শামুকখোল, শামুকখেকো পাখিও বলা হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশে এর আরও কিছু আঞ্চলিক নাম রয়েছে। ইংরেজি নাম এশিয়ান ওপেন-বিল (Asian open-bill)। বৈজ্ঞানিক নাম Anastomus oscitans। শরীরের মাপ ৯৯ সেন্টিমিটার। আমি নিজে বহুবার এই পাখির মাপজোক ও ওজন রেকর্ড করেছি। পা, ঠোঁট, জিভ, ঠোঁটের মাঝামাঝি জায়গাটার যেখানে একটু ফাঁকা মতন, ওই ফাঁকটুকু ধরে মাপসহ দাঁড়ানো অবস্থায় মাটি থেকে ওর মাথা পর্যন্ত কতটুকু উঁচু, তা-ও রেকর্ড করেছি।
শামুকভাঙ্গার ঠোঁট আমার সংগ্রহে রয়েছে। মাটিতে দাঁড়ানো অবস্থায় এর উচ্চতা প্রায় এর শরীরের মাপের সমান। বড়-সড় এই পাখিটির চেহারায় একটু বোকা বোকা ভাব যেমন আছে, তেমনি আছে নিরীহ নিরীহ চাহনি। মাথার চাঁদি থেকে ঘাড়-গলা-বুক-পেট হয়ে লেজের তলা পর্যন্ত সাদা। এই পাখিটির লেজের তলার কিছুটা ও উপরিভাগের কিছুটা কালো। বুজানো অবস্থায় ডানার অধিকাংশই সাদা, শুধু প্রান্তদেশটা কালো।
তবে ঋতুভেদে এই যে সাদা রং, তা যেমন কিছুটা ঘোলাটে বা ফ্যাকাশে হয়, তেমনি কালো রংটাও হয় কিছুটা বিবর্ণ। এদের ঠোঁট লালচে-বাদামি। ঋতুভেদে এই রংও বদলায়। পা লালচে-হলুদ। লম্বা পায়ের একটিকে তুলে নিয়ে অন্যটির ওপর ভর দিয়ে এরা যেমন দিব্যি বিশ্রাম করতে পারে, তেমনি পারে দু-পা চমৎকারভাবে ভাঁজ করে আরাম করে বসতে।
শামুকভাঙ্গা মূলত জলাভূমির পাখি। তবে এদের জাতভাই মদনটাক, রঙিলা বক ও হাড়গিলার (হাড়গিলা বর্তমান বাংলাদেশে নেই বোধ হয়) মতো শুকনো জমিতেও চরে ব্যাঙ ও ফড়িংসহ পোকামাকড় খাওয়ার জন্য। এদের পেটে আমি বহুবার আস্ত ছোট ঝিনুক-শামুক, জলজোঁক ও জলসাপ দেখেছি। এদের খাদ্য তালিকায় আছে মাছ, কাঁকড়া, শামুকের ডিম, কচ্ছপের ছোট ছানা। ঝাঁকবেঁধে এরা যখন জলাভূমিতে হেঁটে খাবার খোঁজে, তখন দেখতে ভারি সুন্দর লাগে।
অন্য জাতের পাখিকে ভয় দেখাবার জন্য এরা দুই ঠোঁটে চমৎকার ‘ঠোঁটতালি’ বাজায়। শব্দ ওঠে খটখট খটখট। আনন্দ ও উত্তেজনায় এরা ঠোঁটতালি বেশি বাজায়। যথেষ্ট শক্ত ও চোখা এদের ঠোঁট, কিন্তু আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে এই ঠোঁটের ব্যবহার এরা জানেই না বলতে গেলে।
শামুকভাঙ্গারা বাসা বেশি করে ভাদ্র মাসে। জ্যৈষ্ঠ মাসেও বাসা করতে দেখেছি আমি। শামুকভাঙ্গার শেষ বাসাটি আমি দেখেছিলাম ১৯৯২ সালের শরৎকালে, সুন্দরবনের বাইরের একটা তেঁতুলগাছে। অবশ্য, ২০০৭ সালে জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলার শাখিদার পাড়া গ্রামে প্রায় ২০০ পাখির কলোনি বাসা দেখি। এক জোড়া পাখি ছিল সেই ১৯৯২ সালে। তবে এক গাছে কয়েক জোড়া পাখি মিলেও বাসা করে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আলাদা আলাদা গাছেও করে।
