আশরাফুল মামুন, মালয়েশিয়া: অভাবের কারণে বাড়ি ছাড়া ঠাকুরগাঁওয়ের মিজান এখন মালয়েশিয়ায় প্রথম শ্রেণির শিল্পপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। গড়ে তুলেছেন একাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান। মিজান গ্র্যান্ড ইন্টার ট্রেডার্স নামে বৃহৎ গ্রুপ প্রতিষ্ঠান। তার প্রতিষ্ঠানে এখন হাজার হাজার কর্মী কাজ করছেন। অর্জন করেছেন দেশটির সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দাতো উপাধি।
১৯৯৬ মালয়েশিয়ায় নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে যাত্রা শুরু করে নিজের মেধা ও পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে এখন নিজের প্রতিষ্ঠানে সেখানকার লোকদেরই কর্মী হিসেবে কাজ করাচ্ছেন শিল্পপতি মিজান। তার বিভিন্ন প্রকল্পে প্রায় শতকোটি টাকার কাজ চলছে।
মালয়েশিয়া সরকার মিজানের সাথে চুক্তি করে একের পর এক প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছে। সর্বশেষ মিজান গ্র্যান্ড ইন্টার ট্রেডার্সের অধীনে কেলান্টন কোতাবারু প্রদেশের সিভিল ডিফেন্স সার্ভিস (এপিএম) হেডকোয়ার্টার্স নির্মাণ কাজের উদ্ভোদন করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুবের কার্যালয়ের সিনিয়র মন্ত্রী দাতু আবদূল লতিফ বিন আহমদ।
এই প্রজেক্টটি বাস্তবায়নে সরকারের সাথে মিজান গ্র্যান্ড ইন্টার ট্রেডার্সের সরাসরি চুক্তি হয় ১২৫ কোটি টাকার। এরকম সারাদেশে সরকারের পাঁচটি মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নে মিজানের প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রায় ৫০০ কোটিরও বেশি টাকার চুক্তি করেছে দেশটির সরকার। চুক্তিগুলো কোনও মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি মিজান গ্র্যান্ড ইন্টার ট্রেডার্সের সাথে করা হয়েছে যা মালয়েশিয়ায় বিরল।
সিভিল ডিফেন্স নির্মাণ কাজ নিজ হাতে ইস্কাভেটর চালিয়ে উদ্ভোদন করার সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সময়ের সেরা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি মিজান গ্র্যান্ড ইন্টার ট্রেডার্সকে দায়িত্ব দিয়েছি। আমরা এমন এক সেরা কোম্পানিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়েছি যেটি ৩ বছর মেয়াদের কাজ মাত্র ২ বছরেই শেষ করতে সক্ষম।’
তিনি আরও বলেন, মিজান গ্র্যান্ড ইন্টার ট্রেডার্স এই প্রদেশসহ সারাদেশে দক্ষতার সাথে কাজ করে সুনাম অর্জন করেছে।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি মানেই শ্রমিক হিসেবে যাওয়া অথবা স্টুডেন্ট ভিসায় গিয়ে শিক্ষা অর্জন করা। দেশটিতে প্রায় কম বেশি ১০ লাখ বাংলাদেশি অবস্থান করছেন। মাই সেকেন্ড হোমের ভিসায় হাজার তিনেক অবস্থান করছেন। কিন্তু মিজান একজন অভিবাসী নির্মাণ শ্রমিক থেকে দেশটিতে শিল্পপতি বনে যাওয়ার কাহিনী ১০ লাখ প্রবাসীর কাছে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। পাশাপাশি তার অধীনে কাজ করছে প্রায় ২ হাজার বাংলাদেশি। তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন শতাধিক মালয়েশিয়ান নাগরিকও।
মূলতঃ দাতো মিজান নির্মাণ শিল্পে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিপ্লব ঘঠিয়েছেন। মজার বিষয় হলো শত কোটি টাকার শতাধিক ইস্কাভেটর, টাওয়ার ক্রেন, পেলোডার, লরি, ড্রাম ট্রাক ব্যবহার করে কম সময়ে মানুষের পরিশ্রম কমিয়ে স্বয়ংক্রিয় কাজের মাধ্যমে রাতারাতি সুউচ্চ অট্টালিকা তৈরী করে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন। এতে করে সময় অর্থ দুটোই বাঁচে।
দাতু মিজানের আকাশ ছোঁয়া সাফল্যের রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া গেছে। গাধার মত খাটুনি, সততার সাথে শ্রমিকের বেতন ভাতা পরিশোধ, ভিসা পারমিট করার দায়িত্ব নিজ হাতে হ্যান্ডলিং করা, কৌশলী এবং মধুর ব্যবহার করে কাজ আদায় করে নেওয়া, শ্রমিকের বিপদ আপদে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে পাশে থাকা-এমন একাধিক শ্রমিক বান্ধব কর্মকান্ডের কারণে সাফল্যের চূড়ায় উঠতে পেরেছেন তিনি।
মালয়েশিয়ায় অসংখ্য কনস্ট্রাকশন কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে শ্রমিক নির্যাতনসহ সঠিক সময় বেতন না দেওয়া এবং তাদের ন্যায়সংগত সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। শ্রমিকরা বাধ্য হয় কাজ ছেড়ে যেতে। কিন্তু দাতো মিজানের কোম্পানিতে যোগদান করলে শ্রমিকরা কখনও কাজ ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তাও করেন না।
পাবনা থেকে আসা কর্মী মোঃ হারুন মিয়া বলেন, ‘২৬ বছর আগে দাতোর প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়ে আজ আমি মালয়েশিয়ার নাগরিক। এখানে বিয়ে করে বাড়ি গাড়ি সংসার করছি। এসব সম্ভব হয়েছে দাতো মিজানের কারণে।’
