সুবিশাল এই মহাবিশ্ব প্রতিক্ষণেই আরও বড় হচ্ছে। অর্থাৎ, প্রসারিত হচ্ছে। এটা আবিষ্কার করেন মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডুইন হাবল (১৮৮৯-১৯৫৩ খ্রি.)। মানুষের মহাকাশ গবেষণার অন্যতম অগ্রনায়ক তিনি। বিশ শতকে মহাকাশ গবেষণায় নতুন দিগন্তের সূচনা করেন। এই শাখার অগ্রগামী গবেষক হিসেবে কিংবা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকা সত্ত্বেও হাবল কখনো নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হননি। প্রশ্ন আসে, কেন?
এ প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে এডুইন হাবল সম্পর্কে খানিকটা জেনে নেওয়া যাক। ছাত্র জীবনে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলাতেও বেশ ভালো ছিলেন হাবল। আমেরিকান সকার, বেসবল বা বাস্কেট বল—সব খেলাতেই বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ১৯০৭ সালে কলেজে থাকা অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্কেট বল টিমের নেতৃত্ব দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনেন এডুইন হাবল।
এসব কিছুর পাশাপাশি পড়াশোনাতেও ছিলেন ভালো। মূলত পড়াশোনা করেন পদার্থবিজ্ঞান, গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯১০ সালে গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
এরপর নোবেল জয়ী মার্কিন পদার্থবিদ রবার্ট মিলিকানের গবেষণা সহকারী হিসেবে শুরু করেন কর্মজীবন। পদার্থের মৌলিক কণা ইলেকট্রন ও প্রোটনের চার্জ পরিমাপ এবং আলোকতড়িৎ ক্রিয়ায় প্রমাণের জন্য রবার্ট মিলিকান ১৯২৩ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। মিলিকানের অধীনে কাজ করাটা তাঁর জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা।
হাবলের শিক্ষাজীবন বেশ বৈচিত্র্যময়। বিজ্ঞানের পাশাপাশি তিনি রোডস স্কলার হিসেবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করেন। স্প্যানিশ ভাষার ওপরও পড়াশোনা করেন কিছু সময়। বহুমুখী জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ থাকলেও ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে আছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে। কারণ, জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছাড়িয়ে গিয়েছিল আর সব কিছু।
১৯১৯ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট উইলসন মানমন্দিরে ১০০ ইঞ্চি ব্যাসের একটি টেলিস্কোপ স্থাপন করা হয়। উদ্দেশ্য, দূরের গ্যালাক্সিগুলো পর্যবেক্ষণ করা। কিছুদিন পরে এই মানমন্দিরে যোগ দেন এডুইন হাবল।
এর চার বছর পরের কথা। ১০০ ইঞ্চি টেলিস্কোপে এম৩১ বা অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকার ছবি তুললেন হাবল (সে যুগে অ্যান্ড্রোমিডাকে নীহারিকা বলে ধারণা করতেন বিজ্ঞানীরা)। এ জন্য ৪০ মিনিট এক্সপোজার ব্যবহার করলেন। সেটা ১৯২৩ সালের ৪ অক্টোবরের কথা। ছবিটা ডেভেলপ করে পরীক্ষা করে দেখলেন, নতুন কিছু দাগ দেখা যাচ্ছে। তিনি ভাবলেন, এগুলো হয় ফটোগ্রাফিক প্লেটের ত্রুটি, নয়তো কোনো নীহারিকা বা নতুন তারা।
নিশ্চিত হতে পরের রাতে আবারও অ্যান্ড্রোমিডার ছবি তুললেন। এবার এক্সপোজার ব্যবহার করলেন ৫০ মিনিট। ছবি পরীক্ষা করে আরও দুটি নতুন দাগ দেখতে পেলেন। সে কালে যেকোনো নীহারিকা বা নক্ষত্রের নাম যত্ন করে ক্যাটালগ করে রাখা হতো। হাবল পরীক্ষা করে বুঝলেন, এগুলো আসলে আগের ক্যাটালগে নেই—নতুন পাওয়া গেছে। হাবলের সৌভাগ্য, এই ছবির তৃতীয় দাগটি নীহারিকা ছিল না, ছিল সেফিড ভ্যারিয়েবল স্টার বা শেফালি বিষমতারা।
এই শেফালি তারাকে স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডল হিসেবে ব্যবহার করা হতো মহাকাশের দূরত্ব মাপার কাজে। হেনরিয়েটা লেভিটের গবেষণার ফলে আগে থেকেই জানা ছিল, এই নক্ষত্রের আলো সময়ের সঙ্গে নিয়মিতভাবে উঠা-নামা করে। আর এ নক্ষত্রের একটা পুরো চক্রের সঙ্গে নক্ষত্রের উজ্জ্বলতার সম্পর্ক আছে।
নক্ষত্রটি যত উজ্জ্বল হয়, ততই তার পালস বা স্পন্দনের চক্রও দীর্ঘ হয়। কাজেই সহজভাবে এই চক্রের ব্যাপ্তি মেপে এর উজ্জ্বলতা ক্যালিব্রেট বা পরিমাপের মানদণ্ড ঠিক করা যায়। এর মাধ্যমে নির্ণয় করা যায় নক্ষত্রটির দূরত্ব।
হাবল দেখতে পান, এর চক্রের সময়সীমা বা ব্যাপ্তি ৩১.৪১৫ দিনের। অর্থাৎ এই বিষম তারাটা সূর্যের চেয়েও ৭ হাজার গুণ বেশি উজ্জ্বল। এর পরম ও আপাত উজ্জ্বলতা পরিমাপ করে তারাটির দূরত্ব নির্ণয় করেন হাবল। বিস্ময়ের সঙ্গে তিনি দেখলেন, নক্ষত্রটি পৃথিবী থেকে ৯ লাখ আলোক বর্ষ দূরে রয়েছে।
