ডা. হিমেল ঘোষ : প্রত্যেকেরই একটি স্বপ্ন থাকে। হোক খুবই ছোট কিংবা আকাশ ছোঁয়া। হতে পারে পরিবারের জন্য কিছু করার স্বপ্ন বা সমাজের সবার উপকারের জন্য। মোটকথা স্বপ্নই একজন মানুষকে বেঁচে থাকার শক্তি জোগায়। এই স্বপ্নই একজন মানুষকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে। চিকিৎসক হয়ে দেশ ও দশের উপকারের স্বপ্ন দেখেনি, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে অনেকের মনেই চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন বাসা বাঁধে। একজন চিকিৎসকের পক্ষে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সাধ্যমত সেবা ও সাহায্য করা যতটা সম্ভব, অন্য পেশা থেকে ততটা নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করার প্রয়াস একটু হলেও কষ্টকর। তাই পরোপকারের মহান ব্রত অন্তরে ধারণ করে অনেকেই মনের গহীনে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন বুনে থাকেন। কিন্তু চিকিৎসক হিসাবে নিজেকে যোগ্যতর করে উপস্থাপন করার এই পথ বড়ই বন্ধুর। এজন্য চাই অসামান্য আত্মনিয়োগ, কঠোর শ্রম, দৃঢ় সংকল্প আর সময়োপযোগী অধ্যয়ন।
করোনা মহামারীর এ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সব ক্লাস এবং পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি এখনো পুরোপুরিভাবে সমাধা করা সম্ভব হয়নি। ইতোমধ্যে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা স্থগিত করা হয়েছে। জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের সমন্বয়ে এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। তদুপরি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা কবে নাগাদ অনুষ্ঠিত হতে পারে, সে বিষয়েও এখনো যৌক্তিক কারণেই কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু স্বপ্ন তো আর থেমে থাকে না। স্বপ্ন যখন আকাশ ছোঁয়ার, তখন আগাম পরিকল্পনা হিসাবে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তিচ্ছুদের যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করে ভবিষ্যৎ চিকিৎসক হিসাবে ক্যারিয়ার প্ল্যান করার এটাই উপযুক্ত সময়।
মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার মানবণ্টন বিবেচনা করলে দেখা যায়, জীববিজ্ঞান থেকে ৩০, রসায়ন থেকে ২৫, পদার্থবিজ্ঞান থেকে ২০, ইংরেজি থেকে ১৫, সাধারণ জ্ঞানের ভেতরে বাংলাদেশ, ইতিহাস ও সংস্কৃতি থেকে ৬ এবং আন্তর্জাতিক অংশ থেকে ৪ নম্বরের সর্বমোট ১০০ নম্বরের ১০০টি প্রশ্ন আসে। প্রতিটি প্রশ্নের মান ১। পরীক্ষার মোট সময়কাল ১ ঘণ্টা। এ পরীক্ষার ১০০টি প্রশ্নই থাকে এমসিকিউ অর্থাৎ বহুনির্বাচনীমূলক। এ এমসিকিউ পরীক্ষায় ন্যূূনতম পাস মার্ক হলো ৪০। তবে মূল পরীক্ষা ১০০ নম্বরের হলেও ১০০ নম্বরের এমসিকিউ এবং ২০০ নম্বর এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার জিপিএ থেকে মূল্যায়ন করে মোট ৩০০ নম্বরের ভিত্তিতে মেধাক্রম গণনা করা হয়। এসএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত জিপিএকে ১৫ দিয়ে গুণ করার পর এইচএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত জিপিএকে ২৫ দ্বারা গুণ করে দুই প্রাপ্ত গুণফলের সমষ্টি থেকে জিপিএ-এর এ মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। এখানে উল্লেখ্য, মেডিকেল কিংবা ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষায় আবেদনের ক্ষেত্রে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় মোট জিপিএ ন্যূনতম ৯.০০ থাকতে হবে। সেইসাথে এইচএসসি পরীক্ষায় জীববিজ্ঞানে ন্যূনতম জিপিএ ৩.৫০ থাকতে হবে।
