জুমবাংলা ডেস্ক : টেকনাফের হ্নীলা মৌলভীবাজার এলাকার লবণচাষী মিজানুর রহমান প্রতি বছর ১২-১৫ কানি (৪০ শতাংশে এক কানি) জমিতে লবণ চাষ করেন। এ বছরও ১৫ কানি জমিতে লবণ চাষ করতে মাঠে নেমেছেন। তার আশঙ্কা প্রতি বছরের মতো এবারো ভরা মৌসুমে লবণ আমদানির পাঁয়তারা করছে একটি মহল। মিজানুর রহমান মনে করেন, লবণ আমদানি হলে দেশে উৎপাদিত লবণ মাঠে পড়ে থাকে। মাঝেমধ্যে মৌসুমে ঝড়-বৃষ্টি হলে হাজার হাজার টন লবণ পানিতে নষ্ট হয়ে যায়। তবুও দেশে লবণ মজুদ থাকে। তাই আমদানি করার কোনো প্রয়োজন নেই। এতে চাষীরা লবণের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন।
তার মতো হ্নীলা উলুচামরী কোনারপাড়ার চাষী জাফর আলম এবার ৬০ কানি জমিতে লবণ চাষ করছেন। তার রয়েছে ১৫ জন চাষী। তারা এরই মধ্যে চৌধুরীপাড়া, কোনাপাড়া ও রংগীখালী এলাকার মাঠে পুরোদমে কাজ করছেন। তিনি দেশীয় লবণ উৎপাদনের লাভের আশা প্রকাশ করেন।
কুতুবদিয়ার লেমশীখালী ইউনিয়নের রাহাত্তারবিল এলাকায় লবণমাঠে কথা হয় চাষী নুরুল কবিরের সঙ্গে। তিনি বলেন, গত বছরের মতো এ বছরও লবণের ন্যায্যমূল্যের আশায় মাঠে নেমেছি। অক্টোবর থেকেই দ্বীপের চাষীরা লবণ তুলছেন। দাম পেয়ে ভালো লাগছে।
এভাবে চলতি লবণ উৎপাদন মৌসুমে কক্সবাজারের চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, কক্সবাজার সদর, টেকনাফ উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় লবণ উৎপাদনের জন্য মাঠ তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। অনেক স্থানে শুরু হয়ে গিয়েছে লবণ উৎপাদন।
সাধারণত আবহাওয়া লবণ চাষের অনুকূলে থাকলে এবং উৎপাদন মৌসুমে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা গেলে চাষীরা দিনরাত শ্রম দিয়ে বিসিকের লক্ষ্যমাত্রার পূরণের চেষ্টা করেন। এবারো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন করতে পারবেন বলে আশা করছেন চাষীরা। বিসিক সূত্র জানায়, এ বছর ২৩ লাখ ৮৫ হাজার টন লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
গত মাস থেকে কুতুবদিয়া-পেকুয়াসহ কয়েকটি এলাকায় লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে অধিকাংশ প্রান্তিক চাষী হওয়ায় মহাজনের টাকায় লবণ চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন। আমন মৌসুম শেষে ধান কাটার পর লবণ উৎপাদনের মাঠ তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের অন্যতম লবণ উৎপাদনের জেলা কক্সবাজার। এ জেলার প্রায় ৪৩ হাজার চাষী পুরোদমে লবণ উৎপাদনের প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমেছেন। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে লবণ মাঠ পরিচর্যা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে লবণ উৎপাদন শুরু হবে বলে আশা করছেন চাষীরা। দেশের এক-তৃতীয়াংশ লবণের চাহিদা পূরণ করে কক্সবাজার জেলার উৎপাদিত লবণ। গত বছর নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেও চাষীরা লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি লবণ উৎপাদনে সক্ষম হন।
