চীনের উহান শহরে যখন নতুন করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) ব্যাপক সংক্রমণ ঘটল, তখন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, ফ্লাইট বাতিলসহ নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব। পাশাপাশি সেসব দেশের কর্মকর্তাদের বক্তব্য ও অবস্থান নিয়ে বেশ চাপের মুখে পড়ে চীন। একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ভাইরাসটি নিয়ে অতিপ্রতিক্রিয়া না দেখানোর আহ্বানও জানায় বেইজিং। এরই মধ্যে জরুরি ও সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে খারাপ পরিস্থিতি প্রায় কাটিয়ে উঠেছে চীন। বিপরীতে সেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এখন করোনায় ভয়াবহ পরিস্থিতি। মার্কিন মুলুকে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। কোয়ারেন্টাইনে গেছেন পাঁচ রিপাবলিকান। অকল্যান্ড বন্দরে ভিড়েছে করোনা আক্রান্ত যাত্রীসহ প্রমোদতরি গ্র্যান্ড প্রিন্সেস। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় গত বুধবার ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারির ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, দেড় বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ চলার মধ্যেই গত ডিসেম্বরে উহান শহরে শনাক্ত হয় নতুন করোনাভাইরাস। শুরুতে ভাইরাসটিকে পাত্তা না দিয়ে বড় বিপদের মুখে পড়ে চীন। একপর্যায়ে দেশটিতে এ রোগ মহামারি রূপ নেয়। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করে পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দেন। এরই মধ্যে ওয়াশিংটন ঘোষণা দেয়, যারা সম্প্রতি চীন সফর করেছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবে না। তখন চীন অভিযোগ করে, বেইজিংয়ের সংকটকালে যুক্তরাষ্ট্র অতিপ্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে এবং আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অতিপ্রতিক্রিয়া দেখানোর অভিযোগ এনে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, ‘ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আছে। সংক্রমণ হঠাৎ হয়েছে এবং চীনসহ পুরো বিশ্বই চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের সর্বাত্মক ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। আমার মতে, আর কারো পক্ষে এতটা সম্ভব হতো না, কিন্তু চীন পেরেছে।’
গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রাজ্যের মধ্যে এরই মধ্যে ৪৩ রাজ্যে করোনাভাইরাসের রোগী পাওয়া গেছে। রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি ও ২৩টি রাজ্যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশটিতে এ পর্যন্ত মারা গেছে অন্তত ৩৮ জন। আক্রান্ত হয়েছে এক হাজার ৪২৭ ব্যক্তি। এরই মধ্যে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় নিজেদের সামর্থ্যের ঘাটতির কথা স্বীকার করে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের পরিচালক ড. অ্যান্থনি ফাউসি গতকাল বলেন, ‘এটা স্বীকার করতে হবে যে এই মুহূর্তে ঠিক যেমনটা প্রয়োজন ছিল, ঠিক সেই সামর্থ্য আমাদের নেই।’
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) হিসাব অনুযায়ী, করোনা সন্দেহে গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত তারা ১১ হাজার ৭৯ জনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছে। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় এই সংখ্যা দুই লাখ ১০ হাজার। এমনকি দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতিদিন ২০ হাজার জনের করোনা পরীক্ষা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে এ পর্যন্ত সন্দেহভাজন ২৯ হাজার ৭০০ জনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়েছে। এ ছাড়া দেশটিতে প্রতিদিন কভিড-১৯ পরীক্ষা করা হয় অন্তত এক হাজার জনের।
ট্রাম্পের জন্য আরেকটি দুশ্চিন্তার সংবাদ হলো, গত রবিবার ফ্লোরিডায় তিনি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দপ্তরের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান ফ্যাবিও ওয়াজগার্তেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। ব্রাজিল সরকার গতকাল জানিয়েছে, ফ্যাবিও ওয়াজগার্তেন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
কংগ্রেসে বলেছেন, এই করোনা প্রাদুর্ভাব আরো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এটা নির্ভর করছে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতার ওপর। ভাইরাস পরীক্ষা করাতে বড় অঙ্কের অর্থ খরচ হচ্ছে। তাই অনেক মার্কিনি পরীক্ষার খরচ জোগাতে অক্ষমতার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিচ্ছে না।
করোনার বিস্তার রোধে ব্রিটেন ছাড়া ইউরোপের সব দেশ থেকে আগামী ৩০ দিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘এই বিদেশি ভাইরাস (কভিড-১৯) যুক্তরাষ্ট্রে আসছে বিদেশি পর্যটকদের মাধ্যমে। বিশেষ করে ইউরোপ থেকে আসা পর্যটকদের মাধ্যমে।’ ট্রাম্প বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র যে ধরনের পূর্বসতর্কতা গ্রহণ করেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) তা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এই নিষেধাজ্ঞার নিন্দা জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। গতকাল ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা এক বিবৃতিতে বলেন, করোনাভাইরাস বৈশ্বিক সংকট। এটি মোকাবেলায় পারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। কোনো ধরনের আলোচনা না করেই এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করা নিন্দাজনক।
