জুমবাংলা ডেস্ক : মৃত্যুর এক যুগ পর অবশেষে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি-কপিলমুনির বীরঙ্গনা গুরুদাসী মন্ডল (গুরুদাসী মাসী)। এলাকাবাসীর দীর্ঘ দিনের প্রাণের দাবি ও বিভিন্ন সময় জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিকে ব্যাপক লেখালেখির প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়েরর সচিব তপন কান্তি ঘোষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের ৭০ তম সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে গত ১৪ ডিসেম্বর তাঁকে বীরাঙ্গনা হিসেবে গেজেটভুক্ত করা হয়।
এদিন গুরুদাসী মণ্ডলসহ ৬১ জন নারীর বিরঙ্গনা হিসেবে তালিকাভূক্ত করে এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে সরকারের তালিকায় বীরাঙ্গনার সংখ্যা চার শ জনে উন্নীত হলো।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ সাংবাদিকদের বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ ও বীরাঙ্গনাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের যথাযথ স্বীকৃতি ও মর্যদা নিশ্চিত করতে চায়।
এর আগে সচিব গুরুদাসী মন্ডলকে বিরঙ্গনা হিসেবে তালিকাভূক্ত করতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এখন থেকে তারা ও তাদের পরিবার রাষ্ট্রীয় সকল সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা পাবেন।
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীণ পাকবাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হন গুরুদাসী ও তার পরিবার। তার বাড়ী উপজেলার দেলুটির বারোআড়িয়া গ্রামে। স্বামী গুরু পদ মন্ডল ছিলেন, পেশায় একজন দর্জি। গুরদাসী দেখতে সুন্দরী হওয়ায় তার উপর নজর পড়ে পাকদোসরদের। এক পর্যায়ে ঘটনার দিন তারা তাঁর বাড়ীতে হানা দিয়ে গুরুদাসীর উপর হামলে পড়ে পাশবিক নির্যাতন শুরু করে। ঘটনায় স্বামী গুরুপদ এতে বাঁধা দিলে তার চোখের সামনে স্বামী, দু’ছেলে ও এক মেয়েকে গুলি করে হত্যা করে তারা।
প্রচার রয়েছে, ঘটনার সময় গুরুদাসীর ছোট মেয়ে মায়ের কোলে দুধ খাচ্ছিল তখন পাক দোসররা আকষ্মিক ঐ বাড়ীতে হানা দেয়। এক পর্যায়ে তারা মায়ের কোল থেকে শিশুটিকে ছিনিয়ে নিয়ে কাঁদা মাটিতে পুতে মেরে ফেলে। এসময় সুন্দরী গুরুদাসীকে তার নিজ বাড়িতে আটকে রেখে পাক দোসররা নির্যাতন শুরু করে। এতে গুরুদাসী প্রাণে বেঁচে থাকলেও মানষিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। খবর পেয়ে পরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা তাকে উদ্ধার করে নিজেদের কাছে রেখে দেন। দেশ স্বাধীনের পর মানষিক ভারসাম্যহীন গুরুদাসীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাবনার মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেও সেখান থেকে চলে আসেন তিনি।
শুরু হয় তার ভবঘুরে জীবন-যাপন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে এক সময় পাইকগাছার কপিলমুনিতে আসেন, স্থায়ী হন সেখানে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কাছে তিনি গুরুদাসী মাসী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। ভিক্ষাই ছিল তার জীবন জীবিকা নির্বাহের একমাত্র মাধ্যম। সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় কুঞ্চির ছোট একটি লাঠি হাতে সাপ-সাপ বলে মানুষকে ভয় দেখিয়ে, কখনোবা পিঠে আলতো করে আদরমাখা একটি বাড়ি মেরে হাত পেতে দু/পাঁচ টাকা চেয়েই চলত তার জীবন-জীবিকা। অপরিচিতদের অনেকে আকষ্মিক আচরণে ক্ষুব্ধ কিংবা বিব্রত হলেও শিশুদের ন্যায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে দেখা যেত তাকে। তবে প্রায়ই তার মুখে একটা জিজ্ঞাসা বার বার তাড়া করে ফিরত, কবে ফিরবে তার স্বামী-সন্তান? কখনো আবার প্রশ্ন রাখতো, কবে বিচার হবে তার স্বামী-সন্তান হন্তারকদের? উপজেলাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এমন কোন মানুষ নেই যে, তাকে চিনতো না।
