কেন আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে জ্যোতির্বিদ্যা পড়ানো হয় না? কেননা, ইতিহাসে সব সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদ ও নক্ষত্রের অবস্থান দেখে মানুষ ফসল বুনেছে, নৌকা চালিয়েছে ও পরবর্তী প্রজন্মকে সামনের দিকে এগিয়ে দিয়েছে। তাহলে জ্যোতির্বিদ্যাচর্চায় এত অবহেলা কেন? আমার চারপাশে যাঁরা আছেন, তাঁদের বেশির ভাগের কথা শুনে মনে হয়, জ্যোতির্বিজ্ঞান মানে বিশাল অবকাঠামো, বড় দুরবিন; নানা রকম বিশালতাসম্পন্ন প্রস্তুতি, অনেক খরচের ব্যাপার। তাহলে পর্যবেক্ষণ জ্যোতির্বিদ টাইকো ব্রাহে কীভাবে কয়েক যুগ ধরে খালি চোখে কাজ করে গেছেন? আর তা দিয়ে জোহানস কেপলার তো গ্রহগতিবিদ্যা আবিষ্কারের পথে এগিয়েছেন!
আকাশ আসলে বিশাল এক পঞ্জিকা। ধৈর্য, সামর্থ্য ও নথিভুক্ত তথ্য রক্ষার ক্ষমতাসম্পন্ন যে কারও কাছেই তা সহজলভ্য ও পাঠযোগ্য। আর এর মধ্য দিয়ে শুরু হতে পারে স্কুলে জ্যোতির্বিদ্যাচর্চা। প্রাচীনকালে আকাশের পঞ্জিকা সঠিকভাবে পড়ার সামর্থ্যেই নিহিত ছিল জীবন ও মৃত্যুর বিষয়টি। নতুন চাঁদের পর অর্ধচন্দ্রের পুনঃ উদয়; পূর্ণগ্রহণের পর সূর্যের আবার ফিরে আসা; রাতে এর ঝঞ্ঝাপূর্ণ অনুপস্থিতির পর সকালে উদয় লক্ষ করে পৃথিবীময় মানুষেরা। এই প্রতিভাস আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে মৃত্যুকে অতিক্রমের সম্ভাবনার কথা বলেছিল।
যুগের পর যুগ অতিক্রমের সঙ্গে মানুষেরা তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়। আরও নিখুঁতভাবে সূর্য, চাঁদ ও নক্ষত্রের অবস্থান সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। ভবিষ্যদ্বাণী করতে শিখি উপযুক্ত শিকারের সময়, বীজ বপন ও ফসল কাটার সময়, গোত্র বা সম্প্রদায়গুলোকে একত্র করার সময় কোনগুলো। পরিমাপ সূক্ষ্মতার উন্নতি আমাদের উপাত্ত বা নথিপত্র রক্ষায় সহায়তা করে। অতএব পর্যবেক্ষণ ও গণিতশাস্ত্র এবং লেখার বিকাশকে উত্সাহিত করতে জ্যোতির্বিজ্ঞান ভূমিকা রেখেছিল।
তার মানে দাঁড়াচ্ছে, আমাদের টিকে থাকার স্বার্থে খালি চোখে আকাশ পর্যবেক্ষণ ছিল খুব জরুরি। মাঝিদের, জেলেদের, কৃষকদেরও প্রতি পদক্ষেপে প্রয়োজন হয়েছে আকাশের মেজাজ-মর্জি বোঝা। তাহলে আজ যে শিশুরা বড় হচ্ছে, তাদের আকাশ চেনানো হচ্ছে না কেন? শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ হিসেবে বিষয়টি গ্রাহ্য করছি না কেন আমরা?
আবার শিল্পকলা, সংগীতের মতো আকাশ দেখাকে বড়জোর আরেকটি এক্সট্রা কারিকুলার বা সহপাঠ কার্যক্রম হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে কেন এগোচ্ছি? অথচ ইতিহাসে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষায় মৌলিক হাতিয়ার হিসেবে এগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য করা হয়েছে, তার বহু সাক্ষ্য–প্রমাণ রয়েছে। এগুলোই সহনশীলতা, নমনীয়তা, মানবিকতার প্রসার ঘটাত। তাহলে শিক্ষায় এগুলো আবশ্যিক বিষয় হিসেবে যুক্ত হলো না কেন? তাহলে কী শিখছে শিক্ষায় আমাদের দেশে, এই পৃথিবীতে? শুধুই প্রফিট অ্যান্ড লস বা লাভ-ক্ষতি, এস্টাবলিশমেন্ট, ব্যবসার ঘুঁটিতে পরিণত হওয়া?