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দাতো মিজান একজন শিল্পপতি হয়েও শ্রমিকদের সাথে বসে ভাত খাচ্ছেন। শ্রমিকদের সাথে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে শ্রমিকের ঘামের গন্ধমাখা বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ে রাত কাটিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে মালিক শ্রমিকের মধ্যে বিদ্যমান দূরত্ব কমিয়ে উভয়ে লাভবান হচ্ছেন।
শুন্য থেকে শিল্পপতি হওয়ার মূলমন্ত্র কি জানতে চাইলে দাতো মিজানের জুমবাংলাকে বলেন, ‘এটা খুবই সহজ এবং সুলভ। আমার কাছে কোনও যাদুমন্ত্র নেই। আপনি যে কাজই করেন না কেন কঠোর পরিশ্রম করতেই হবে। কেউ মূল্যায়ন করুক বা না করুক সেটা কোন বিষয় না, কাজে ফাঁকি বা প্রতারণা করা চলবে না। সব সময় মাথায় রাখুন বৈধ পন্থায় আপনাকে আরও বড় হতেই হবে। অর্পিত দায়িত্ব পালনে অধীনস্থদের প্রতি অন্যায় আচরণ, বেতন মেরে দেওয়া ও তাদের মনে কষ্ট দিয়ে আপনি কখনোই সামনে অগ্রসর হতে পারবেন না। কারণ এটা ভয়ংকর অভিশাপ। নানা কৌশলে শ্রমিকদের খুশি রাখতে পারলে আপনার কোম্পানির অগ্রগতি একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না।’
শিল্পপতি মিজান বলেন, ‘জীবনে অনেক কষ্ট করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। এ পর্যন্ত আসার জন্য কারও কোনো সহযোগিতা পাইনি। নিজের চেষ্টায় এসেছি। বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি। এবার দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে চাই। রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা পেলে কিছু করতে পারব। অনেক বাংলাদেশি আমার প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। আরও প্রায় দুই হাজার লোক বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসব। অভাবে বাড়ি ছেড়েছিলাম। সেজন্য নিজেকে প্রতিষ্ঠিত না করা পর্যন্ত পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। পরিশ্রম কখনও বিফলে যায় না। তার উদাহরণ আমি নিজে।’
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার হরিহরপুরের সরকারপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ কারির উদ্দিন ও জলেখা বেগমের ছেলে দাতো মোহাম্মদ মিজান। পাঁচ ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে মিজান পঞ্চম। এই বৃহৎ পরিবারটি বেশ অভাবে ভুগছিল। অভাব অনটনের কারণে শৈশবেই কাজের সন্ধানে স্কুল ছাড়তে হয়েছে তাকে।
১৯৯০ সালে পাশের গ্রামে একটি বাড়িতে কাজ করার সময় মালিকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ঢাকায় চলে যান মিজান। পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না তার। ঢাকায় তিনি বিভিন্ন স্থানে কাজ শেষে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। সেখানে থেকেও হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান। মাঝে কেটে যায় ১৭টি বছর। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ ছিল না। তিনি হয়ত আর বেঁচে নেই, এমন খবর পরিবারসহ তার এলাকার মানুষের মধ্যে ছিল।
হঠাৎ ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার দুই যুবক খুঁজতে খুঁজতে এসে হাজির হন মিজানের গ্রামের বাড়িতে। মিজানের বাবার ঘরবাড়ি দেখে ওই দুই যুবক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। পরে মিজানের ছবি দেখে থমকে যান তারা। তাদের মাধ্যমে পরিবার জানতে পারে মিজান মালয়েশিয়াতে প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি। তার অধীনে কাজ করছেন দেশি-বিদেশি অসংখ্যা লোক।
ওই দুই যুবক মালয়েশিয়াতে ফিরে মিজানকে জানান তার পরিবারের কথা। বাবা-মা, ভাই-বোনদের আর ভুলে থাকতে পারেননি মিজান। সীদ্ধান্ত নেন দেশে আসার। ২০১৪ সালে হেলিকপ্টারে করে মালয়েশিয়ান স্ত্রীসহ ঠাকুরগাঁও সুগার মিল স্কুল মাঠে এসে হাজির হন মিজান। তার আসার খবর ছড়িয়ে পরে এলাকায়। হাজার হাজার মানুষ তাকে এক নজর দেখার জন্য ছুটে আসে। ২৪ বছর পরে বাড়িতে ফেরায় পরিবারে আনন্দের বন্যা লাগে।
মালয়েশিয়াতে ফিরে ২০১৮ সালে আবারও বাড়িতে আসেন মালয়েশিয়ার শিল্পপতি মিজান। ইতোমধ্যে ভাইদের জন্য আলীশান বাড়ি করে দিয়েছেন। এলাকায় মসজিদ, মাদ্রাসা, ঈদগাহে ও দুস্থদের দান করে ইতোমধ্যে বেশ গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন।
মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা বলেন, তার কোম্পানিতে কর্মসংস্থানের সুযোগের ফলে অনেক পরিবারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। তিনি বাংলাদেশের বিষয়ে খুবই আন্তরিক। শ্রমিকদের সুখে দুঃখে পাশে থাকেন তিনি। এভাবেই সবার কাছে খুব প্রিয় হয়ে উঠেছেন তিনি। তার একটাই স্বপ্ন বাংলাদেশে মানুষের জন্য কিছু করে যাওয়া।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।