পাগলীবেশে সারাক্ষণ বিভিন্ন প্রান্তে লাঠি হাতে ঘুরে ঘুরে পথচারীদের ভয় দেখিয়ে দু/পাঁচ টাকা উপার্জনকারী মানুষটি সব সময় বেশি কথা বলতেন। তবে অতি প্রলাপের মূল বিষয় ছিল, কবে তার স্বামী-সন্তানদের হত্যাকারীদের বিচার হবে ? তার মাথা গোজার ঠাঁই বা আশ্রয়ের জন্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট স, ম, বাবর আলী এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (সাবেক সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব) মিহির কান্তি মজুমদার স্থানীয় কপিলমুনিতে সরকারী জায়গায় তার বসবাসের জন্য একটি ছোট্ট বাড়ি তৈরী করে দেন। এরপর থেকে তিনি সেখানেই স্থায়ী হন।
বীরঙ্গনা গুরুদাসী মানবেতার জীবনযাপনের একপর্যায়ে ২০০৮ সালের ৮ ডিসেম্বর কপিলমুনিস্থ সরকারের দেয়া বাড়ীতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর খবরে সে সময় ছুট আসেন এ অঞ্চলের মুক্তিযাদ্ধা, প্রশাসনসহ সর্ব স্তরের সাধারণ মানুষ। যুদ্ধকালীণ সর্বহারা গুরুদাসীর সরকারি কোন তালিকায় নাম না থাকায় সাধারণ মানুষের মত শেষকৃত্য অনুষ্ঠান করা হয় সেদিন। তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে গঠন করা হয়ছিল বীরঙ্গনা গুরুদাসী স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ।
মৃত্যুর পর নেতৃবৃন্দ তার বসবাসের বাড়িটি স্মৃতি যাদুঘর ও পাঠাগার তৈরীর ঘোষণা দেন। যদিও অদ্যবধি প্রতিশ্রæতির বাস্তবায়ন হয়নি। অযত্নে আর অবহেলায় পড়ে আছে গুরুদাসী মাসির স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি।
বাড়িটি সংরক্ষণের ব্যাপারে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট স.ম. বাবর আলী বলেন, গুরুদাসীর বাড়িটি লাইব্রেরী করার পরিকল্পনা ছিল তাদের। যার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি আজো।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবিএম, খালিদ হোসেন সিদ্দিকী বলেন, এ বিষয়ে আমরা মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছি এখন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত কপিলমুনি জনপদের সাধারণ মানুষের দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন পূরণে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অধিষ্টিত জনপদের কৃতি সন্তানদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দীর্ঘ দিনের না পাওয়া বেদনা লাঘব হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকারের সদিচ্ছা ও স্বপ্নসারথীদের প্রচেষ্টায় কপিলমুনিতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ’র (বদ্ধভূমি) বাস্তবায়ন হয়েছে। অর্থ বরাদ্দ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কমপ্লেক্সভবন নির্মাণসহ নানা স্থাপনা বাস্তবায়নে। কপিলমুনি ভরত চন্দ্র হাসপাতাল স্বনামে ফিরে নির্মিত হচ্ছে আধুনিক ২০ শয্যা বিশিষ্ঠ হাসপাতাল। কপিলমুনি বিনোদগঞ্জ পৌরসভা বাস্তবায়নে এগিয়ে গেছে অনেক দূর।
উন্নয়নের মহাসোপানে চড়ে আমরা এখন কপোতাক্ষের উপর কপিলমুনি-কানাইদিয়া সেতু কিংবা বিরঙ্গনা মাসীর কুঁড়ে ঘরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি লাইব্রেরী বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখতেই পারি। স্বপ্নসারথীদের (তপন কুমার ঘোষ কিংবা ইউসুফ হারুনদে’র) হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে কপিলমুনি। এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।