বহুনির্বাচনীমূলক পরীক্ষায় প্রতি ভুল উত্তরের জন্য প্রাপ্তনম্বর থেকে ০.২৫ নম্বর কাটা হয়ে থাকে অর্থাৎ প্রতি ৪টি ভুল উত্তরের জন্য প্রাপ্তনম্বর থেকে ১ নম্বর কাটা যাবে। মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার এ এমসিকিউতে সিঙ্গেল উত্তরের পাশাপাশি কখনো কখনো ডাবল, ট্রিপল কিংবা ব্ল্যাংক উত্তরও থাকতে পারে। অর্থাৎ ১টি বহুনির্বাচনী প্রশ্নের ৪টি অপশনের মধ্যে কখনো ২টি বা কখনো ৩টি উত্তর থাকতে পারে। আবার কখনো কোনো সঠিক উত্তর না-ও থাকতে পারে। এরকম ক্ষেত্রে অপশনের ২টি বা ৩টি সঠিক উত্তরই বৃত্ত ভরাট করতে হবে পূর্ণ নম্বর প্রাপ্তির জন্য। কোনো সঠিক উত্তর না থাকলে কোনো অপশনই বৃত্ত ভরাট করা যাবে না। অন্যথায় ওই প্রশ্নের জন্য কোনো নম্বর তো পাওয়া যাবেই না- উল্টা প্রশ্নের উত্তর ভুল পরিগণিত হবে ও প্রাপ্তনম্বর থেকে ০.২৫ নম্বর কাটা যাবে।
মেডিকেলে ভর্তির জন্য নিখুঁত প্রস্তুতি প্রয়োজন। কোনো গাইড বই কিংবা নোট পড়ে শর্টকাট করে পড়াশোনাকে কমিয়ে নিলে কিন্তু কাজ হবে না। বরং মূল পাঠ্যবইয়ের উপর বিশদ দক্ষতা থাকতে হবে। মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষায় জীববিজ্ঞান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বহুনির্বাচনীমূলক প্রশ্ন জীববিজ্ঞান থেকেই বেশি আসে। তাই জীববিজ্ঞানের পাঠ্যবইয়ের গুরুত্বপূর্ণ লাইন বা টপিকগুলো দাগিয়ে পড়তে হবে। জীববিজ্ঞান থেকে সাধারণত বৈশিষ্ট্য, পার্থক্য, ছক, উদাহরণ ইত্যাদি অনেক জোর দিয়ে পড়তে হয়। এগুলো মনে রাখা অনেক সময় বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। ছড়া বা ছন্দে সাজিয়ে পড়লে এবং কঠিন বিষয়গুলো বারবার লেখার অভ্যাস করলে এগুলো সহজেই আয়ত্তে চলে আসবে।
মূল বই পড়ার সময় প্রতিটি অধ্যায়ের পাশে নিজের নোট লিখে রাখা যেতে পারে। এগুলো শেষ সময়ের প্রস্তুতিতে অনেক সাহায্য করে। দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য নিয়মিত নমুনা পরীক্ষা দেওয়া যেতে পারে। ভর্তি পরীক্ষা যেহেতু এমসিকিউ নির্ভর, তাই প্রশ্ন নিয়ে প্রচুর ঘাঁটাঘাটি করতে হবে। বিগত বছরের প্রশ্নগুলো সমাধান করলে তা প্রশ্নের ধারা বোঝার জন্য সাহায্য করতে পারে। এ ছাড়াও কোন অধ্যায়ের কোন অংশ থেকে প্রশ্ন বেশি আসে, সে ব্যাপারেও একটি পরিষ্কার ধারণা হয়ে যাবে এ থেকে। পরীক্ষার সময় প্রতিটি মুহূর্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রশ্নের উত্তর করার বাইরে এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টাতে যেন আর কিছু বিরক্ত না করে, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। পরীক্ষাকেন্দ্রে বসে বসার চেয়ার বা পরীক্ষার টেবিলটা ভাঙা কি না কিংবা সব ঠিকঠাক আছে কি না, তা মূল পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই দেখে নেওয়া উচিত। একবার পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলে এসব নিয়ে ভাবার সময় আর থাকে না। যেসব প্রশ্নের উত্তরের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকা যায়, সেগুলো আগে উত্তর করে ফেলা ভালো।
