জুমবাংলা ডেস্ক: জন্মভূমি ম্যাসিডোনিয়া থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে রূপকথার নগর ব্যাবিলন। সেই ব্যাবিলনে, দ্বিতীয় নেবুচাদনেজারের প্রাসাদে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছেন দিগ্বিজয়ী ম্যাসিডোনিয়ান বীর আলেকজান্ডার। প্রাসাদের সবচেয়ে খোলামেলা ও বড় ঘরটিতে রাখা হয়েছে তাকে। বাকশক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেছেন। ব্যাবিলনের মানুষ, সারিবদ্ধ ভাবে বিছানায় মিশে যাওয়া সম্রাটকে শেষ দেখা দেখে যাচ্ছেন। শেষ বিদায় জানাতে এসেছেন সৈন্যরা। আলেকজান্ডার চোখের ইশারায়, কখনো মাথা নেড়ে সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন।
১১ বছরে ২১ হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে, সাম্রাজ্যের সীমানা ম্যাসিডোনিয়া থেকে টেনে নিয়ে গিয়েছেন হিন্দুকুশ পর্বতমালা পর্যন্ত। ফেরার পথে অজানা অসুখে আক্রান্ত হলেন। ব্যাবিলনে ফিরে এসে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে রাত জেগে প্রচুর সুরা পান করেন আলেকজান্ডার। এই কারণেই সম্ভবত রোগের মাত্রা বেড়ে যায়। অল্প কিছুক্ষণের জন্য জ্বর কমলেও, এখন তা ভীষণ আকার ধারণ করেছে। নড়াচড়া করার শক্তি হারিয়েছেন বুসেফেলাসের পিঠে বসে উদ্দামবেগে ছুটে চলা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। আজ তিনি মৃত্যুশয্যায়।
ক্ষীন কন্ঠে তিনি বললেন, সেনাপতিরা যেন আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার তিনটি শেষ ইচ্ছা অবশ্যই পূরণ করেন
প্রথম ইচ্ছা: ‘চিকিৎসকরাই একমাত্র আমার কফিন বহন করবেন।’
ব্যাখ্যা: ‘আমার চিকিৎসকদেরই কফিন বহন করতে বলেছি। যাতে মানুষ বোঝেন চিকিৎসকরা ক্ষমতাহীন এবং মৃত্যুর হাত থেকে কাউকে রক্ষা করতে অক্ষম।’
দ্বিতীয় ইচ্ছা: ‘যে পথ দিয়ে আমার কফিন সমাধিস্থলে নিয়ে যাওয়া হবে, সেই পথে আমার কোষাগারে থাকা সব সোনা, রুপা ও মূল্যবান পাথর ছড়াতে ছড়াতে যেতে হবে।’
ব্যাখ্যা: ‘পথে আমার সম্পদ ছড়াতে বললাম, মানুষ জানুক আমার সম্পদের একটা কণাও আমার সঙ্গে যাবে না। এগুলোর জন্য আমি সারা জীবন সময় দিয়েছি , কিন্তু এখন কিছুই নিয়ে যেতে পারছি না। ধন-সম্পদের পিছনে ছোটা সময়ের অপচয় মাত্র।’
তৃতীয় ইচ্ছা: ‘কফিন বহনের সময় আমার দুই হাত কফিনের বাইরে ঝুলিয়ে রাখতে হবে।’
ব্যাখ্যা: ‘আমি এই পৃথিবীতে খালি হাতে এসেছিলাম, খালি হাতেই চলে যাচ্ছি। এটা মানুষকে বোঝাতেই আমি কফিনের বাইরে আমার হাত ছড়িয়ে রাখতে বলেছি’
দ্বিতীয় নেবুচাদনেজারের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ, এখানেই প্রয়াত হয়েছিলেন গ্রিক বীর
সকাল বেলায় সেনাপতিরা আলেকজান্ডারকে জিজ্ঞেস করেন, তার সিলমোহর বসানো আংটি তার মৃত্যুর পর কে পরবেন। আলেকজান্ডার ফিসফিস করে বলেছিলেন, ‘যে সবচেয়ে শক্তিশালী’। দুপুর গড়াতেই তার চোখ বুজে আসতে শুরু করল। বুকের ওঠা নামা প্রায় বোঝাই যাচ্ছে না। কথা বলার শক্তি পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। শয্যার পাশে এসে দাঁড়ালেন তার তিন স্ত্রী, রোক্সানা, স্টাটেইরা ও পারিসাটিস। উপস্থিত আলেকজান্ডারের প্রিয় সেনাপতি সেলুকাস। গতকাল সারা রাত সেবাপিসের মন্দিরে কাটিয়েছেন সেলুকাস। সঙ্গে ছিলেন মেনডিয়াস, অ্যাটলাস, পিথন, ডেমোফোন, পিউসেন্টাস ও ক্লিওমেনসেস। প্রার্থনা করেছেন সম্রাটের জন্য। ডাক্তারেরা আলেকজান্ডারের বুকের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। একসময় তাঁরা উঠে দাঁড়ালেন। ১১ জুন, বিকেল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে কোনো এক সময়ে, ১১ দিন ভুগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ম্যাসিডোনিয়ান বীর আলেকজান্ডার। যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৩২৩ বছর আগে। বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৩।
