সিলেটের সাদাপাথর পর্যটন এলাকার পাথর চুরির পাশাপাশি লুট হয়েছে একই উপজেলার থানা নিকটবর্তী দূরত্বের শাহ আরেফিন টিলার শত কোটি টাকার পাথরও। গেল এক বছরে সংঘবদ্ধ চক্রের ভয়াল থাবায় ক্ষতবিক্ষত রূপ এখন জায়গাটির।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, পাথর লুটপাটে নিজের ভাগ নিয়মিত আদায় করতেন কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের আলম আদনান। শুধু টাকা আদায়ই নয় পাথর লুট ও পরিবহনে কেউ বাধা সৃষ্টি করলে ‘নিজে ডিল করতেন ওসি’, এমন অভিযোগও আছে স্থানীয়দের। এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি ওসি। সময় সংবাদের অনুসন্ধান প্রতিবেদন থেকে বিস্তারিত-
সবশেষ এক বছরে অন্তত ৯টি গ্রুপ পাথর লুটপাট করে কোটিপতি বনে গেছে। এই কাজে স্থানীয় প্রশাসনের অদৃশ্য সহযোগিতা থাকায় প্রকাশ্যে ট্রাকে করে কোম্পানীগঞ্জ এলাকার সড়কগুলো দিয়ে হাজার হাজার টন অবৈধ পাথর পরিবহন হয়েছে। প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই দিনে রাতে পাথর লুট করেছে আলাদা গ্রুপগুলোর সদস্যরা। প্রতি রাতে অন্তত শতাধিক ট্রাকে করে সরিয়ে নেয়া হতো পাথর।
কোম্পানীগঞ্জের পাথর লুটকারি প্রভাবশালী চক্রের দাপট বহু আগে থেকেই ভীতি সৃষ্টি করেছে স্থানীয়দের মাঝে, প্রকাশ্যে লুটপাট হয়েছে ১৩৭ একর ভূমির শাহ আরেফিন টিলাসহ আরও একাধিক স্পট। আওয়ামী লীগের আমলে কথিত ‘পাথর লর্ড’ হিসেবে মানুষ ভয় পেতো শামিম বাহিনীকে, গুঞ্জন রয়েছে শামীম বাহিনীর সাথে বিরোধ মানেই নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া, তাই কয়েকটি ঘটনার পর এলাকার ত্রাস হিসেবে শামীম বাহিনীকে ভয় পেতেন সাধারণ মানুষ, তাই পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে প্রকাশ্যে পাথর উত্তোলন যেন ছিল মহোৎসব। ২০০৯ সালে পরিবেশ অধিদফতরের একটি প্রতিবেদনে কোম্পানীগঞ্জের এই শাহ আরেফিন টিলাকে ‘মরা কঙ্কাল’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, এক সময়ে আওয়ামী লীগের শামীম বাহিনী, তারপর গেলো এক বছরে মিলে মিশে অন্তত আরও ৯টি আলাদা গ্রুপের নেতৃত্বে মাটি খুঁড়ে লুট হয় কোটি কোটি ঘনফুট পাথর। এই চক্রে আলাদা আলাদা গ্রুপের নেতৃত্ব দেন বসর কোম্পানি, ইয়াকুব, মনির, ফয়জুল, সেবুল, বাবুল, ইব্রাহীমসহ ৯ জন, তবে সংঘবদ্ধ এই চক্রের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পান এলাকাবাসী।
সাদাপাথর কাণ্ডের পর অভিযানের ভয়
প্রশাসনের নাকের ডগায় বছরের পর বছর ধরে চলা এই পাথর উত্তোলন ও পরিবহনের কর্মকাণ্ড গেলো ৫ দিন ধরে বন্ধ রেখেছে শাহ আরেফিন টিলার পাথরখেকো চক্রটি। টিলা এলাকার ধ্বংসস্তূপে এখন কারো দেখা না মিললেও কিছু মেশিন পড়ে আছে, বাকিগুলো অভিযানের ভয়ে সরিয়ে নিয়েছে চক্রের সদস্যরা, তবে দূর থেকে জায়গাটিতে নজরদারি রেখেছে চক্রটি।
কথা বলতে অজানা ভয়
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, ‘আগে আওয়ামী লীগের শামিম ভাই ছিলেন, উনি এতো ক্ষমতাবান ছিলেন যে, কেউ নিউজ করা তো দূরে থাক, শাহ আরেফিন টিলার আশপাশে ঢুকতে পারেনি কোনো সাংবাদিক। একবার এক টেলিভিশনের গাড়ি ভেঙে সাংবাদিকদের এমন মাইর দিয়েছিল, গাড়িতে মেয়ে সাংবাদিকরেও পিটাইছে, শামিম ভাই আওয়ামী লীগের সময়ে ছিল, এখন আরও ৮-৯ জনের নেতৃত্বে পাথর উঠে, এরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোক।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাহ আরেফিন টিলা নিকটবর্তী গ্রামের আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘থানার ওসি নিজেই ডিল করে দিতেন, কেউ পাথর তোলা ও পরিবহনে ডিসটার্ব করলে ওসিই ম্যানেজ করতেন। ওসি ভালো টাকা কামিয়েছেন, উনি সবাইকেই সুবিধা করে দিয়েছেন পাথর লুটে, উনার দরকার শুধু টাকা, তাই মিলে মিশে লুটপাটে তিনি সবাইকেই সহযোগিতা করতেন, এই ব্যাপারে তিনি অনেক আন্তরিক।’
সবাই পলাতক
সরকারের পট পরিবর্তনের পর প্রভাবশালী শামীম বাহিনী এখন লোকচক্ষুর আড়ালে, তবে গেল এক বছরে এসব লুটপাটে যারা সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে তাদের কেউই এখন এলাকায় নেই।
যা বললেন ওসি ও বিভাগীয় কমিশনার
তবে পাথর লুটে টাকা লেনদেনের অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি কোম্পানিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের আলম আদনান, সময় সংবাদের ক্যামেরা দেখে তিনি অনেকটা ফেরারি আসামির মতোই যেনো পালাতে থাকেন, এক পর্যায়ে থানা এলাকায় প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এসব ব্যাপারে এসপি মিডিয়া জানেন, তিনিই সব বলবেন।’
বুধবার (২০ আগস্ট) কোম্পানীগঞ্জ পরিদর্শনে গিয়ে লুটপাটের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা উন নবী।
তিনি একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, আগে অভিযান চালাতে নানা সীমাবদ্ধতা ছিল, তবে এখন যেহেতু সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে, প্রশাসন নিশ্চয়ই সব খতিয়ে দেখবে। যারা দোষি তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।
পর্যটন এলাকার বাইরে থানার কাছাকাছি এই টিলা থেকে প্রতি রাতে শতাধিক ট্রাকে করে সরিয়ে নেয়া হতো পাথর। এখনো এলাকাজুড়ে স্তূপ করে রাখা হয়েছে অবৈধ উপায়ে উত্তোলন করা পাথর।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।