তানভীর শাহরিয়ার রিমন : ৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয় আর মেসির ৫ম বিশ্বকাপে এসে শিরোপা স্পর্শ করার মাঝে অনেক কিছু শিখার আছে।
আমরা যারা ব্যবসা করি, চাকরি করি, বিভিন্ন পেশায় যুক্ত আছি, তারা বহু কিছু গ্রহণ করতে পারি মেসি এবং তার টিমের এই অমূল্য এবং বহু প্রার্থীত জয় থেকে। যারা নেতৃত্ব শিখতে আগ্রহী, নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, কর্পোরেট হাউজে, সোসাইটিতে ইমপেক্ট তৈরী করতে চান, তারা মেসির কাছ থেকে বহু কিছু শিখতে পারেন।
১। লয়ালিটিঃ আজকাল যারা নিজেদের ক্যারিয়ারিস্ট দাবী করেন, ক্যারিয়ার বিল্ডিং প্রসেসে আছেন, তাদের দেখি একটি প্রতিষ্ঠানে ৬ মাস কিংবা ১ বছর কাজ করে কিছু বাড়তি সুযোগ সুবিধা পেয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে জব সুইচ করে ফেলেন। তারপর ওখানে কিছুদিন করে অন্য কোথাও, অন্য কোথাও। কোনো স্থায়িত্ব নেই, কমিটমেন্ট নেই। এভাবে কি প্রকৃত সাফল্য আসে? আসেনা।
সাফল্যের জন্য সাসটেইনেবলিটি দরকার। দরকার নিজের এমপ্লয়ার’র প্রতি লয়ালিটি। ভাবা যায়, মেসি বার্সেলোনায় খেলেছেন টানা ২০ বছর। জুনিয়র টিম থেকে শুরু করে সিনিয়র টিম। করেছেন গোলের পর গোল। জিতেছেন ট্রেবল। সর্বোচ্চ সংখ্যক ব্যালন ডি অর। তারপর যখন বার্সেলোনা ছাড়লেন, চোখের পানিতে ভেসেছেন নিজে, ভেসেছে পুরো বার্সেলোনা। এরকম লয়ালিটি কী আজকাল দেখা যায়?
২। টিম বিল্ডিংঃ মেসি নাকি যতটা বার্সেলোনার ততটা নাকি আর্জেন্টিনার না! এরকম ভয়াবহ অভিযোগ তার নামে বহুবার করা হয়েছে। অথচ তার হৃদয়, প্রাণ জুড়ে পুরোটাই আর্জেন্টিনা। তিনি জিততে চেয়েছেন সবসময়। সেই অভিষেক ওয়াল্ডকাপেই ১৮ বছর বয়সে ঝলক দেখিয়েছেন। তারপর ৮ বছরের ব্যবধানে অল্পের জন্য কাপ জিততে পারেননি। হয়েছেন রানার আপ। একক নৈপুন্যে টিমকে ফাইনালে তুলেও চ্যাম্পিয়ন হতে না পারার দুঃখ তাকে নীরবে পুড়িয়েছে। ২০২১ থেকে মেসি যেন পণ করলেন, খেলবেন, খেলাবেন, নেতৃত্ব দেবেন সামনে থেকে। ২০২১ এ কোপা জয় কোনো ফ্লুক ছিলনা, তার প্রমাণ ২০২২ এর ওয়াল্ড কাপ বিজয়। এর মাঝে মেসি নেতা হিসাবে পৌছে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। এমন টিম বানিয়েছেন যারা শুধু পা দিয়ে নয় বরং হৃদয় দিয়ে খেলে। দি পল এর মতো এক ছায়া সঙ্গী তৈরী করেছেন, যে মুহূ্র্তে পড়তে পারে, মেসি কি চাচ্ছেন। দি মারিয়ার মতো এক বন্ধু যে ইনজুরি নিয়েও লড়ে যেতে চায় শুধু বন্ধুর হাতে কাপ তুলে দিবে বলে। আলভারেজ এর মতো এক তরুণ যে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যায়, প্রয়োজনে গোলের পর গোল করতে পারে। সর্বোপরি মার্টিনেস নামের এক ওয়াল তিনি তৈরী করেছেন যে প্রতিপক্ষের গোলা সামলে দেয় অনায়াসে, প্রয়োজনে মেসির জন্য জীবন দিতে পারে। দিজ ইজ টিম বিল্ডিং। দিজ ইজ লিডারশিপ।
