গ্যাস সঙ্কট আরও বেড়েছে, ফলে কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের সময় বন্ধ হয়ে যাওয়া কয়েকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র এখনও চালু করা সম্ভব হয়নি। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি গ্যাস কেনা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে সারা দেশে বেড়েছে অনিয়ন্ত্রিত লোডশেডিং। দিনে-রাতে সমান তালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় অতিষ্ঠ জনজীবন। পাশাপাশি দোকানপাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ অফিস আদালতে কাজের স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে
সেপ্টেম্বর নাগাদ পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা আশা দিলেও সেই সময়ে এসে লোড শেডিং আরও বেড়েছে। দিনে তিন থেকে চার বার কোনো কোনো এলাকায় পাঁচ থেকে ছয়বারও বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে। দুই ঘণ্টার বেশিও লোডশেডিং হচ্ছে কোথাও। বাদ যাচ্ছে না ছুটির দিনেও। কিছুদিন আগেও দৈনিক গড়ে ৩-৪ বার লোডশেডিং হলেও এখন হচ্ছে ৬-৭ বার এবং বিদ্যুৎ আসছে আগের তুলনায় বেশি সময় পরে। এতে কর্মজীবী মানুষের দৈনন্দিন কাজে চরম ব্যাঘাত ঘটছে। পাশাপাশি গরমের ফলে হাঁপিয়ে উঠতে হচ্ছে মানুষকে। এছাড়া বিদ্যুতের অভাবে রাজধানীতে পানি সঙ্কটেও ভুগতে হচ্ছে অনেককে।
বিদ্যুৎ গ্রাহকরা জানান, একদিকে বিদ্যুৎ নেই, অন্যদিকে অত্যাধিক গরমের কারনে তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যহত হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ায়ও বিঘ্ন ঘটছে। অভিভাবকরা বলছেন, অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের ফলে রাতে ঘুম না হওয়ায় দিনের বেলায় এর প্রভাব পড়ছে। পড়াশুনায় মনোযোগী হতে না পারার পাশাপাশি সময়মত স্কুলেও যেতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া নবজাতক ও রাগীরাও লোডশিডেংয়ের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন। একটু পরপর বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় ঠিক মতো ঘুমাতেও পারছেন না তারা।
আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা মমিনা ইসলাম বলেন, “বেশ গরমের মধ্যেও দিনে চার-পাঁচবার বিদ্যুৎ চলে যায়, এজন্য মাঝে মাঝে বাসায় পানিরও সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। একদিকে গরম, একই সঙ্গে মশার উপদ্রব, তার সাথে দেখা দিয়েছে পানির সঙ্কট। এইসব নিয়ে আমরা দিন পার করছি।”
দক্ষিণ গোড়ানের বাসিন্দা গৃহিনী মোর্শেদা আক্তার বলেন, “দুদিন ধরে একদম অসহ্য হয়ে যাচ্ছি লোড শেডিংয়ে। একে তো অনেক গরম, তার উপরে এত বার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে, যেটা বলার না। রাত ১২টার পরে সকাল পর্যন্ত তিন বার লোড শেডিং হল। আমরা মধ্যবিত্তরা আইপিএস বা জেনারেটর চালানোর মতো অবস্থায় নাই। চার্জার ফ্যান-লাইট যে কিনব, সব কিছুর দাম এত বেশি, সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছি। এগুলোর জন্য আলাদা বাজেট করার মতো অবস্থা নাই।”
একই অবস্থা ব্যবসায়ীদেরও। বিদ্যুৎ না থাকায় ক্রেতা সংকটে ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা। করোনা পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক নানা সংকটের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় বাগড়া দিচ্ছে লোডশেডিং। ছুটির দিনেও বিদ্যুৎ না থাকায় অন্ধকারে অলস সময় পার করছেন তারা। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, দিনে-রাতে গড়ে এক ঘণ্টা করে ৪-৫ বার হচ্ছে লোডশেডিং। পিক আওয়ারে অতিরিক্ত লোডশেডিং হওয়ায় ক্রেতারাও আসছেন না। ফলে কমে গেছে কেনাবেচাও।
