আন্তর্জাতিক ডেস্ক : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে শুরুর পর থেকেই যে বিষয়টি ন্যাটো সামরিক জোটের প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হলো এই যুদ্ধে সরাসরি না জড়িয়ে তাদের মিত্র ইউক্রেনকে কতটা সামরিক সাহায্য দেয়া যায়- সেই সিদ্ধান্ত নেয়া।
ইউক্রেন সরকার অবশ্য ন্যাটো জোটের সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সমূহ বিপদ নিয়ে আদৌ চিন্তিত নয়। তারা ন্যাটোর কাছ থেকে সর্বোচ্চ সাহায্যের জন্য খোলাখুলি চাপ দিয়ে চলেছে।
ইউক্রেন এখন বলছে, পূর্বের ডনবাস প্রদেশে রাশিয়ার হামলা প্রতিহত করতে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে জরুরি ভিত্তিতে তাদের আরো জ্যাভেলিন ও এনএল ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, স্ট্রিংগার এবং স্ট্রারস্ট্রিক বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র প্রয়োজন।
এসব অস্ত্র তারা আগেও পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে পেয়েছে। কিন্তু ইউক্রেন বলছে সেগুলোর মজুদ কমে আসছে এবং জরুরি ভিত্তিতে ওই সব অস্ত্রের নতুন সরবরাহ তাদের দরকার।
এসব অস্ত্র ইউক্রেনে কমবেশি যাচ্ছে, কিন্তু ইউক্রেন এখন ট্যাংক চাইছে, সামরিক ড্রোন চাইছে এবং রাশিয়ার বিমান ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঠেকাতে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চাইছে।
কারণ, তারা বলছে তা না পেলে রাশিয়ার হামলায় তাদের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক এবং বেসামরিক স্থাপনা এবং সেইসাথে জ্বালানির মজুদ ক্রমেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু এখনো এসব ভারী আক্রমণাত্মক অস্ত্র দিতে ন্যাটো দ্বিধার মধ্যে রয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, কেন?
একটাই উত্তর ন্যাটো ভয় পাচ্ছে এসব অস্ত্র ইউক্রেনকে দিলে যুদ্ধ ইউক্রেনের বাইরে বাকি ইউরোপে ছড়িয়ে পড়বে।
পশ্চিমা দেশগুলোর সরকারগুলোর মধ্যে একটি ভয় কাজ করছে যে চাপে পড়লে রাশিয়া হয়তো স্বল্প মাত্রার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। এবং তা যদি তারা করে- তাহলে যুদ্ধ ইউক্রেনের সীমান্ত ছাড়িয়ে বাকি ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ার বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হবে।
এখন পর্যন্ত পশ্চিমা জোটগুলো ইউক্রেনকে যেসব সাহায্য দিয়েছে :
এখন পর্যন্ত ৩০টিরও বেশি দেশ ইউক্রেনকে সামরিক সাহায্য দিয়েছে। তাদের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেয়া সাহায্যের পরিমাণ ১০০ কোটি ডলারের মতো। যুক্তরাষ্ট্র একাই দিয়েছে ১৭০ কোটি ডলারের অস্ত্র-সরঞ্জাম।
এখন পর্যন্ত এসব সাহায্য গোলাবারুদ এবং ট্যাংক এবং বিমান বিধ্বংসী অস্ত্রের মধ্যে সীমিত রয়েছে। এসব পশ্চিমা অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে কাঁধে বহনযোগ্য ট্যাংক বিধ্বংসী জ্যাভলিন ক্ষেপণাস্ত্র।
ব্রিটেন তাদের তৈরি সহজে বহনযোগ্য স্টারস্ট্রিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়েছে। ন্যাটো জোটের কথা যেসব অস্ত্র ইউক্রেনকে দেয়া হচ্ছে এগুলোর সবই প্রতিরক্ষামূলক, এবং জোটের অধিকাংশ সদস্য দেশ মনে করছে ট্যাংক বা যুদ্ধ বিমানের মতো অস্ত্র যেহেতু আক্রমণাত্মক সুতরাং এগুলো দিলে রাশিয়া তাকে উসকানি হিসাবে বিবেচনা করবে।
যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকেই প্রেসিডেন্ট পুতিন বাকি বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, রাশিয়া একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ এবং তিনি তার পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভারকে প্রস্তুত রাখছেন।
তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনো এই হুমকিতে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না- কারণ রাশিয়া যে তাদের সুরক্ষিত বাঙ্কার থেকে এসব পারমাণবিক অস্ত্র বের করছে এমন কোনো আলামত এখনো তারা দেখছে না।
রাশিয়ার গৃহীত সামরিক কৌশলের নীতিতে যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ সেনাবাহিনীকে প্রথম স্বল্পমাত্রার ট্যাকটিকাল পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করার অধিকার দেয়া হয়েছে। শত্রুপক্ষ থেকে তেমন অস্ত্র ব্যবহারের জন্য রুশ সেনাবাহিনীকে অপেক্ষা করতে হবে না।
