যে অসাধারণ আবিষ্কারে অবদান রেখেছেন পৃথিবীর হাজারখানেক বিজ্ঞানী! কেন এত বিজ্ঞানী, কেনই বা এত সময়? মূল কথা হলো, একটি অসাধারণ আবিষ্কারের জন্য প্রয়োজন অসাধারণ সব প্রমাণ। প্রথমত, ১৯৫৭ সাল অবধি মহাকর্ষীয় তরঙ্গের বাস্তবতা নিয়ে বিতর্ক ছিল। প্রয়োজন ছিল অনেক বিশ্লেষণাত্মক এবং সংখ্যাসূচক গবেষণার। বিভিন্ন উত্স থেকে আসা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য কী তা জানার।
দ্বিতীয়ত, কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে সৃষ্ট মহাকর্ষীয় তরঙ্গ যখন পৃথিবীতে পৌঁছায়, তখন তাদের আকার অত্যন্ত ছোট হয়ে যায়। এত দুর্বল এই তরঙ্গ শনাক্ত করা অনেক কঠিন কাজ। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৫ সালে ১৪ সেপ্টেম্বর যে তরঙ্গটি পৃথিবীতে এসেছে, তার আকার একটি প্রোটনের ব্যাসের চেয়ে প্রায় ১০০০ গুণ ছোট ছিল। এই তরঙ্গ মাপার জন্য দরকর অতি অসাধারণ সংবেদনশীল যন্ত্র এবং তথ্য বিশ্লেষণের জন্য দরকার উন্নত প্রযুক্তি।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করার জন্য নির্মিত হয়েছে লাইগো। লাইগো ডিটেক্টর হচ্ছে L-আকৃতির একটি মাইকেলসন ইন্টারফেরোমিটার। এটি একটি সাধারণ ইন্টারফেরোমিটারের চেয়ে অনেক উন্নত, এতে আছে লেজার রশ্মির ক্ষমতা পুনর্ব্যবহারযোগ্য পদ্ধতি ও অপটিক্যাল অনুনাদক (Power-Recycled Michelson Interferometer with Fabry-Perot Cavities)।
ইন্টারফেরোমিটারের প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য ৪ কিলোমিটার। পুরো ভিটেক্টরটি নিখুঁত শূন্যস্থানে (Vacuum) রাখা হয়েছে। প্রতিটি বাহুর দুই প্রান্তে আছে ‘আপাতদৃষ্টিতে শূন্যে ঝুলন্ত’ দুটি আয়না (Super-Polished High Grade Fused Silica Clinders)। প্রতিটি আয়নার ভর ৪০ কেজি। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী যখন মহাকর্ষীয় তরঙ্গ প্রবাহিত হবে, তখন আয়নার মধ্যবর্তী দূরত্ব ওপরের বর্ণনা অনুযায়ী অতি ক্ষুদ্র পরিমাণ পরিবর্তিত হবে। এই পরিবর্তন মাপার জন্য ব্যবহার করা হয় উচ্চক্ষমতার স্থিতিশীল লেজার রশ্মি।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গের দ্বারা সৃষ্ট এই অপরিমেয় ক্ষুদ্র পরিবর্তন যাতে পরিবেশের (অর্থাৎ মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ছাড়া যেকোনো কিছুর) প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত থাকে, এর জন্য লাইগোতে ব্যবহৃত হয়েছে অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি। বসানো হয়েছে ৩ হাজার কিলোমিটার দূরত্বে দুটি লাইগো ডিটেক্টর। তাদের সজ্জিত করা হয়েছে পৃথিবী থেকে আসা সব ধরনের সংকেত মাপার যন্ত্র দিয়ে।
লাইগো তার উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে চলছে—মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ব্যবহার করে মহাকাশ গবেষণা, অর্থাৎ মহাকর্ষীয় তরঙ্গ জ্যোতির্বিদ্যা বা গ্র্যাভিটেশনাল-ওয়েভ অ্যাস্ট্রোনমি। শনাক্ত করতে হবে নতুন নতুন উত্স। জানতে হবে তাদের বৈশিষ্ট্য। সমাধান খুঁজতে হবে অজানা সব রহস্যের। ইতিমধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে আরও দুটি তরঙ্গ।
একটি ২০১৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর ১৪.২ ও ৭.৫ সৌরভর ব্ল্যাকহোলের সংঘর্ষ, যা ঘটেছিল প্রায় ১৪৩ কোটি বছর আগে। এবং অন্যটি ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি-৩১.২ ও ১৯.৪ সৌরভর ব্ল্যাকহোলের সংঘর্ষ, যা ঘটেছিল প্রায় ২৮৭ কোটি বছর আগে। এদের সংঘর্ষে যথাক্রমে ১ এবং ২ সৌরভরের সমপরিমাণ শক্তি মহাকর্ষীয় তরঙ্গে পরিণত হয়েছিল। উল্লেখ্য, এই দুই শনাক্তকরণের মাঝে প্রায় ৯ মাস লাইগোর উন্নয়নকাজের জন্য পর্যবেক্ষণ বন্ধ ছিল।
জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীরা এত দিন মনে করতেন, নাক্ষত্রিক-ভরের (Stellar-Mass) ব্ল্যাকহোলগুরোর ভর কখনো সূর্যের ভরের ২০ গুণের বেশি হবে না। কিন্তু লাইগোর প্রথম এবং তৃতীয়বারের শনাক্তকরণ বলছে, সেই অনুমান সঠিক নয়। ব্ল্যাকহোল থেকে আসা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আকৃতি অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে কম্পাঙ্কের (ফ্রিকোয়েন্সির) পরিবর্তন মূলত নির্ভর করে ব্ল্যাকহোলগুলোর ভর এবং তাদের স্পিনের (অর্থাৎ লাটিমের মতো নিজের অক্ষ ঘূর্ণন) ওপর।
তাই এই তরঙ্গের আকৃতি বিশ্লেষণ করে আমরা তাদের ভর এবং স্পিন কত, তা বলতে পারি। বিশেষ করে ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারির তরঙ্গ থেকে স্পিন সম্পর্কে আমরা যা যা জেনেছি, সে অনুযায়ী সম্ভবত ওই ব্ল্যাকহোল দুটির জন্ম একসঙ্গে হয়নি। পরে কোনো একটা সময়ে ওরা জোড়া গঠন করে।
জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীরা প্রতীক্ষা করছেন কখন নিউট্রন নক্ষত্র (Neutron Star) সংঘর্ষ থেকে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ভেসে আসবে! এ ক্ষেত্রে নিউট্রন নক্ষত্ররা নিজেদের সঙ্গে মিলিত হতে পারে অথবা ব্ল্যাকহোলের সঙ্গে মিলিত হতে পারে। অনুমান করা হচ্ছে যে এই সংঘর্ষ মহাবিশ্বের ভারী উপাদানের অনেক, যেমন ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম ও স্বর্ণ তৈরি করে। নিউট্রন নক্ষত্রের উপস্থিতির কারণে এ ধরনের সংঘর্ষে তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গও তৈরি হবে।
তাই এদের ক্ষেত্রে যৌথ গবেষণা করা যাবে। অর্থাৎ টেলিস্কোপ ও স্যাটেলাইট দিয়ে তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ এবং লাইগো দিয়ে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ একই সঙ্গে শনাক্ত করা যাবে। আর এতে জানা যাবে অনেক অজানা তথ্য, মিলবে অনেক রহস্যের সমাধান। উদাহরণস্বরূপ, এ ধরনের সংঘর্ষগুলো হয়তো গামা-রে বিস্ফোরণ ব্যাখ্যা করতে পারবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।