সংস্লিষ্টরা বলছেন, শিল্পে গ্যাস লাগে বয়লার ও ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে। গ্যাসের সরবরাহে ঘাটতিতে বিপাকে পড়েছে শিল্প খাত। সাভার, মানিকগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানকার কারখানাগুলোতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বেশির ভাগ কারখানা ডিজেল ব্যবহার করে উৎপাদন কাজ চালাচ্ছে। এতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে।
স্প্যারো অ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) কাজী শরীফুল ইসলাম রেজা বলেন, দিনের বেলা কারখানা চালু রাখতে ব্যয়বহুল ডিজেলের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এতে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে ৭০ শতাংশ। এ অবস্থা চলতে থাকলে শিল্প উদ্যোক্তাদের পক্ষে প্রতিষ্ঠান চালানো কঠিন হয়ে পড়বে।
বিতরণকারী সংস্থাগুলো বলছে, সঙ্কটের মধ্যে অক্টোবরে গরম বেড়েছে, যা পরিস্থিতি নাজুক করে তুলছে। চাহিদা বাড়লেও উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না, ফলে কর্তৃপক্ষও অসহায়। দেশে এখন দিনে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের মতো, সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ১২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। চাহিদার তুলনায় দেড় থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি থাকায় লোড শেডিং বেড়েছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশে ১২ হাজার ১৮৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। আর রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াটের মতো ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে।
লোড শেডিং বাড়ার জন্য জ্বালানি সঙ্কটের পুরনো কারণগুলোর সঙ্গে সাম্প্রতিক জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়কেও কারণ হিসেবে দেখিয়ে একজন কর্মকর্তা বলেন, গ্রিড বিপর্যয়ের পর থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রকৌশলী, টেকনিশিয়ানরা সাবধানতার ‘চরম নীতি’ অনুসরণ করছেন। সেজন্য খুবই সতর্কতার সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালানো হচ্ছে। সে কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে যেখানে ১৮০-১৯০ মেগাওয়াট উৎপাদন হত, গ্রিড বিপর্যয়ের পর সেখানে ১২০-১৫০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে না।
বিদ্যুৎ কর্মকর্তারা বলছেন, যখন প্রচুর বিদ্যুতের প্রয়োজন, তখন বেশ কয়েকটি কারণ মিলে সঙ্কট তীব্র হয়েছে। বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনেকগুলো ইউনিট কারিগরি কারণে বন্ধ আছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ আরও কমেছে। বেশ কিছু বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র পূর্ণ উৎপাদনে যেতে পারছে না। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ৪-৫ মাসের বিল বকেয়া রয়েছে, সে কারণে তারা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে বলে জানা গেছে।
।
বিতরণকারী কর্তৃপক্ষ বলছে, বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হওয়ার মধ্যে গরমে চাহিদা বেড়েছে। গরম না কমলে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার আশা দেখছেন না তারা।
এ বিষয়ে, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান গণমাধ্যমকে বলেন, দিনে ও রাতে ৪০০ মেগাওয়াটের বেশি ঘাটতি হচ্ছে। যে কারণে কিছু এলাকায় লোডশেডিং বেশি হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের শিডিউল মানা যাচ্ছে না।
ডেসকোর এমডি কাউসার আমির আলীও বলেন, “আমরা যতটুকু বরাদ্দ পাচ্ছি, সে অনুযায়ী বিতরণ করছি। পিডিবি আমাদের যা দিচ্ছে, আমরা তাই দিচ্ছি। কিন্তু চাহিদা আরও বেশি।”
সঙ্কটের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “পিডিবি আমাদের জানিয়েছে, তারা গ্যাস পাচ্ছে না। তরল জ্বালানি প্রাপ্তিতে সমস্যা হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। উৎপাদন কম হওয়ায় আমরা চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছি না।”
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।