জুমবাংলা ডেস্ক : ‘এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে, তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে’। পল্লী কবি জসিম উদ্দীনের ‘কবর’ কবিতার এই চরণ দুটিকেও হার মানিয়েছেন তিনি। নাম তার শাজাহান মিয়া। সম্রাট শাজাহান তার মৃত স্ত্রী মমতাজের জন্য নির্মাণ করেছিলেন তাজমহল। কিন্তু রাজশাহীর এই শাজাহান হয়তো স্ত্রীর জন্য তাজমহল নির্মাণ করতে পারেননি; তবে হৃদয়ে স্ত্রীর প্রতি গভীর ভালোবাসার যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন তা যেন সম্রাট শাজাহানের তাজমহল নির্মাণকেও মানিয়েছে হার।
শাজাহান রাজশাহী নগরীর ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের মালদা কলোনি এলাকার বাসিন্দা। ১৯৬৯ সালে খায়রুন্নেছাকে বধূ করে ঘরে তুলেছিলেন শাজাহান মিয়া। ২০০৪ সালে হঠাৎ প্রিয়তমা স্ত্রী খায়রুন্নেছা স্ট্রোক করে মারা যান। মুহূর্তের মধ্যে ৩৫ বছরের দাম্পত্য জীবনের ইতি টেনে প্রিয়তমা স্ত্রী চলে যান না ফেরার দেশে। পরে তাকে দাফন করা হয়েছে নগরীর উপশহর এলাকার পশুহাসপাতালের পাশের গোরস্থানে। এরপর থেকেই ভালোবাসার টানে ২০ বছর থেকে স্ত্রীর কবরের পাশে সময় কাটাচ্ছেন তিনি।
সাধারণত কবরস্থানে কোনো প্রয়োজন ছাড়া মানুষ যেতে চান না। এমনিতেই একটু ভয় অনুভব করেন। কিন্তু স্ত্রীর ভালোবাসার টানে সেই করবস্থানকেই অনেকটা নিজের বাসস্থান বানিয়ে নিয়েছেন শাজাহান। পেশায় গাড়িচালক শাজাহান এক যুগ আগে সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন নিজের বাম পা। এরপরও ক্র্যাচে ভর করে ব্যাটারিচালিত নিজের ছোট্ট অটোরিকশার সাহায্যে বাড়ি থেকে কবরের পাশে যাতায়াত করেন তিনি।
নগরীর মালদা কলোনিতে নিজের বাড়িতে দেখাশোনার কেউ না থাকায় পাশেই মেয়ে কাকলীর বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করেন শাজাহান। অস্থায়ীভাবে থাকেন সেখানেই। তবে ফজরের নামাজ সেরে চলে আসেন গোরস্থানে স্ত্রীর কবরের পাশে। দুপুর পর্যন্ত সেখানে থেকে চলে যান মেয়ের বাড়িতে। দুপুরের খাবার সেরে বিকেলে আবার চলে আসেন স্ত্রীর পাশে। গভীর রাত পর্যন্ত স্ত্রীর কবরের পাশে থেকে চলে যান মালদা কলোনির সেই মেয়ের বাসায়। এভাবেই ২০ বছর থেকেই একইভাবে জীবন-ধারণ করে আসছেন শাজাহান। তিনি স্ত্রীর কবরের পাশে থেকেই যেন অন্যরকম এক প্রশান্তি অনুভব করেন। এভাবে ২৪ ঘণ্টার অধিকাংশ সময় ভ্যানের ওপর বসে কবরের পাশেই স্ত্রীর জন্য পড়েন দোয়া-দরুদ। এমনকি ভ্যানের ওপর বসেই পড়েন নামাজ। রোদ-বৃষ্টিতেও স্ত্রীর কবরের পাশে নিজের ভ্যানটি রেখে সেটির ওপর বসেই সময় অতিবাহিত করেন শাজাহান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্ত্রীর প্রতি অসীম ভালোবাসা থেকেই এমন অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। শাজাহান এবং খায়রুন্নেছার দাম্পত্য জীবন ছিল অত্যন্ত মধুর। বিয়ের পর একটি রাতও আলাদা কাটাননি তারা। স্বামীর সেবা-যত্নে কখনো কোনো ত্রুটি করেননি খায়রুন্নেছা। শাজাহানও সব সময় স্ত্রীকে ভালোবাসা ও সাংসারিক কাজে করেছেন সহযোগিতা।