এ কারণে সমাজে অস্থিরতা বেড়ে চলেছে। অথচ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চায় জোগাচ্ছে উদ্দীপনা। যুক্তরাষ্ট্রের পতাকায় রয়েছে ৫০টি তারা, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইসরায়েলের প্রতিটির ১টি করে; মিয়ানমারের ১৪টি; গ্রানাডা ও ভেনিজুয়েলার ৭টি; চীনের ৫টি; ইরাকের ৩টি; জাপান, উরুগুয়ে, মালয়, বাংলাদেশ, তাইওয়েনের সূর্য; ব্রাজিলের ১টি মহাজাগতিক গোলক; অস্ট্রেলিয়া, পশ্চিম সামোয়া, নিউজিল্যান্ড ও পাপুয়া নিউগিনির পতকায় সাউদার্ন ক্রসের জ্যোতিষ্কপুঞ্জ; কম্বোডিয়ার অ্যাংকর ভ্যাট—জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক মানমন্দির; ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও মঙ্গোলিয়ার মহাজাগতিক প্রতীকগুলো।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আকাশ পর্যবেক্ষণে টেলিস্কোপ রাখে না কেন? অনেক কিছুর চেয়ে টেলিস্কোপের দাম কম। এটা বিশেষ কোনো যন্ত্র নয়, ম্যাগনিফাইং গ্লাসের মতো, অনেকটা মাইক্রোস্কোপের মতো, অনেকটা ক্যামেরার মতো।
ডজনকে ডজন ক্লাস যেখানে কিছু করতে পারে না, সেখানে একটা টেলিস্কোপ শিক্ষার্থীদের মনে কৌতূহল জাগিয়ে তুলতে পারে, অদ্ভুত স্বপ্নের ঘোর তৈরি করতে পারে। এ রকম অনেক অভিজ্ঞতা আমার নিজেরই রয়েছে। প্রতিটা স্কুলে একটা মাইক্রোস্কোপ ও ম্যাগনিফাইং গ্লাসের পাশাপাশি একটা টেলিস্কোপ তো থাকতেই পারে।
আমরা যদি পদ্মা-মেঘনার সংগমস্থলের মধ্য দিয়ে যাই, আগুনঝরা নদীর তীর ধরে হেঁটে চলি, তাহলে বয়ে যাওয়া যে বাতাসের শব্দ শুনি; মৃত তিমিদের ভেসে আসা হিমছড়ির বেলাভূমিতে দাঁড়ালেও সে শব্দ শুনতে পাই। পৃথিবীর গভীর গিরিখাতগুলোর মধ্য দিয়ে বাতাসের সে হাহাকারের, কশাঘাতের শব্দ স্মরণ করিয়ে দেয় ৪০ হাজার প্রজন্মের নারী-পুরুষের চিন্তাপ্রবাহের ধারায় আমরা বর্তমান, আমাদের সভ্যতা সেই পূর্বতন প্রজন্মগুলোর ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে।
অথচ তাঁদের সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। তাঁদের সম্পর্কে জানা এবং সেসব অভিজ্ঞতার আলোয় ভবিষ্যতের মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়াই হলো শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। এ ধারা তৈরি করলে আমাদের পরের প্রজন্মের কাছে হয়তো পৌঁছে যাবে আমাদের কথাগুলোও।
সেই প্রাচীনকাল থেকে সবাই আকাশেই মুক্তি খোঁজে, যাকে আমরা মহাজাগতিক ঐক্য বলতে পারি। আসুন, এই ঐক্যকে কেন্দ্র করে আমরা আবর্তিত হই, নিজেদের দৃষ্টিকে শিকড়ের দিকে ধাবিত করি। তাহলেই আমরা সহনশীল হতে পারব, ভবিষ্যতের মুখোমুখি হতে পারব মানবিকতা নিয়ে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।