জুমবাংলা ডেস্ক : করোনা পরিস্থিতি উন্নতির পর অর্থনীতিতে চাহিদা বৃদ্ধিসহ নানামুখী প্রভাবে ব্যাংক খাতে নগদ টাকার টানাটানি চলছে। বেশি সুদেও প্রয়োজনীয় টাকা মিলছে না কলমানিতে। সংকট সামাল দিতে প্রতিদিনই বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে অনেক ব্যাংককে। বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি এ তালিকায় আছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোও। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক তাদের কাছ থেকে প্রায় সোয়া ৭ হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তা নিয়েছে। এর মধ্যে ডিসেম্বর মাসেই নিয়েছে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকারও বেশি। তারল্য সহায়তার পাশাপাশি রেপো সহায়তাও নিচ্ছে কোনো কোনো ব্যাংক।
ব্যাংক খাতে নগদ টাকার টানাটানির পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এগুলো হলো- উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে আমানতের প্রবৃদ্ধি ব্যাপক হারে কমে যাওয়া, বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের উৎসে ভাটা পড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনে এলসির দায় পরিশোধ, সরকারি ও বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের চাহিদা বৃদ্ধি। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিও আরেকটি কারণ। নগদ অর্থের সংকট দেখা দিলে
একদিনের জন্য এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে যে টাকা ধার নেয় তা কলমানি নামে পরিচিত। জানা গেছে, একদিনের ব্যবধানে গত বৃহস্পতিবার কলমানির বাজারে সুদ প্রায় ১ শতাংশ বেড়ে ৭.২৫ শতাংশে উঠেছে। স্বাভাবিক সময়ে একদিনে কলমানিতে ১ শতাংশ সুদ বৃদ্ধির নজির খুব একটা দেখা যায় না। শুধু সুদহারই নয়, ওইদিন কলমানি বাজারে লেনদেনের পরিমাণও বেড়েছে। আগের দিন ৩ হাজার ২৬২ কোটি টাকার লেনদেন হলেও গত বৃহস্পতিবার হয় ৬ হাজার ৩২৩ কোটি টাকার। মূলত গত বছরের ঈদুল ফিতরের আগে থেকে এ বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। ধারণা করা হয়েছিল, ঈদের পর হয়তো কলমানি বাজারের অস্থিরতা কমবে। কিন্তু এই অস্থিরতা না কমে উল্টো বাড়তে থাকে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। ফলে বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকেও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তারল্য ও রেপো সহায়তা নিয়ে চলতে হচ্ছে। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত এই চার ব্যাংকের মধ্যে তিনটিরই আমানতের পরিমাণ লাখ কোটি টাকারও বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে সরকারি খাতের পাঁচ ব্যাংক প্রায় ৭ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা তারল্য সহায়তা নিয়েছে। এর মধ্যে চার ব্যাংক নিয়েছে ৭ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা নিয়েছে সোনালী ব্যাংক। এ ছাড়া জনতা ব্যাংক ২ হাজার ৩৩৫ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক ২ হাজার ৫১ কোটি ও রূপালী ব্যাংক ৫৩৩ কোটি টাকা নিয়েছে। একই সময়ে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক নিয়েছে ৫৪ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ব্যাংকগুলোর তারল্য সহায়তা নেওয়ার যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, বাস্তবে তার চেয়েও অনেক বেশি ধার করেছে তারা। এর কারণ সরকারি বিভিন্ন পেমেন্টে ডলার কেনার চাপ, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি ও সরকারি সিকিউরিটিজে ব্যাংকগুলোর বিপুল পরিমাণ টাকা আটকে যাওয়া।
যদিও তারল্য সহায়তা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন সোনালী ব্যাংকের এমডি আফজাল করিম। তিনি বলেন, সোনালী ব্যাংকের কোনো তারল্য সংকট নেই। উল্টো আমরা কলমানিতে টাকা ধার দিয়ে আসছি। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য সরবরাহ করার পর তিনি বলেন, সরকারি বিভিন্ন পেমেন্টের জন্য টাকার প্রয়োজন হওয়ায় এই সহায়তা নিয়েছে সোনালী ব্যাংক। একই বিষয়ে জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের এমডির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো বক্তব্য দেননি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে ব্যাংক খাতে তারল্যে কিছুটা চাপ তৈরি হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তারল্য সহায়তা নিলেই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকটি সংকটে আছে এ কথা বলা ঠিক হবে না। এমনও হতে পারে ব্যাংকটি তারল্য সহায়তা নিয়ে তা কলমানিতে খাটাচ্ছে। তবে রেপোর মাধ্যমে কোনো ব্যাংকের টাকা ধার বেড়ে গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সংকট ফুটে ওঠার ইঙ্গিত বহন করে।’
এর আগে করোনাপরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা বৃৃদ্ধি এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। এতে করে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি এবং ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে আমদানি খরচ অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। একই কারণে রপ্তানি আয়েও প্রবৃদ্ধি হয়ে পড়ে ধীর। অন্যদিকে করোনাপরবর্তী সব কিছু খুলে যাওয়ায় হুন্ডি তৎপরতা ব্যাপকভাবে বেড়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ নিম্নমুখী হয়ে পড়ে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার আয় ও ব্যয়ে পার্থক্য বেড়ে দেশে ডলারের সংকট তৈরি হয়। বিশেষ করে গত এপ্রিল থেকে এই সংকট ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি যায়। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপে বছরের শেষদিকে আমদানি ব্যয়ে কিছুটা লাগাম টানা গেলেও ব্যাংকগুলোর ডলার সংগ্রহের উৎসে ভাটা এখনো কাটেনি। ফলে প্রতিদিনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে প্রায় ৬৫০ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর বিপরীতে বাজার থেকে প্রায় সাড়ে ৬৯ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে জমা হয়েছে। এই টাকার উল্লেখযোগ্য অংশ গেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকেই।
জানা গেছে, দেশে করোনা মহামারীর আঘাত আসার আগে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বার্ষিক আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১২.৮২ শতাংশ। সেই প্রবৃদ্ধি বাড়তে বাড়তে ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১৪.৪৭ শতাংশে ওঠে। কিন্তু এরপর থেকেই টানা কমছে আমানতের প্রবৃদ্ধি। সর্বশেষ গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত আমানতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৬.৬৮ শতাংশ। এই আমানতের প্রবৃদ্ধি কমার পেছনে রেমিট্যান্স প্রবাহের নিম্নমুখী প্রবণতাকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র আড়াই শতাংশের মতো।
অন্যদিকে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পর থেকে বেসরকারি খাতে ঋণ চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। একই সময়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন ব্যয় মেটাতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঋণ নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে বার্ষিক ঋণ প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩.৬ শতাংশ। এর বিপরীতে গত নভেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি ঋণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩.৯৯ শতাংশ। ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩২.৩ শতাংশ। এর বিপরীতে নভেম্বর পর্যন্ত বেড়েছে ২৪.৬৪ শতাংশ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।