এদিকে লবণ মিল মালিকরা বলেন, একটি মহল প্রতি বছর সিন্ডিকেট করে বিদেশ থেকে লবণ আমদানির পাঁয়তারা করে, যা দেশের লবণ শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে থাকে। এবারো যদি নানা অজুহাতে লবণ আমদানি করা হয় তা হলে ন্যায্যমূল্যপ্রাপ্তি থেকে কৃষক বঞ্চিত হবেন। লবণচাষীদের দাবি, অবিলম্বে কক্সবাজারে স্থায়ী লবণ বোর্ড গঠনের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে মূল্য নির্ধারণ, প্রান্তিক চাষীদের সহজ শর্তে সুদমুক্ত ঋণদান ও আমদানি বন্ধ করে দেশীয় লবণ শিল্পকে রক্ষা করতে হবে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় দেশের লবণ উৎপাদন এলাকা কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী অঞ্চলে এবার ৬৫ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে। এরই মধ্যে মৌসুমের প্রথম দফায় মাঠ থেকে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে। ডিসেম্বরের প্রথমদিক থেকে প্রতিটি মোকামে পুরোদমে লবণ উৎপাদন নিশ্চিত হবে এমনটাই জানিয়েছেন বিসিক কক্সবাজারের কর্মকর্তারা।
চাষীদের আশা, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে দেশে এবার চাহিদার বিপরীতে লবণের বাম্পার উৎপাদন হবে। এরই মধ্যে লবণ উৎপাদন শুরু হওয়ায় চাষীদের মুখে ফুটেছে হাসি। তাদের আশঙ্কা এবারো যদি মৌসুমে লবণ আমদানি হয় তবে চাষীদের লোকসান গুনতে হবে।
চাষীদের অভিযোগ, বরাবরের মতো এবারো শিল্প মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের কাছে চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন কম হবে—এ ধরনের আগাম মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে একটি মহল। গত অক্টোবরে দেড় লাখ টন লবণ ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে। আরো দেড় লাখ লবণ আমদানির জন্য আবেদন করা হয়েছে।
কক্সবাজার বিসিক সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতি বছর নভেম্বরের শুরুতে চাষীরা লবণ উৎপাদনে মাঠে নামেন। তবে এ বছর এক মাস আগে অক্টোবর থেকে মাঠে নেমেছেন চাষীরা। এবার ৩৭ হাজার চাষী লবণ চাষে নিয়োজিত হয়েছেন। মাঠে উৎপাদন কাজে জড়িত থাকে আরো ৭৫ হাজার শ্রমজীবী মানুষ। পরিবহন লোড-আনলোড এবং মিল পর্যায়ে প্যাকেটিং ও বাজারজাত সেক্টর মিলিয়ে দেশীয় লবণ শিল্পে মোট পাঁচ লাখ মানুষ প্রতি বছর নিয়োজিত থাকে।
এ বছর মোট ৬৫ হাজার একর জমিতে লবণ চাষের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজার জেলার চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, কক্সবাজার সদর ও টেকনাফ উপজেলা এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলা (আংশিক এলাকা) থেকে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার টন লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিসিক।
কক্সবাজার লবণ শিল্প উন্নয়ন কার্যালয়ের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার জাফর ইকবাল ভুঁইয়া বলেন, চলতি মৌসুমে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার টন লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে চাষ শুরু হয়েছে। গত বছর জমির পরিমাণ ৬৩ হাজার ২৯১ একর থাকলেও এ বছর চাষের পরিধি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এবার আবহাওয়ার পরিবেশ বেশ ভালো।
তিনি বলেন, প্রতি বছর নভেম্বরে চাষ শুরু হলেও এবার বিভিন্ন মোকামে এক মাস আগে থেকে লবণ চাষে নেমেছেন চাষীরা। আশা করি ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি পুরো অঞ্চলে লবণ উৎপাদন পুরোদমে শুরু হবে, তাতে লবণের কোনো ধরনের ঘাটতি থাকবে না।
টেকনাফের লবণ ব্যবসায়ী হোসাইন মুহাম্মদ আনিম জানান, দুই সপ্তাহের মধ্যে এ বছরের নতুন লবণ উৎপাদন হবে। যদি বিদেশী লবণ আমদানি না হয় তাহলে আশা রাখি গত বছরের মতো এবারো ভালো দাম পাব।
বিসিকের লবণ সেলের প্রধান সরওয়ার হোসেন দাবি করেছেন, শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে লবণ আমদানির কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।