৩। সতীর্থদের পাশে থাকাঃ আপনি যদি বড় নেতা হতে চান তাহলে সবসময় আপনার সহকর্মী, আপনার বস, আপনার পুরাতন সবকর্মী, আপনার মেন্টর সবার প্রতি গ্রেটিটিউড থাকতে হবে। প্রয়োজনে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। মাঝে মাঝে প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে অকপটে সত্য কথা বলতে হবে। নেদারল্যাল্ড এর সাথে খেলাটার কথা চিন্তা করুন। মেসিকে কখন, কবে এরকম উন্মত্ত রূপে দেখা গেছে? সচরাচর একজন নীরব, বিনয়ী ফুটবলার হিসাবেই সবাই তাকে চেনে। সেই তিনি সেদিন সঙ্গীদের পাশে থেকে লড়েছেন, ধাক্কা খেয়ে পাল্টা ধাক্কা দিয়েছেন। ডাচ কোচ ফন গালের সামনে গিয়ে তার সাবেক সহ খেলোয়াড়, রিকলমের প্রতি অবজ্ঞার জবাব দিয়েছেন রিকলমের স্টাইলে উদযাপন করে। এইসব কিছু নেতা হিসাবে তার সহকর্মীদের চোখে তাকে আরো বড় হিরো বানিয়েছে। তারা এমন নেতার জন্য অনায়াসে জীবন দিতে পারে। আর মেসি পারেন, তার সতীর্থের অপমানের বদলা নিতে।
৪। যেকোনো সমালোচনার জবাব দিতে হবে পারফরমেন্স দিয়েঃ মেসি বুড়িয়ে গেছেন। তাকে দিয়ে হবেনা। আগের সেই গতি নেই, ফ্লেক্স নেই। আরো কত কি! আপনি হলে কী করতেন, মুখে জবাব দেয়ার চেষ্টা করতেন। মেসি বেছে নিলেন সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্মে নিজেকে প্রমাণের। তার খেলা দেখে কে বলবে তার বয়স ৩৫ বছর? সেই অবিশ্বাস্য ড্রিবলিং, চোখ ধাধানো নিখুঁত পাস, আর পারফেক্ট নিশানা। সেরা খেলোয়াড়, সবচেয়ে বেশি ম্যান অব দ্য ম্যাচ, সেরা অধিনায়ক নিজেকে প্রমাণের আর বাকি আছে কিছু?
৫। রেজাল্ট না আসা পর্যন্ত লেগে থাকার চেষ্টাঃ আমরা খুব দ্রুত সাফল্য চাই। আজকে চাকরিতে যোগ দিয়ে কালকেই লাখ টাকা কামাতে চাই। অথচ সবসময় এরকম নাও হতে পারে। সময় লাগতে পারে সাফল্যের দেখা পেতে। আমরা এরকম পরিস্থিতিতে অনেকেই হাল ছেড়ে দিই। মেসিকে দেখুন, ২০০৬ সাল থেকে চেষ্টা করছেন কাপ জয়ের। চেষ্টা করেছেন ২০১০, ২০১৪, ২০১৮ তে। পর পর ৪ বার ব্যর্থ হয়েও তিনি হাল ছাড়েননি। এবার সৌদি আরবের সাথে হেরে যাওয়ার পর সবাই যখন ট্রল করছিল, তখন তিনি নতুন প্রতিজ্ঞায় শানিত করেছেন নিজেকে, নিজের টিমকে। ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠে জয় করেছেন কাপ। এই ২০ বছর টানা লেগে ছিলেন, ফোকাস বদলাননি একটুও। নিজেদের ভুল ত্রুটি সংশোধন করেছেন। তারপর সর্বোচ্চ নিংড়ে দিয়ে বিজয়ের ব্যাটন হাতে তুলেছেন। এই অধ্যাবসায়, লেগে থাকার নিদারুণ চেষ্টায় অনন্য তিনি।
৬। আউট অব দ্যা বক্স চিন্তাঃ আমরা সবসময় বক্সের ভেতরে থাকতে চেষ্টা করি। নিজের কমফোর্ট জোনে কাজ করতে চাই। মেসিরা এবার সেই স্টাইল ভেঙ্গেছেন। যার সাথে যেরকম প্ল্যান করে খেলা দরকার তার সাথে সেভাবেই খেলেছেন তারা। ছোট ছোট পাস দিয়ে খেলার স্টাইলে অভ্যস্থ আর্জেন্টিনা। অথচ ক্রোয়েশিয়ার সাথে দেখলাম অন্য আর্জেন্টিনা। কাউন্টার এটাক স্টাইলে খেলেছে তারা। সফলও হয়েছে।
৭। শৃঃখলাঃ জীবনে সফলতার জন্য ডিসিপ্লিন সবচেয়ে দরকারী। মেসির মতো সুশৃংখল খেলোয়াড় বড় বিরল। কোনো স্ক্যান্ডাল নেই, কোনো খারাপ অভ্যাস নেই। খেলার সময় যেমন পুরোটা ঢেলে দেন তেমনি পরিবারকে উজাড় করে ভালোবাসেন। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে সুখের সংসার তার। বাবা, মাকেও দেখভাল করেন।
এইসব কিছুই তারে গ্রেটেস্ট অব অল টাইম (G O A T) বানিয়েছে। স্যালুট লিও মেসি।
লেখক: তানভীর শাহরিয়ার রিমন, সিইও, র্যাংকস্ এফসি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।