কিছু কিছু ছোটখাটো বিষয় মাথায় রাখা জরুরি, যেমন- মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষায় গাণিতিক সমস্যা খুব কমই আসে। বা আসলেও সেগুলো খুবই সাধারণ কিছু গাণিতিক সমস্যা। তাই পদার্থ ও রসায়নের তত্ত্বীয় বিষয়াবলীর দিকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। ভর্তি পরীক্ষায় উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণিবিদ্যার মধ্যে প্রাণিবিদ্যা থেকে প্রশ্ন বেশি আসে। অন্যদিকে রসায়ন ১ম ও ২য় পত্রের মধ্যে ১ম পত্র থেকে প্রশ্ন বেশি আসে। পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ১ম পত্রের চেয়ে ২য় পত্র থেকে একটু বেশি প্রশ্ন আসতে দেখা যায়। তবে ভর্তি পরীক্ষায় এ সংখ্যা বছরভেদে কিছু কম-বেশি হতে পারে। এজন্য গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো জেনে নিয়ে ভালোমত রপ্ত করতে হবে। ইংরেজির জন্য বাধাধরা তেমন কোনো সিলেবাস নেই। তবে Voice, Narration, Transformation, Article , Parts Of Speech, Synonym-Antonym, Idiom-Phrase থেকে প্রতিবছরই প্রশ্ন আসে। তাই এগুলোতে ভালো দক্ষতা থাকা আবশ্যক। ভর্তি পরীক্ষায় সাধারণত সাম্প্রতিক বিশ্ব থেকে কোনো প্রশ্ন আসে না। তাই সাম্প্রতিক বিশ্বের পাশাপাশি গুরুত্ব সহকারে সাধারণ জ্ঞানের অন্যান্য বিষয়, যেমন- রাজধানী, মুদ্রা, সদর দফতর, ঐতিহাসিক স্থান, নদ-নদী, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় স্মরণীয় ঘটনা প্রভৃতি বিবিধ আন্তর্জাতিক ও বিবিধ বাংলাদেশ বিষয়ক অধ্যায় ভালো করে রপ্ত করতে হবে। প্রতিদিন রুটিন করে সময় বের করে নিয়ে মূল পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিত ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞানচর্চা বাড়াতে হবে।
পরীক্ষার পূর্বের একমাস প্রস্তুতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, এ সময়ে সহায়ক কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ থাকে। কোচিংয়ের চাপ থাকে না বলে অনেকে এ সময়ে পড়াশোনায় একটু পিছিয়ে যায়। অনেকেই ভেবে থাকে যে প্রস্তুতি যা নেওয়ার, তা তো নেওয়া হয়েই গেছে। এটা একটা বড় ভুল। এ সময়টাতেই আরও বেশি করে প্রস্তুতি নিতে হবে। এ ছাড়া একেকজনের পড়ার কৌশল কিন্তু একেক রকম। কে কোন বিষয়ে ভালো আর কোথায় কার দুর্বলতা, সেটা একমাত্র সে-ই সবচেয়ে ভালো জানে। তাই নিজের পড়ার ধরনের সঙ্গে মেলে, এমনভাবেই কোনো পরিকল্পনা করা উচিত। কারো একবার পড়লেই মনে থাকে, কারো আবার একই জিনিস বারবার অনুশীলন করতে হয়। যেভাবে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা যায়, এ ভর্তিযুদ্ধে সফলকাম হতে সেভাবেই একটি পরিকল্পনা সাজিয়ে নিতে হবে।
তবে কখনোই আত্মবিশ্বাস হারানো যাবে না, আবার অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসও কিন্তু ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। সেইসাথে ভর্তি প্রস্তুতির দিকে বেশি জোর দিতে গিয়ে নিজে অসুস্থ হয়ে পড়লে কিন্তু চলবে না। ভালো পরীক্ষা দেওয়ার জন্য সবার আগে সুস্থ থাকাটা ভীষণ জরুরি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।