নয়নমনি’, ‘সারেং বৌ’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ তার ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র।
পাঁচ দশকের বেশি সময়ের অভিনয় ক্যারিয়ারে তাকে নানাভাবে দেখা গেছে। ‘লাঠিয়াল’ থেকে শুরু করে ‘প্রেমিক’। কখনও দেখা গেছে সারেং কিংবা প্রতিবাদী যুবকের ভূমিকায়। গ্রামীণ যুবকের চরিত্রের পাশাপাশি শহুরে চরিত্রেও তাকে দেখেছেন দর্শক।
‘লাঠিয়াল’-এর জন্য তিনি সেরা পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। তবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিয়ে একটা ক্ষোভ রয়ে গেছে তার, দীর্ঘ ক্যারিয়ারের প্রায় সকল ছবিই সফল, তবুও সেরা অভিনেতার পুরস্কার ঠিকই রয়ে গেছে অধরা। তবে তিনি পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা।
চলচ্চিত্র ও রাজনৈতিক জীবনের বাইরে তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী। গাজীপুরে অবস্থিত শিল্প প্রতিষ্ঠান ফারুক নিটিং ডাইং অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি।
১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার তুমলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণসোম গ্রামে জন্ম নেন চিত্রনায়ক ফারুক। পুরো নাম আকবর হোসেন পাঠান দুলু। শৈশব-কৈশোর কেটেছে গ্রামের বাড়ি ও পুরান ঢাকায়। পরে বসবাস শুরু করেন উত্তরায় নিজ বাড়িতে।
ফারুকের বাবার নাম আজগর হোসেন। ৬ বোন ও ২ ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবচেয়ে ছোট। ফারুক ভালোবেসে বিয়ে করেন ফারহানাকে। তাদের সন্তান ফারিহা তাবাসসুম পাঠান তুলশী ও রওশন হোসেন পাঠান শরৎ। স্কুলজীবন থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন ফারুক। যোগ দেন ছয় দফা আন্দোলনে। অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। ২০১৮ সালে ঢাকা-১৭ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন তিনি।
ফারুক আবারও সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন– এই প্রত্যাশা তার ভক্তকুলের।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।