সাত সন্তানের জনক শাজাহান মিয়ার সঙ্গে গত রোববার (২৩ জুন) রাতে ওই কবরস্থানে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘২০০৪ সালে স্ত্রী স্ট্রোক করে মারা যাওয়ার পরে আমি এখানেই (কবরস্থানে স্ত্রীর কবরের পাশে) থাকি। এখানে ছাড়া আমার আর অন্য কোথাও ভালো লাগে না। এখানেই ভালো লাগে। তার টানে আমাকে এখানে আসতে হয়। আমি সব সময় দোয়া করি, তিনি যেন ভালো থাকেন। আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতবাসী করেন।’
তিনি বলেন, ‘২০১২ সালে আমি সড়ক দুর্ঘটনায় বাম পা হারিয়েছি। তারপরও কষ্ট হলেও আমি নিজের ছোট্ট ভ্যানে করে আমি কবরে যাতায়াত করি। স্ত্রীর কবরের পাশে থাকতেই আমার ভালো লাগে। স্বামী জীবিত অবস্থায় স্ত্রীর মৃত্যুতে অন্যদের ক্ষেত্রে কেমন হয় জানি না। তবে আমার স্ত্রীর মৃত্যুর পর প্রতিটি দিন-রাত আমার কাছে অপূর্ণ মনে হয়। তাকে আমি ভুলতে পারি না। আমার শেষ ইচ্ছা- আমার মৃত্যুর পর যেন স্ত্রীর কবরে আমাকে শায়িত করা হয়।’
মমিনুল ইসলাম নামে ওই এলাকার এক যুবক বলেন, ‘তার বাড়ি মালদা কলোনি এলাকায়। নিজের বাড়ির পাশেই মেয়ের বাড়ি। শুধু খাওয়ার সময় বাড়িতে গিয়ে খেয়ে আসেন। বাকি পুরো সময়টাই স্ত্রীর কবরের পাশেই কাটান। ছোট থেকেই দেখে আসছি, তার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। আমি নিয়মিত এই কবরস্থানে যাতায়াত করি। এভাবে কয়েকদিন তাকে কবরের পাশে বসে থাকতে দেখে বিষয়টি জানতে চাই। তখন তিনি পুরো ঘটনা খুলে বলেন। এরপর তার প্রতি অন্যরকম ভালোবাসা অনুভব করি। মাঝেমধ্যেই গোরস্থানে এসে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলি। স্ত্রীর প্রতি তার যে কী ভালোবাসা ছিল তা উনার কর্মকাণ্ডে পরিস্ফূটিত। যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর সকল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এমন ভালোবাসার বন্ধন অটুট থাকে।’
এই এলাকার বাসিন্দা মো. রায়হান ইসলাম বলেন, ‘আমার বয়স ৪০ বছর। ২০ বছর থেকেই আসছি, উনি (শাজাহান) বেশির ভাগ সময়েই এই গোরস্থানে তার স্ত্রীর কবরের পাশেই সময় কাটান। তার স্ত্রীর প্রতি তার যে ভালোবাসা এটিই তার বহিঃপ্রকাশ। এটি সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত যে, তিনি স্ত্রীর ভালোবাসায় ২০ বছর ধরে কবরের পাশে বসে থাকেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘সম্রাট শাজাহান তার স্ত্রী মমতাজের জন্য নির্মাণ করেছিলেন তাজমহল। কিন্তু রাজশাহীর এই শাজাহান হয়তো মৃত স্ত্রীর জন্য তাজমহল নির্মাণ করতে পারেননি। খোলা আকাশের নিচে কবরস্থানেই শায়িত করেছেন প্রিয় স্ত্রীকে। আর তাই তো ২০ বছর ধরে প্রিয় স্ত্রীর কবরের পাশে বসে থেকে হৃদয়ে স্ত্রীর প্রতি গভীর ভালোবাসার যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন তা যেন সম্রাট শাজাহানের তাজমহল নির্মাণকেও হার মানিয়েছে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।