ভারতে প্রথম মৃত্যু
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে প্রতিবেশী দেশ ভারতে। গতকাল কর্নাটক রাজ্যের কালবুর্গি জেলায় এই ভাইরাসে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়। তিনি নিজ বাড়িতেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। কর্নাটকের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। গত মাসের শেষ দিকে সৌদি আরব থেকে ভারতে ফিরেছিলেন ওই বৃদ্ধ। সেই সময় তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা হলেও করোনার উপসর্গ ধরা পড়েনি। এর মধ্যে গত ৫ মার্চ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। পরে তাঁকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়ার পর জানা যায়, করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তিনি।
৩৯ দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা সৌদির
করোনা ঠেকাতে ইইউর দেশসহ ৩৯টি দেশের নাগরিকদের জন্য ভ্রমণে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সৌদি আরব। একই সঙ্গে বেশ কিছু দেশের ফ্লাইটও স্থগিত করা হয়েছে।
সৌদি আরবের সরকারি বার্তা সংস্থা এসপিএ জানিয়েছে, যেসব দেশের ফ্লাইট স্থগিত করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সুইজারল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, সুদান, ইথিওপিয়া, দক্ষিণ সুদান, ইরিত্রিয়া, কেনিয়া, জিবুতি এবং সোমালিয়া।
‘চীনে মহামারির গুরুতর পর্যায় পার হয়েছে’
চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের মুখপাত্র ও প্রচার বিভাগের উপপ্রধান মি ফেং বলেছেন, মহামারির গুরুতর পর্যায় পার করেছে চীন। বর্তমানে নতুন আক্রান্ত লোকের সংখ্যা কমেছে এবং ভাইরাসের সংক্রমণ কমেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার যৌথ মহামারি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, বুধবার উহানে নতুন আক্রান্ত লোকের সংখ্যা ছিল আটজন। উহান ছাড়া হুবেই প্রদেশের অন্যান্য শহরে বিগত এক সপ্তাহে নতুন কোনো আক্রান্ত মানুষ পাওয়া যায়নি। হুবেই ছাড়া অন্যান্য প্রদেশে নতুন আক্রান্ত সাতজনের মধ্যে ছয়জন বিদেশফেরত। এ অবস্থায়ও চীন অব্যাহতভাবে মহামারি প্রতিরোধে গুরুত্ব দিয়ে যাবে।
মি ফেং আরো বলেন, বর্তমানে নভেল করোনাভাইরাস বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এ অবস্থাকে গুরুত্ব দেয় চীন। চীন প্রকাশ্য, স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল মনোভাব নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে সহযোগিতা করবে এবং বিশ্বে মহামারি প্রতিরোধে নিজস্ব অবদান রাখবে।
বৈশ্বিক পদক্ষেপ
মহামারি আকার ধারণ করার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ব্যবস্থা নেওয়ার খবর জানাচ্ছে। গতকাল আয়ারল্যান্ড কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছে, করোনা মোকাবেলায় আজ থেকে সেখানকার সব স্কুল, কলেজ ও চাইল্ড কেয়ার বন্ধ থাকবে। ঘরোয়া কোনো অনুষ্ঠানে এক শর বেশি লোক জমায়েত হতে পারবে না। আর উন্মুক্ত অনুষ্ঠানে পাঁচ শর বেশি মানুষ জমায়েত হতে পারবে না। আর অবরুদ্ধ ইতালিতে ওষুধ ও খাবার ছাড়া সব ধরনের দোকান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে করোনা টেস্ট করাবেন বলে ঘোষণা এসেছে। আর কাজাখস্তানে স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের পাশাপাশি উন্মুক্ত অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
গতকাল রাশিয়া জানিয়েছে, করোনা পরীক্ষার সহায়তা হিসেবে তারা কিট পাঠিয়েছে ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া, উজবেকিস্তান ও আজারবাইজানে।
বৈশ্বিক মৃত্যুহার বাড়ছে
গতকাল বাংলাদেশ সময় রাত ৮টা নাগাদ ১২৫টি দেশ ও অঞ্চলে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার খবর জানিয়েছে পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটার। এ সময়ে বৈশ্বিক আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২৯ হাজার ৫৮৭তে। মারা গেছে চার হাজার ৭৪৯ জন। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী সম্প্রতি করোনায় বৈশ্বিক মৃতের হার কিছুটা বেড়েছে। সপ্তাহখানেক আগে এই হার ছিল ৩.৪ শতাংশ। এখন তা ৩.৬৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
গতকাল চীনে মারা গেছে ১১ জন; ইরানে ৭৫, স্পেনে ২৯, দক্ষিণ কোরিয়ায় ছয় ও সুইজারল্যান্ডে দুজন। এ ছাড়া জার্মানি, জাপান, অস্ট্রিয়া, গ্রিস, ইরাক, লেবানন, পোল্যান্ড ও আলজেরিয়ায় মারা গেছে একজন করে। আর ইতালিতে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০১৬ জনে। সূত্র : বিবিসি, ডয়েচে ভেলে, পার্সটুডে, আনন্দবাজার পত্রিকা, সিআরআই।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।