গত ৭৭ বছরে কোনো যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার হয়নি এবং রাশিয়া জানে তেমন অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাপক ভীতি রয়েছে।
ন্যাটো জোটের দ্বিধা কমছে
ন্যাটো জোটের সামরিক কৌশল যারা নির্ধারণ করেন তারা মনে করেন যদি ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো একটি টার্গেটের ওপরও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার হয়- অর্থাৎ পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে যে ‘ট্যাবু’ বা অলিখিত বোঝাপড়া রয়েছে তা যদি একবার ভেঙে যায়- তাহলে মহা-সর্বনাশ হবে। রাশিয়া এবং পশ্চিমা শক্তিগুলোর মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ লেগে যাওয়ার সত্যিকারের ঝুঁকি তৈরি হবে।
কিন্তু তারপরও ইউক্রেনে রুশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নৃশংসতার যত অভিযোগ উঠছে, ন্যাটো জোটের মধ্যে বৃহত্তর যুদ্ধের ঝুঁকি নিয়ে শঙ্কা এবং দ্বিধা ততই কমছে।
যেমন, ন্যাটো জোটের সদস্য দেশ চেক রিপাবলিক একক সিদ্ধান্তে ইউক্রেনকে ট্যাংক পাঠিয়েছে, যদিও তা সোভিয়েত আমলে তৈরি টি-৭২। স্লোভাকিয়া ইউক্রেনে এস থ্রি হানড্রেড (এস-৩০০) ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাঠাচ্ছে।
যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে এমন অস্ত্র পাঠানোর কথা হয়তো ন্যাটো জোটের কেউ চিন্তাও করেনি। এখন কেউ কেউ তেমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
যেমন, পশ্চিমা রাজনীতিক বা সামরিক বিশ্লেষক মনে করেন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কথা বলে পুতিন আসলে ব্লাফ বা ধাপ্পা দিচ্ছেন। তাদেরই একজন ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা বিষয়ক পার্লামেন্টারি স্থায়ী কমিটির সদস্য টোবিয়াস এলউড এমপি।
‘ইউক্রেন কোনো ধরনের অস্ত্র দেয়া যাবে কি যাবে না তা নিয়ে আমরা অতিমাত্রায় সাবধানতা দেখাচ্ছি,’ তিনি বলেন- ‘আমাদের আরো সাহস দেখাতে হবে। আমরা ইউক্রেনকে টিকে থাকার জন্য সরঞ্জাম দিচ্ছি, কিন্তু জেতার জন্য যা লাগবে তা দিচ্ছি না। আমাদের এই মনোভাব বদলাতে হবে।’
কীভাবে যুদ্ধ পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়তে পারে
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ঠিক কীভাবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ একটি ইউরোপব্যাপী যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। যার পরিণতিতে ন্যাটো সামরিক জোট সেই যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়তে পারে?
পশ্চিমা প্রতিরক্ষা দফতরগুলো যারা চালান তাদের মনে নিশ্চিতভাবে সম্ভাব্য কতগুলো দৃশ্যপট রয়েছে। তেমন তিনটি দৃশ্যপট দেখা যাক :
এক. বন্দর শহর ওডেসা থেকে ইউক্রেনিয়ান সেনাবাহিনী পশ্চিমা কোনো দেশের দেয়া জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে কৃষ্ণসাগরে একটি রুশ যুদ্ধ জাহাজ ডুবিয়ে দিল এবং তার ফলে প্রায় ১০০ রুশ নৌ সেনা এবং কয়েক ডজন রুশ মেরিন সেনা মারা গেলে। একটি হামলায় এত প্রাণহানি রাশিয়ার জন্য নজিরবিহীন একটি ঘটনা হবে এবং বদলা নেয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট পুতিনের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি হবে।
দুই. ন্যাটো কোনো দেশ থেকে- যেমন পোল্যান্ড বা স্লোভাকিয়া অস্ত্রের চালান ইউক্রেনে ঢোকার সময় রাশিয়া তার ওপর স্বল্প শক্তির পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ল। সেই হামলা যদি বিশেষ করে ন্যাটোর সীমান্তের ভেতর হয় এবং তাতে যদি প্রাণহানি হয়, তাহলে ন্যাটো তাদের সংবিধানের আর্টিকেল ফাইভ কার্যকরী করবে, যার অর্থ জোটের সবগুলো দেশ একসাথে কোনো একটি বা দুটি সদস্য দেশের প্রতিরক্ষায় সক্রিয় হবে।
তিন. ইউক্রেনের পূর্বে ডনবাস প্রদেশে তীব্র লড়াইয়ের সময় একটি শিল্প ইউনিটে বিষ্ফোরণ হলো যার ফলে সেখান থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস নির্গমন শুরু হলো। যদিও তেমন বিস্ফোরণ এরই মধ্যে হয়েছে, কিন্তু তার ফলে কেউ মারা যায়নি। কিন্তু তেমন বিস্ফোরণে যদি প্রচুর মানুষ মারা যায় এবং এমন প্রমাণ যদি পাওয়া যায় যে রাশিয়া ইচ্ছা করে ওই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, তাহলে ন্যাটো জোটের মধ্যে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার প্রচণ্ড চাপ তৈরি হবে।
সূত্র : বিবিসি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।