সে কালে বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, মহাবিশ্ব মানে শুধু মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। এর ব্যাস ধরা হয়েছিল প্রায় ১ লাখ আলোকবর্ষ। কাজেই ওই সেফিড নক্ষত্র তথা অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকা (যে নীহারিকার মধ্যে নক্ষত্রটির অবস্থান) মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ভেতরে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই এটা মিল্কিওয়ে থেকে অনেক অনেক দূরে রয়েছে। তার মানে, অ্যান্ড্রোমিডা অবশ্যই অবিশ্বাস্যরকম উজ্জ্বল।
কারণ তা খালি চোখেই পৃথিবী থেকে দেখা যায়। এরকম উজ্জ্বলতা শুধু কোনো নক্ষত্র ব্যবস্থাতেই থাকা সম্ভব। কাজেই অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকা নয়, সেটা আসলে একটা গ্যালাক্সি, যেখানে মিল্কিওয়ের মতোই কোটি কোটি নক্ষত্রের আবাস। এভাবে হাবল প্রমাণ করে দেখালেন, মহাবিশ্বটা শুধু মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে সীমাবদ্ধ নয়। এটা ছিল তাঁর প্রথম বড় কাজ।
এর কিছুদিন পরের কথা। দূরের গ্যালাক্সিগুলো পর্যবেক্ষণ করছেন হাবল। তিনি দেখলেন, দূরের গ্যালাক্সিগুলো লালচে দেখাচ্ছে টেলিস্কোপে। এই বিষয়টা আমাদের পরিচিত। তবে উদাহরণ হিসেবে শব্দের কথা বললে বিষয়টা বোঝা সহজ হয়। অ্যাম্বুলেসের শব্দ দূরে সরে যেতে থাকলে যেমন শব্দের তীব্রতা কমে, সেরকম করে এ ক্ষেত্রে কমে যাচ্ছিল গ্যালাক্সি থেকে আসা আলোর তীব্রতা। আলোর ক্ষেত্রে আমরা যেসব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো দেখতে পাই, তার মধ্যে সবচেয়ে কম কম্পাঙ্কের আলোর রং লাল।
এই পর্যবেক্ষণ থেকে হাবল সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন, গ্যালাক্সিগুলো আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ফলে সেখান থেকে আসা আলোর কম্পাংক ক্রমশ কমে আমাদের কাছে এসে পৌছাচ্ছে। ফলে, আমরা সেই আলোকে লাল আলো হিসেবে দেখছি। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায়, একে ডপলার ইফেক্ট বা ক্রিয়া বলা হয়। এর সঙ্গে নিশ্চয়ই সবাই পরিচিত।
এই গবেষণা কী বলে? সে কালে মানুষ ভাবত, মহাবিশ্ব স্থিতিশীল বা স্থির। আলবার্ট আইনস্টাইনও মহাবিশ্বকে স্থির ভাবতেন। হাবলের গবেষণায় দেখা গেল, সেটি সত্য নয়। মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে। হাবলের এই পর্যবেক্ষণ পরবর্তীতে বিগ ব্যাং বা মহাবিশ্বের জন্ম রহস্য উন্মোচনের দার খুলে দিয়েছিল।
আগেই বলেছি, জ্যোতির্বিজ্ঞানে হাবলের এত গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকার পরেও তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি। এর পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, হাবল যে সময় মহাবিশ্বের সম্প্রাসারণ আবিষ্কার করেন, ১৯২৯ সালে, তখন জ্যোতির্বিজ্ঞানে অবদান রাখলে তা পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল প্রদানের জন্য বিবেচিত হতো না। পরবর্তীতে হাবল তাঁর কর্মজীবনে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে পদার্থবিজ্ঞানের শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেন।
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, মহাকাশ নিয়ে হাবলের কাজ নিঃসন্দেহে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মহাবিশ্বকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছে তাঁর গবেষণা। কিন্তু এর প্রভাব ভবিষ্যতে কেমন হবে, তা হয়তো নোবেল কমিটি তখন পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি।
তৃতীয় আরেকটা কারণ বলা যায়, যা হাবলের নোবেল না পাওয়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছে। জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে হাবলের কাজটি ছিল মূলত পর্যবেক্ষণনির্ভর। সেরকম শক্ত কোনো তত্ত্ব বা পরীক্ষণ এর পেছনে ছিল না। রেড শিফট বা লোহিত সরণের ডাটা তিনি যেভাবে ব্যাখ্যা করতেন, তার ওপরেই নির্ভর করত পুরো বিষয়টি।
হাবল কখনো নোবেল পুরস্কার না পেলেও জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছেন। তাঁর নামে চাঁদের একটি খাদের নামকরণ করা হয়েছে। একটি গ্রহাণুর নাম দেওয়া হয়েছে তাঁরই নামে।
হাবলের অবদান আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন ১৯৯০ সালে পৃথিবীর কক্ষপথে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ পাঠায় মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। এর মাধ্যমে আমরা আইকনিক অনেক মহাজাগতিক বস্তুর ছবি পেয়েছি। এমন সব ছবি পেয়েছি, যা আগে কখনো পাওয়া যায়নি।
হাবল টেলিস্কোপের উত্তরসূরী হিসেবে পরে মহাকাশে পাড়ি জমিয়েছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। মানুষ যতদিন মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করবে, ততদিন এডুইন হাবলের নামটি সামনে আসবে ঘুরে ফিরে বারবার। তাঁর কর্ম জ্বলজ্বল করবে স্মৃতির মানসপটে। নোবেল পুরস্কারের চেয়ে এ অর্জন বোধহয় কম কিছু নয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।