অ্যারিস্টটলের প্রিয় শিষ্য আলেকজান্ডারের মৃত্যুর কারণ আজও রহস্যাবৃত। মৃত্যুর কারণ নিয়ে তার সময় থেকে শুরু করে বর্তমান যুগের ঐতিহাসিক ও গবেষকরা একমত হতে পারেননি। কেউ বলেন তার মৃত্যু হয়েছে অসুখে। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর কারণ হিসেবে উঠে এসেছে বিভিন্ন রোগের নাম, যেমন ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, স্পন্ডিলাইটিস, মেনিঞ্জাইটিস,প্যাংক্রিয়াটাইটিস, খাদ্যনালীর আলসার। কেউ বলেছেন পশ্চিম নীলনদ অঞ্চলের এক ভয়ংকর ভাইরাসের আক্রমণে মারা গিয়েছিলেন এই গ্রিক বীর। কেউ বলেন আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পেছনে লুকিয়ে আছে গভীর ষড়যন্ত্র। আলেকজান্ডারকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল। আলেকজান্ডারের বিখ্যাত সেনাপতি, অ্যান্টিপাটেরকে হত্যাকারী হিসেবে সন্দেহ করা হয়েছিল। এশিয়া জয়ের উদ্দেশে দেশ ছাড়ার আগে আলেকজান্ডার এই অ্যান্টিপাটেরের হাতে ম্যাসিডোনিয়ার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর ম্যাসিডোনিয়া চালাবার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেন এই অ্যান্টিপাটের।
প্রায় ১০ বছর ধরে গবেষণার পর, এই তত্ত্ব জনসমক্ষে আনেন নিউজিল্যান্ডের ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল পয়জনস সেন্টারের গবেষক লিও শেপ। প্রাচীন গ্রিসে আয়ুর্বেদিক ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হত হোয়াইট হেলিবোর (ভেরাট্রাম অ্যালবাম) নামের এক বিষাক্ত লতা। গবেষক লিও শেপের মতে, সেই লতাকে পচিয়ে তৈরি করা হয়েছিল ভয়ংকর বিষ। তীব্র কটু স্বাদের ঐ বিষ আলেকজান্ডারের মিষ্টি ওয়াইনের পাত্রে কেউ মিশিয়ে দিয়েছিল। বিষ মেশানো সুরা পান করে মারা যান আলেকজান্ডার।
গ্রীকদের কাছে আলেকজান্ডার ছিলেন দেবতা। আলেকজান্ডার নিজেও নাকি ভাবতেন, তিনি কোনো সাধারণ মানুষ নন। ইতিহাস বলছে মৃত্যুর ছয় দিন পরেও আলেকজান্ডারের শরীরে পচন ধরেনি। আর এই তথ্যটি নিয়েই গবেষণা করেন নিউজিল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ ওটাগোর সিনিয়র লেকচারার ডা. ক্যাথেরিন হল। যিনি মৃত্যুশয্যায় থাকা রোগীদের নিয়ে বহুদিন ধরে গবেষণা করে আসছেন। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর কারণ নিয়ে সাম্প্রতিক বিস্ফোরণটি তিনিই ঘটিয়েছেন, The Ancient History Bulletin ম্যাগাজিনে।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর আগে প্রচন্ড জ্বর ও তলপেটে অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগেছিলেন। ডা. হল নিশ্চিত আলেকজান্ডারের শরীরে কোনো ভাবে Campylobacter pylori নামক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ঘটেছিল। এর ফলে আলেকজান্ডার Guillain-Barré Syndrome (GBS) নামে একটি অসুখের শিকার হন। এটি একটা বিরল কিন্তু মারাত্মক একটি স্নায়বিক অসুখ। যা শরীরের স্নায়ুতন্ত্রের সুস্থ কোষকে আক্রমণ করে। এই অসুখেই তার মৃত্যু হয়।
ডা. ক্যাথেরিন হল জোর দিয়ে বলেছেন, আলেকজান্ডারের মৃত্যুর ছয় দিন পরেও তার দেহে পচন ধরেনি। কারন আলেকজান্ডার তখনও বেঁচে ছিলেন। তার সব শরীরে পক্ষাঘাত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সজ্ঞানে (compos mentis) ছিলেন। আলেকজান্ডারের শরীরকে যত পক্ষাঘাত গ্রাস করছিল, তত শরীরের অঙ্গের কাজ কমছিল এবং শরীরে অক্সিজেনের প্রয়োজন কমছিল। এর ফলে তার শ্বাসপ্রশ্বাস অত্যন্ত ধীরে চলছিল। বুকের ওঠা নামা প্রায় বোঝা যাচ্ছিল না। প্রাচীনকালে ডাক্তাররা, রোগী জীবিত না মৃত তা বুঝতেন রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস দেখে। রোগীর পালস দেখা তখনো শুরু হয়নি। ফলে মৃত্যুর আগেই আলেকজান্ডারকে মৃত ঘোষণা করা হয়। উপস্থিত সবাই তাকে মৃত মনে করলেও আলেকজান্ডার তখনো মারা যাননি।
আলেকজান্ডারের মৃত্যু, তাকে মৃত ঘোষণা করার ছয়দিন পরে হয়েছে। তাই সবাই ভেবেছিলেন মৃত্যুর ছয় দিন পরেও আলেকজান্ডারের শরীরে পচন ধরেনি।
সূত্র: দ্য ওয়াল
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।