জিয়াদুল ইসলাম : নানা শর্ত আর আর্থিক দৈন্যদশার কারণে সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন সাধারণ মানুষ। প্রতি মাসেই কমে যাচ্ছে নতুন বিনিয়োগ। আবার বিদ্যমান বিনিয়োগও মেয়াদপূর্তির আগে অনেকেই তুলে নিচ্ছেন। এতে নিট বিক্রি তথা বিনিয়োগ ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। সর্বশেষ ডিসেম্বর মাসেই নিট বিক্রি ঋণাত্মক হয়েছে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকারও বেশি। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) হিসাবে নিট বিক্রি ঋণাত্মকের পরিমাণ ৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের
নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানান, পণ্য ও সেবার দামে লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে জীবনযাপনের খরচ বেড়ে গেছে মানুষের, যার প্রভাব পড়ে সঞ্চয়ের ওপরও। বিশেষ করে নির্দিষ্ট আয়ে যাদের সংসার চলে, তাদের অনেকে এখনো সঞ্চয়পত্র ভেঙে খাচ্ছেন। এ ছাড়া নানা কড়াকড়ির কারণেও সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন অনেকে। ফলে এ খাতে আশানুরূপ বিক্রি বাড়ছে না।
নিম্ন মধ্যবিত্ত, সীমিত আয়ের মানুষ, মহিলা, প্রতিবন্ধী ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সঞ্চয়পত্রের বিভিন্ন প্রকল্প চালু রয়েছে। সামাজিক সুরক্ষার কথা বিবেচনায় নিয়ে সঞ্চয়পত্রে তুলনামূলক বেশি মুনাফা (সুদ) দেয় সরকার। তবে কড়াকড়িসহ বিভিন্ন কারণে গত অর্থবছরের ১২ মাসের মধ্যে ৭ মাসই সঞ্চয়পত্রের বিক্রিতে ধস নামে। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে নিট বিক্রি বেশ বেড়েছিল। এর কারণ, এ সময় যে পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল, তার চেয়ে ভাঙানোর পরিমাণ ছিল অনেক কম। আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্র থেকে ভাঙানো বাবদ (নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে বা মেয়াদান্তের আগে) আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে তাকে নিট বিক্রি বলা হয়। আর নিট বিক্রিকে সরকারের ধার বা ঋণ হিসেবে গণ্য করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ঋণাত্মক হয়েছে ২ হাজার ২০৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়েও নিট বিক্রি ঋণাত্মক ছিল প্রায় ১ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। যদিও চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই ও আগস্টে এই খাতে বিনিয়োগ বেশ বেড়েছিল। প্রথম মাস জুলাইয়ে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। আর দ্বিতীয় মাস আগস্টে এই বিক্রির অঙ্ক ছিল ২ হাজার ৩১২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। তবে সেপ্টেম্বর হতে নিট বিক্রি ঋণাত্মক হতে শুরু করে। সব মিলিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই ছয় মাসে যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তার চেয়ে ৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা বেশি ভাঙানো হয়েছে। এই অর্থ সরকারের কোষাগার থেকে অথবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করা হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সুদের হার হ্রাস ও নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপের কারণে সাধারণ মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। এ ছাড়া বাজারে সব জিনিসের দামই চড়া। মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে। পরিবহন, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্য সব খাতেই খরচ বেড়েছে। এতে মানুষের সঞ্চয় করার সক্ষমতা কমে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে।
জানা গেছে, গত অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। তবে বিক্রি কমতে থাকায় সংশোধিত বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ধরা হয় ৩২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছর শেষে নিট বিক্রি দাঁড়ায় ঋণাত্মক প্রায় ৩ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। এর মানে পুরো অর্থবছরে এই খাত থেকে সরকার এক টাকারও ঋণ পায়নি। ২০২১-২২ অর্থবছরেও সঞ্চয়পত্র থেকে তুলনামূলক কম ঋণ পেয়েছিল সরকার। পুরো অর্থবছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে নিট ঋণ আসে ১৯ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা।
এখন ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থাকলে রিটার্নের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ছাড়া গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব রকম সঞ্চয়পত্রের সুদহার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। তার আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা হয়। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। দুর্নীতি বা কালো টাকায় সঞ্চয়পত্র কেনা বন্ধে ক্রেতার তথ্যের একটি ডাটাবেজ তৈরি হয়েছে। মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি এসব শর্তও সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নেতিবচাক প্রভাব ফেলেছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।