সিনেমায় ‘কুরোসাওয়া ইফেক্ট’ হচ্ছে এমন একটি অবস্থা যখন বিভিন্ন মানুষ একই ঘটনার উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন, কিন্তু সমানভাবে বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ দেয়। এর মধ্যে কোনটা যে সত্য আর কোনটা যে মিথ্যা তা বের করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এটি ‘রশোমন ইফেক্ট’ নামেও পরিচিত।
‘সাড়ে ষোলো’ ওয়েব সিরিজে পুলিশ অফিসার আলতাফ (ইমতিয়াজ বর্ষণ) যখন শ্রমিকনেতা গাফফারকে (শাহেদ আলী) বলছিলেন এনাম সাহেবের ছেলের বাঁচা-মরা কোনোটারই দরকার নেই, তখন দর্শকের সামনে একটা বিষয় চলে আসে, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা যে রাজনীতি তার সফলতা কিংবা ব্যর্থতা, এমনকি আমাদের বেঁচে থাকা কিংবা মৃত্যু কোনো কিছুই আমাদের একার উপর নির্ভর করে না।
এসবের সাথে আমাদের চারপাশের রাজনীতি, অর্থনীতি, ক্ষমতাসহ আরো অনেক কিছুরই সম্পর্ক বিদ্যমান। তেমনই এক বোঝাপড়ার গল্পকে ঘিরে একটি মৃত্যু এবং তার পরের পরিণতি নিয়েই তৈরি হয়েছে ওয়েব সিরিজ ‘সাড়ে ষোলো’। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচইয়ে এই ওয়েব সিরিজটি মুক্তি পেয়েছে গত ১৬ই আগস্ট, দুপুর ১২টায় (যাকে ‘সাড়ে ষোলো’ তারিখ বলা যায়)। প্রযোজক হিসেবে ছিলেন আলী আফজাল উজ্জ্বল।
রাজধানীর এক অভিজাত হোটেল ভায়োলেট ইন৷ সেখানটায় সবচেয়ে এক্সক্লুসিভ ফ্লোর হলো ‘সাড়ে ষোলো’ যেখানে সবচেয়ে ধনাঢ্য বা ভিআইপিরা আসেন, সময় কাটান, বিভিন্ন রকম ডিল করেন কিংবা কখনো কখনো এটি ব্যবহৃত হয় হানিট্র্যাপের জন্যও। এম্পায়ার সু ফ্যাক্টরির ভবন ধসে মারা যায় তিনশরও বেশি শ্রমিক, আহত হয় সাতশরও বেশি। সেই মামলার সর্বশেষ শুনানির আগের রাতে ভায়োলেট ইনের ‘সাড়ে ষোলো’-তে হালকা সময় কাটানোর জন্য বান্ধবী নাতাশাসহ হাজির হন কেপলার বিল্ডার্স গ্রুপের আইনজীবী আশফাক রেজা। হানিট্র্যাপে ফেলে আশফাক রেজাকে ফাঁসিয়ে পরের দিনের শুনানিতে যাওয়া আটকানোর জন্য ‘সাড়ে ষোলো’-তে হাজির হন সাংবাদিক রিনি, যার সাথে আশফাক রেজার বিরোধ রয়েছে আগ থেকেই।
রাকিব, যিনি কেপলার গ্রুপের একজন হয়েও ওই গ্রুপের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন, তিনি হাজির হন হানিট্র্যাপের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে। আর এডিসি আলতাফ হাজির হন তারই পুরনো বান্ধবী রিনির ডাকে। কিন্তু, এইসব প্লট সাজানোর মাঝেই এক পর্যায়ে নাতাশার লাশ পাওয়া যায় ১৬৫২ নম্বর রুমে, যেখানে নাতাশা আর আশফাক রেজা উঠেছিলেন। নাতাশা কীভাবে মারা গেলেন? খুন কে করল? কীভাবেই বা করল? কেন করল? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আপনাকে দেখতে হবে গোটা সিরিজটি।
আমরা সাসপেন্সের কাজে যে ধরনের ঝাঁঝালো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দেখে থাকি সেটা এই সিরিজে নেই। সাসপেন্সের কাজে এধরনের একটা রিদমিক সাউন্ড, কন্টিনিওয়াজ বিটে আগে দেখা যায়নি বাংলাদেশি সিরিজগুলোয়। কিন্তু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়াই সংলাপ সর্বস্ব কিছু দৃশ্য, তার সাথে ফলি আর নয়েজ মিলিয়ে কাজের আবেদনটা কমিয়ে দিয়েছে খানিকটা।
এমনিতেই সংলাপগুলো ক্লিশে, তার সাথে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক না থাকলে সাসপেন্সটা জমে উঠতে বেগ পেতে হয়। এছাড়াও শুরুর দৃশ্যেই নাতাশার সংলাপের সাথে ঠোঁট মেলেনি। আরো কিছু জায়গায় এমনটা দেখা গেছে। আবার দ্বিতীয় এপিসোডে আলতাফ বলছেন, “কী হইসে?” এবং সেই একই দৃশ্য তৃতীয় এপিসোডে বলার সময় তিনি বলছেন, “কী হয়েছে?”। ডাবিংয়ে এমন কিছু ভুল চোখে পড়েছে।
‘সাড়ে ষোলো‘ কতটুকু দর্শকের মন ছুঁয়ে যাবে তা এখনই বলার সময় নয়। কিছু সীমাবদ্ধতা আর অসম্পূর্ণতাকে ছাপিয়ে ইয়াছির আল হক একটা সমসাময়িক গল্পকে হাজির করাতে চেয়েছেন আমাদের সামনে, সেটাই বা কম কীসের।
‘রানা প্লাজা’ ট্র্যাজেডির বিভীষিকার শিকার মানুষগুলো, সেজান গ্রুপের কারখানায় আগুনে পোড়া মানুষগুলো কিংবা আরো আরো অসংখ্য পুঁজিপতিদের অসাবধানতায় মৃত্যুবরণ করা মানুষগুলো ‘সাড়ে ষোলো’র কারণেও যদি একবার আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে, তবে তাকে কোনোভাবেই ছোট প্রাপ্তি বলা যায় না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।