দুজনেই বাসা সাজায়। পুরুষটি উপকরণ বেশি আনে। মেয়েটি গাছে বসে থাকে, উপকরণ সাজায়। প্রধান উপকরণ গাছের শুকনো বা কাঁচা ডালপাতা, শুকনো খড়। বাসা বাঁধতে সময় লাগে ৭-৯ দিন। পছন্দের জায়গা খুঁজতে লাগে ২-৩ দিন। এই পাখিরা দলে থাকে, থাকে দলপতি। দলপতিই দল চালায়। শামুকভাঙ্গাদের ডিম হয় ৩টি। ২টি বা ৪টিও হয়। ডিমের রং ঘোলাটে সাদা। দুজনেই পালা করে ডিমে তা দেয়। ৩০-৩৩ দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। দুজনেই বাচ্চাদের খাওয়ায়। বাচ্চারা উড়তে শেখে ৫০-৬০ দিনে। তারপর থেকে মা-বাবার সঙ্গে উড়ে ঝাঁকে মেশে।
শীতকালে বিশাল ঝাঁকে থাকে অনেক বাচ্চা। বোকা-বোকা চাহনি আর রং দেখে বাচ্চাদের আলাদাভাবে চেনা সম্ভব। গুলির শব্দ শুনে বয়স্ক পাখিরা উড়ে গেলেও বাচ্চারা অনেকেই ঝাঁকবেঁধে বসে থাকে, বিপদ বোঝে না। এই না বোঝার কারণেই বাচ্চারা বিপদে পড়ে বেশি। ১৯৭৫ সালের বৈশাখ মাসে আমি আমার গ্রামের ওপর দিয়ে প্রায় ছহাজার শামুকভাঙ্গার একটি ঝাঁককে উড়ে যেতে দেখেছিলাম। লেখার শুরুতে যে বর্ণনা দিয়েছি, সেটা আমার গ্রামের। সাল ছিল ১৯৬৪।
শামুকভাঙ্গা বর্তমান বাংলাদেশেও বেশ আছে। সুন্দরবন, সিলেট, চট্টগ্রামসহ প্রায় সারাদেশেই দেখা যায়। তবে সংখ্যায় কমে গেছে অনেক। বড় বড় ঝাঁক নজরে পড়ে না সহজে। বাসা বাঁধার গাছের বা খাবারের অভাব নেই। আছে নিরাপত্তার অভাব। তবে গত ৩/৪ বছর যাবৎ শামুকভাঙ্গাদের সংখ্যা ও নিরাপত্তা বেশ বেড়েছে। রাজশাহী জেলার পুঠিয়া উপজেলার পচামাড়িয়া গ্রামে ও পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া উপজেলার হেতালিয়া গ্রামে বড়-সড় কলোনি আছে ওদের এই ২০০৮ সালেও।
সর্বশেষ একটি বড় ঝাঁক দেখি ফেনী জেলার ত্রিপুরা সীমান্তে। শামুকভাঙ্গা নিয়ে বর্তমানে মূল্যবান গবেষণা চালাচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াইল্ড লাইফের মেধাবী ছাত্রী পাবনার মেয়ে রেজভীন আক্তার লিপি (এটা ২০০৮ সালের কথা)। তার ফিল্ড মূলত ওই জয়পুরহাটের শাখিদার পাড়া। তার বাড়ির কাছেই একটি কলোনি গড়ে উঠছিল, কিন্তু সেটা মানুষের অত্যাচারে নষ্ট হয়ে গেছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।