কোনো বস্তুর ওপর পৃথিবীর আকর্ষণ বলই ওই বস্তুর ওজন। পৃথিবীর এ আকর্ষণ বল তথা ওজন নির্ভর করে অভিকর্ষজ ত্বরণ g-এর মানের ওপর। আর ওজন মানে ভর (m) ও অভিকর্ষজ ত্বরণের (g) গুণফল। অর্থাৎ mg। কোনো বস্তুর ওপর পৃথিবীর আকর্ষণ বল না থাকলে ওই বস্তু ওজনহীন হবে।
এমন ঘটনা ঘটতে পারে কেবল অসীম দূরত্বে কিংবা ভূকেন্দ্রে, যেখানে g-এর মান ০ (কারণ, শূন্য দিয়ে ভর m-কে গুণ করলে শূন্যই হয়)। কিংবা পৃথিবী এবং চাঁদ বা অন্য কোনো গ্রহের মাঝামাঝি স্থানে, যেখানে কোনো বস্তুর ওপর পৃথিবীর আকর্ষণ বল চাঁদের বা অন্য গ্রহের আকর্ষণ বল দ্বারা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
ভূপৃষ্ঠে g-এর মান নির্দিষ্ট। ফলে কোনো ব্যক্তির ওজনও নির্দিষ্ট। তা সত্ত্বেও ভূপৃষ্ঠে কোনো ব্যক্তি ওজনের ভিন্নতা অনুভব করতে পারেন। নিজেকে ওজনহীন বলেও মনে করতে পারেন। আসলে ওজন আর ওজন অনুভব করা এক নয়। পৃথিবীতে কোনো ব্যক্তির ওপর পৃথিবীর আকর্ষণ বল থাকবেই। ফলে তার ওজনও থাকবে। কিন্তু তিনি সেই ওজন অনুভব করবেন কেবল তখনই, যখন তাঁর ওজনের সমান ও বিপরীতমুখী কোনো প্রতিক্রিয়া বল তাঁর ওপর প্রযুক্ত হবে।
আমরা যখন কোনো কিছুর ওপর দাঁড়াই, যেমন ঘরের মেঝে বা কোনো টেবিলের ওপর, তখন ওই মেঝে বা টেবিলের ওপর আমরা নিচের দিকে নিজেদের ওজনের সমান একটা বল প্রয়োগ করি। ফলে সেই মেঝে বা টেবিলও নিউটনের তৃতীয় সূত্রানুসারে আমাদের ওপর ওজনের সমান ও বিপরীতমুখী বল প্রয়োগ করে। আমরা সেই বল অনুভব করি। আরও স্পষ্ট করে বললে, আমরা ওজন অনুভব করি।
একইভাবে আমরা যখন কোনো গাছের ডাল কিংবা ঘরের বা ছাদের কার্নিশ থেকে ঝুলে থাকি, তখন সেটার ওপর নিচের দিকে নিজেদের ওজনের সমান বল প্রয়োগ করি। নিউটনের তৃতীয় সূত্রানুসারে ওটাও আমাদের ওপর আমাদের ওজনের সমান ও বিপরীতমুখী বল ওপরের দিকে প্রয়োগ করে।
ফলে আমরা ওজন অনুভব করি। এখন ওই মেঝে বা অবলম্বন যদি আমাদের ওপর ওজনের চেয়ে কম বা বেশি বল প্রয়োগ করে, তাহলে আমরাও আমাদের ওজনের চেয়ে যথাক্রমে কম বা বেশি বল অনুভব করব। অর্থাৎ, নিজেদেরকে হালকা বা ভারী বলে অনুভব করব। আর যদি আমাদের ওজনের বিপরীত দিকে কোনো বল প্রয়োগ না করে, তাহলে নিজেদেরকে মনে হবে ওজনহীন।
এ ঘটনা ঘটে যখন আমরা দুর্ঘটনায় ছাদ থেকে বা গাছ থেকে মুক্তভাবে নিচে পড়ি। ডাইভিং বোর্ড থেকে সুইমিং পুলে লাফ দেওয়াও মুক্ত ভাবে নিচে পড়া। কারণ নিচে পড়ার সময় আমরা কোনো মেঝে বা অবলম্বনের ওপর বল প্রয়োগ করি না। ফলে কোনো মেঝে বা অবলম্বন আমাদের ওপর ওজনের বিপরীত কোনো বল প্রয়োগ করে না। এর ফলে আমরা ওজনহীনতা অনুভব করি।
আবার লিফটে উঠলেও আমরা ওজনের তারতম্য অনুভব করি। স্থির লিফটে দাঁড়ালে, লিফটের মেঝের ওপর আমাদের ওজনের সমান বল mg প্রয়োগ করি আমরা। লিফটও আমাদের ওপর ওজনের সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া বল প্রয়োগ করে। ফলে আমরা নিজেদের ওজনের অস্তিত্ব টের পাই। কিন্তু লিফটি যদি ওপরের দিকে উঠতে থাকে, তখন স্থির অবস্থান থেকে ওপরের দিকে ওঠায় লিফটের ওপরের দিকে ত্বরণ a সৃষ্টি হয়।
ফলে লিফটের সাপেক্ষে আমাদের ত্বরণ হয় (g + a)। এ অতিরিক্ত ত্বরণের জন্য আমরা লিফটের ওপর নিজেদের ওজনের চেয়ে বেশি বল m (g + a) প্রয়োগ করি। তখন লিফট আমাদের ওপর বিপরীতমুখী যে প্রতিক্রিয়া বল প্রয়োগ করে, তা আমাদের ওজন mg-এর চেয়ে বেশি হয়। এ কারণে আমরা নিজেদেরকে ভারী অনুভব করি।
