জুমবাংলা ডেস্ক : বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী লামিশা ইসলাম। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে তাঁর একটি লেখা বুয়েটের বার্ষিক ম্যাগাজিন ‘অযান্ত্রিক’-এ প্রকাশ পায়। লেখার শিরোনাম ছিল ‘অ্যা ডোর কল্ড ডেথ’ (মৃত্যু নামক একটি দরজা)।
মেয়ে কেন এই শিরোনামে লিখল– তার কোনো উত্তর জানা নেই পুলিশ কর্মকর্তা বাবা মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলামের। গত বৃহস্পতিবার পুলিশ সদরদপ্তরে তিনি বলেন, মেয়ের ওই লেখাটাই এখন সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিচ্ছে। মৃত্যু নিয়ে লামিশা যা লিখেছে, ওর সঙ্গে সেটাই ঘটবে, ভাবতেও পারিনি! লেখাটি পড়ে বুয়েটের শিক্ষার্থী ও তার সহপাঠীরাও কাঁদছে।
লামিশার লেখার শেষ অংশ ছিল এমন– আমি মা ডাক শুনতে পেলাম। ঠিক সেই বিস্তীর্ণ জঙ্গলের মাঝখানে ছিলাম দাদির বাড়ির পেছনে, যখন তার বিষণ্ন কণ্ঠস্বর উচ্চারিত হয়েছিল। এবং তার কথা শেষ হওয়ার পরপরই, মাটি কাঁপতে শুরু করে, যেন একটি দৈত্য তার পথ দিয়ে যাচ্ছে। ভেতরে সুড়ঙ্গ। কিন্তু আমি সেই প্রাণীর মুখোমুখি হওয়ার আগেই, আবার এই যন্ত্রণাদায়ক শব্দ ‘মা’র মুখোমুখি হয়েছিলাম।
পুলিশের রিক্রুটমেন্ট অ্যান্ড ক্যারিয়ার প্ল্যানিং-১-এর (আরঅ্যান্ডসিপি) অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম বলেন, ২০১৯ সালে লামিশা ও রাইশার মা স্ট্রোকের পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। দুই মেয়েকে নিয়েই চলছিল জীবন। ওরাই আমার পৃথিবী ছিল। জীবনে হয়তো আর কাউকে হারাতে হবে না, এই বিশ্বাস নিয়েই চলছিলাম। হঠাৎ সেদিন সন্ধ্যায় এক দুর্ঘটনায় হারাতে হলো বড় মেয়ে লামিশাকে। ছোট মেয়েকে তেমন টেনশন করা লাগে না। ওকে নিয়ে বেশি টেনশন করা লাগত। মেয়েটা সব সময় বিভিন্ন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকত, নিজের খেয়াল রাখারই সময় হতো না তার। আর ওকেই হারাতে হলো আমার। ঘটনার দিন লামিশার সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় রাত ১০টা ৩ মিনিটে। ওই সময় বারবার বলছিল, বাবা আমার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে, খুব কষ্ট হচ্ছে, আমি হয়তো আর বাঁচব না; ভেতরে এসে তুমি আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাও; আমাকে বাঁচাও। খুব করে অনুরোধ করে বলে, বাবা নিয়ে যাও। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারিনি।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ওই ঘটনায় ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীও রয়েছেন। তাদের মধ্যে বুয়েট শিক্ষার্থী নাহিয়ান আমিন ও লামিশা ইসলাম মারা যান।
নাসিরুল ইসলাম বলেন, ওই দিন পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠান ছিল। সারাদিন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে ছিলাম। লামিশা দুপুরে খাওয়া শেষ করে বন্ধুদের সঙ্গে বইমেলায় ঘুরতে যায়। ওই দিন পছন্দের অনেক বই কেনে। ছোট বোন রাইশাকে ভিডিও কলে নিয়ে তার পছন্দের বইও কেনে লামিশা। বই কেনার টাকা কম পড়ায় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ফোন করে ১ হাজার টাকা নেয়। ৯টার দিকে ফোন করে বলে, বাবা আমি মেলা থেকে বের হয়েছি। গাড়ি লাগবে কিনা জানতে চাইলে বলে, না, আমি রিকশায় ফিরব। মিনিট ৪৫ পর জানায়, বাবা বেইলি রোডে আছি। এর ১২ মিনিট পর ৯টা ৫৯ মিনিটে ফোন করে জানায়, বাবা আমি বেইলি রোডে কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে আটকা পড়েছি। আগুন লেগে গেছে, তুমি দ্রুত আসো, আমাকে বাঁচাও। আমি বলি, মা তুমি ঠান্ডা হও; ওপরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করো। এর দুই মিনিট পরে ফোন দিলে বলে, বাবা, আমি মনে হয় বাঁচব না। আমি জোর দিয়ে বলি, মা তুমি বাঁচবা, ওপরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করো। লামিশা বলছিল, বাবা বের হওয়ার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না। তারপর বলি, যে করেই হোক ওপরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করো। কিন্তু সে বারবার বলছিল, বাবা, আমি বাঁচব না হয়তো। ঘটনার পর দুইবার কথা হয়েছে। এর পর ফোন দিয়েছি একাধিকবার। কিন্তু মেয়ে আর রিসিভ করেনি।
কয়েকদিন থেকেই অফিস করছেন এই কর্মকর্তা। এ দিকে তাঁর ছোট মেয়ে রাইশা ইসলাম এবার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। বড় বোনের মর্মান্তিক মৃত্যুতে আগের চেয়েও চুপচাপ হয়ে গেছে। কারও সঙ্গে তেমন কথা বলছে না।
নাসিরুল ইসলাম বলেন, লামিশা রাইশাকে বলেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (ট্রিপল-ই) ভর্তির সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু বাবাকে একা রেখে এখনই দেশের বাইরে যাব। তাই ভর্তি বাতিল করেছি। কিন্তু আজকে আমাকে ছেড়ে সে একেবারেই মায়ের কাছে চলে গেল। এখন আমাকে নিয়ে কে চিন্তা করবে?
ভর্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান লামিশা। তার মধ্যে বুয়েটে ৫২২তম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (আইবিএ) ৫৩তম, রুয়েট ও টুয়েটে ৩৫তম, আইইউটিতে ১৪২তম, মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি) ২০৩তম, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুটেক্স) ১৪৭তম, ঢাবির ‘ক’ ইউনিটে ৩৬৫তম ও গুচ্ছতে ৮২তম হন।
নাসিরুল ইসলাম বলেন, সব জায়গায় ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর লামিশা আমাকে (নাসিরুল) বলে, ‘বাবা, তুমি আমার মতো সব জায়গায় ভর্তির সুযোগ পেলে কোথায় ভর্তি হতে?’ আমি বলি, ‘মা, সত্যি বলছি, আমি আইবিএতে ভর্তি হতাম।’ কিন্তু সে বলে, ‘বাবা আমি এখানে ভর্তি হবো না।’
প্রায় সময় তারা দুই বোন বাবার অফিসে আসতেন। সর্বশেষ পুলিশ সদরদপ্তরের এক কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শ করে বুয়েট মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন লামিশা। ভর্তির পর ক্লাস রিপ্রেজেনটেটিভের (সিআর) দায়িত্ব পান। নাসিরুল বলেন, প্রথম সেমিস্টারের মাত্র ছয়টি ক্লাস বাকি থাকতে মেয়েটি আকাশের তারা হয়ে গেল!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।