শীতকালে সাধারণত ব্যাঙ দেখা যায় না। কখনো প্রশ্ন জেগেছে, কেন শীতকালে ব্যাঙ দেখি না বা এদের ডাক শুনি না? বর্ষায় প্রচুর ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ডাক শোনা যায়, অন্য ঋতুতে তা শোনা যায় না। তখন এরা কোথায় চলে যায়? বিশেষ করে, শীতকালে কোথায় থাকে ব্যাঙ?
এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে ব্যাঙ সম্পর্কে ছোট্ট করে একটু জানা যাক। মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে ব্যাঙ অন্যতম। এদের জীবনচক্র পরিচালনার জন্য মাটি ও পানি—দুটোই প্রয়োজন। কারণ, এরা উভচর প্রাণী। পৃথিবীর মোটামুটি সব অঞ্চলে এদের বাস। জলাশয়, নদী, পুকুর, জলাভূমি, বনজঙ্গল, ধানক্ষেত ও পানির নিকটবর্তী যেকোনো জায়গায় বাস করে।
তবে শীতকালে ঠান্ডা আবহাওয়ায় ব্যাঙের জীবনযাত্রায় বড় পরিবর্তন আসে। উষ্ণ রক্তের প্রাণী না হওয়ায় এদের দেহের তাপমাত্রা নির্ভর করে পরিবেশের ওপর। স্বাভাবিকভাবে তাই শীতকালে ব্যাঙের দেহের তাপমাত্রা অনেক কমে যাওয়ার কথা। তখন তাদের বাঁচা কষ্টকর হয়ে পড়ত। সে জন্য শীতকালে বেঁচে থাকতে ব্যাঙ বিশেষ অভিযোজনের পথ বেছে নেয়। এই বিশেষ পদ্ধতিকে বলে শীতনিদ্রা বা হাইবারনেশন।
শীতকালে ব্যাঙ এমন জায়গায় চলে যায়, যেখানে ঠান্ডা থেকে রক্ষা পেতে পারে। পাশাপাশি এ সময় ব্যাঙ দেহের কার্যকলাপ কমিয়ে জীবনধারণ করে। যেসব ব্যাঙ বেশির ভাগ সময় পানিতে থাকে; তারা পুকুর, নদী, এবং জলাশয়ের নিচের নরম কাদামাটির স্তরে ঢুকে পড়ে। শীতকালে পুকুরের এই স্তরে পানি তেমন জমে না। ফলে ব্যাঙ সেখানে নিরাপদ ঘুমায়। এই ঘুমের নামই শীতনিদ্রা। জলজ ব্যাঙ শীতনিদ্রার সময় ত্বকের মাধ্যমে অক্সিজেন গ্রহণ করে। মাটি বা পানির নিচে থাকলেও এভাবে তারা পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায়। কটকটি ব্যাঙ এভাবে শীতনিদ্রা যাপন করে।
একইভাবে স্থলজ ব্যাঙগুলো বন, গাছের গুঁড়ি, পাথরের ফাঁকে বা মাটির ভেতরে গর্ত খুঁড়ে লুকিয়ে থাকে। মানে ঘুমায়। এসব জায়গায় এরা তীব্র ঠান্ডা থেকে রক্ষা পায়। স্থলজ ব্যাঙ শীতনিদ্রায় থাকা অবস্থায় খুব কম অক্সিজেন গ্রহণ করে, কারণ এদের শরীরের কার্যকলাপ হয় অত্যন্ত কম। প্রায় হয় না বললেই চলে। কুনোব্যাঙ এক জাতের স্থলজ ব্যাঙ।
প্রশ্ন হলো, ব্যাঙ কেন শীতনিদ্রায় যায়? যেহেতু শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণী, তাই ব্যাঙের শরীরের তাপমাত্রা পরিবেশের তাপমাত্রার সঙ্গে ওঠানামা করে। প্রচণ্ড ঠান্ডা আবহাওয়া ব্যাঙের জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে। শীতনিদ্রা এদের এই প্রতিকূলতা থেকে বাঁচায়। শীতকালে ঠান্ডা আবহাওয়ায় এদের শরীরের কার্যকলাপ কমে যায় এবং খাদ্য খোঁজা কঠিন হয়ে পড়ে। তা ছাড়া শীতের সময় পোকামাকড়ের পরিমাণও কমে যায়।
অন্যান্য পোকামাকড়ও শীতের জন্য বেরোতে চায় না সেভাবে। আর ব্যাঙের প্রধান খাদ্যই এই পোকামাকড়। তাই এ সময় শক্তি সঞ্চয় করে টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায় শীতনিদ্রায় যাওয়া। ব্যাঙ শীতনিদ্রায় গেলে শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃদস্পন্দন এবং বিপাকীয় কার্যকলাপ অনেক ধীর হয়ে আসে। ফলে শক্তি খরচ হয় কম। ব্যাঙের শরীরে সঞ্চিত এই শক্তি দীর্ঘদিন এদের টিকিয়ে রাখে।
ব্যাঙের শীতনিদ্রা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। বিভিন্ন প্রায়োগিক গবেষণায় মডেল প্রাণী হিসেবে ল্যাবে ব্যবহার করা হয়েছে ব্যাঙ। শীতনিদ্রার সময় ব্যাঙ রক্তে স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে ১০০ গুণ বেশি গ্লুকোজ ধরে রাখতে পারে। মানুষের রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে গেলে ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। ব্যাঙ কীভাবে বেশি মাত্রার গ্লুকোজ সংরক্ষণ করে বা সহ্য করে, তা বের করার মাধ্যমে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের রক্তে গ্লুকোজের ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে।
এ ছাড়া শরীরের কোনো অঙ্গের ক্ষতি না করেই ব্যাঙের শীত সহ্য করার ক্ষমতা গবেষকদের সাহায্য করতে পারে। কীভাবে বিভিন্ন ধরনের মানব অঙ্গের প্রতিস্থাপন কোনোরকম ক্ষতি ছাড়াই করা সম্ভব, তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। এভাবে দাতা থেকে কোনো অঙ্গ অপসারণ করে দীর্ঘসময় সংরক্ষণ করাও সম্ভব হবে।
ব্যাঙের শরীর শীতনিদ্রার সময় রক্ত সঞ্চালন বন্ধ বা কমিয়ে রাখে। আর রক্ত জমাট বাঁধা বা কোনো ক্ষতি ছাড়াই কয়েক মাস পরে রক্ত সঞ্চালন আবার স্বাভাবিকও হয়। শীতনিদ্রার সময়ে ব্যাঙের রক্ত সঞ্চালনের শারীরতত্ত্ব বোঝার মাধ্যমে বিভিন্ন সার্জারির সময়ে মানুষের রক্তপ্রবাহ কমে গেলেও পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াও জানা সম্ভব।
শীতনিদ্রায় ব্যাঙের টিকে থাকা প্রকৃতির এক অসাধারণ ব্যবস্থা। প্রতিকূল পরিবেশেও এ ব্যবস্থার সাহায্যে ব্যাঙের জীবনচক্র ঠিক থাকে। শীত শেষে ব্যাঙ আবার সক্রিয় হয়, এদের ডাকে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে প্রকৃতি। ব্যাঙের এই প্রক্রিয়া আমাদের প্রকৃতির ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার গুরুত্বও স্মরণ করিয়ে দেয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।