কিন্তু এর পর লিফট যখন সমবেগে ওপরের দিকে উঠতে থাকে, তখন তার কোনো ত্বরণ থাকে না। ফলে আমরা আর ওজনের চেয়ে অতিরিক্ত বল অনুভব করি না। কেবল ওজনই অনুভব করি। কিন্তু লিফট যখন নিচে নামতে শুরু করে, তখন স্থির অবস্থান থেকে ত্বরণ a সৃষ্টি হয় এবং লিফটের সাপেক্ষে আমাদের ত্বরণ হয় (g-a)।
এই কম ত্বরণ নিয়ে আমরা লিফটের ওপর নিজেদের ওজনের চেয়ে কম বল m (g-a) প্রয়োগ করি। ফলে লিফটও আমাদের ওপর বিপরীত দিকে ওজনের চেয়ে কম বল প্রয়োগ করে। তাই আমরা হালকা অনুভব করি। মানে, আমাদের ওজন কম বলে মনে হয়।
লিফট যদি মুক্তভাবে নিচে পড়ে, অর্থাৎ লিফটেরও যদি g ত্বরণ হয়, তবে লিফটের সাপেক্ষে আমাদের ত্বরণ হবে (g-g)। অর্থাৎ, শূন্য। ফলে আমরা লিফটের ওপর কোনো বল প্রয়োগ করব না। তখন লিফটও আমাদের ওজনের বিপরীতে নিজেদের ওপর কোনো প্রতিক্রিয়া বল প্রয়োগ করবে না।
তখন নিজেদেরকে মনে হবে ওজনহীন। অবশ্য এ অবস্থা হবে যদি লিফটের দড়ি ছিঁড়ে অভিকর্ষের প্রভাবে নিচে পড়তে থাকে। অথবা বহু ওপর থেকে কোনো লিফট যদি অভিকর্ষজ ত্বরণের সমান ত্বরণ নিয়ে নিচে নামতে থাকে। এ অবস্থায় লিফটের ছাদে একটি স্প্রিং নিক্তি ঝোলানো থাকলে, নিক্তিটির কাটা দাগ শূন্যে অবস্থান করবে। অর্থাৎ, বস্তুটির ওজন দেখাবে শূন্য।
আর যদি লিফটি g এর চেয়ে বেশি ত্বরণে (a) নিচে নামে, তাহলে আমাদের অবস্থানের সাপেক্ষে লিফটের নিচের দিকে ত্বরণ হবে (a-g)। ফলে লিফটের মেঝে আমাদের পা থেকে (a-g) ত্বরণে নিচের দিকে সরে যাবে। এ অবস্থায় আমরা শূন্যে ভাসতে থাকব। আর আমাদের মাথা কিছুক্ষণ পরেই লিফটের ছাদে গিয়ে ঠেকবে।
কোনো নভোযানের পৃথিবী বা চাঁদকে প্রদক্ষিণ করায়, আর লিফটের মুক্তভাবে নিচে পড়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। নভোচারীরা একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় বৃত্তাকার কক্ষপথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। এ বৃত্তাকার গতির জন্য নভোযানের ত্বরণ হয় পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে। আর এর মান ওই উচ্চতায় g-এর মানের সমান।
এ অবস্থায় নভোযানের দেয়ালের সাপেক্ষে নভোচারীর ত্বরণ হয় (g-g) = 0। নভোচারী যেহেতু ওই নভোযানের মেঝেতে কোনো বল প্রয়োগ করেন না, তাই তাঁর ওজনের বিপরীতে কোনো প্রতিক্রিয়া বলও অনুভব করেন না। ফলে নভোচারীরা ওজনহীনতা অনুভব করেন।
এ অবস্থায় নভোযান থেকে কোনো বস্তুকে ছেড়ে দিলে তা নিচে পড়ে না। পানি ভর্তি গ্লাস উল্টে দিলেও পানি পড়বে না। কারণ, সবকিছুই ওজনহীন মনে হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোনো কিছুই ওজনহীন নয়। কেননা ওই অবস্থানেও নভোচারীর ভর আছে। সেখানেও অভিকর্ষজ ত্বরণ g আছে।
তাই পৃথিবীর আকর্ষণ, তথা ওজন আছে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের জন্য যেমন, সেখানকার ত্বরণকে বলা হয় মাইক্রোগ্র্যাভিটি। কারণ সেখানে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান শূন্যের কাছাকাছি। সেজন্যই সেখানে পানি ভেসে থাকে, নভোচারীরা ভেসে থাকেন।
কোনো নভোযান g ত্বরণে গতিশীল হলে শুধু আপাত ওজনহীনতার উদ্ভব হয়। নভোযান বৃত্তাকার পথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ না করলে কিংবা পৃথিবীর দিকে মুক্তভাবে না পড়ে স্থির দাড়িয়ে থাকলে নভোচারীরা অবশ্যই ওজন টের পাবেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।