শুক্র সূর্যের দ্বিতীয় নিকটতম গ্রহ। শুক্র বুধের মতো একেবারেই নয়। বুধ ছিল মেঘহীন, প্রায় অস্পষ্ট, হালকা বায়ুমণ্ডলে ঘেরা। নগ্ন পাথর সেখানে পালাক্রমে কখনো জলন্ত সূর্যকিরণে কখনো বা ভয়ঙ্কর হিমে পীড়িত। কিছুই নড়ে না। পরিপূর্ণ নৈঃশব্দ।
এখানে সবই তার উলটো। শুক্র গ্রহের ওপরে আছে খুব ঘন, গাঢ় বায়ুমণ্ডলের প্রলেপ। সেই বায়ুমণ্ডলে এত বেশি মেঘ যে গ্রহটা যেন সাদা তুলোয় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো, বিন্দুমাত্র আলোর ঝলক তার ভেতর দিয়ে যায় না। এই সাদা লেপের আড়ালে কী আছে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা শত শত বছর ধরে এই নিয়ে মাথা ঘামান।
সবাই একটা বিষয়ে একমত হন যে শুক্র গ্রহ নিশ্চয়ই বেশ উষ্ণ হবে। কেননা তা আমাদের তুলনায় সূর্যের কাছাকাছি। সবাই এটা বুঝতে পারতেন যে শুক্রে চির গোধূলির রাজত্ব। শুক্রে যদি কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব থাকেও তাহলে তাদের মাথার ওপরে সব সময় ঘুরে বেড়ায় ঝড়ের মেঘ। তারা ধারণাই করতে পারে না যে নীল আকাশ, সূর্য আর তারা বলে কিছু থাকতে পারে।
বেতার-জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাঁদের অ্যারিয়ালগুলো বিভিন্ন দিকে মুখ করে রাখলেন। দেখা গেছে সব তেতে ওঠা জিনিস থেকে বেতার তরঙ্গ বিচ্ছুরিত হয়। অবশ্য তাই বলে কোনো রকম শব্দ বা সঙ্গীত বহনের ক্ষমতা এই সব তরঙ্গের নেই। এদের যদি ধরে কোন লাউডস্পিকারে চালান করা যায় তাহলে স্রেফ খসখস আওয়াজ শোনা যাবে। কিন্তু এই খসখস নানা রকমের হয়ে থাকে। ঈষদুষ্ণ জিনিস থেকে এক রকম আর উত্তপ্ত জিনিস থেকে আরেক রকম। বেতার-জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই আওয়াজগুলো আলাদা আলাদা করে চিনতে শিখেছেন, ফলে তাঁরা দূর থেকে কোন জিনিসের তাপমাত্রা মাপতে পারেন।
বেতার-জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাই এবার তাঁদের যন্ত্রের অ্যারিয়াল শুক্র গ্রহের দিকে মুখ করে রাখলেন। শুক্র গ্রহ থেকে বিচ্ছুরিত বেতার-তরঙ্গ ধরার পর তাঁরা জানালেন শুক্র গ্রহের মেঘ ঠান্ডা, কিন্তু সেই মেঘের নীচেই আছে একটা প্রায় গনগনে লাল শক্ত পিঠ!
চাঁদ বা বুধের মতো শুক্র পুরোপুরি মৃত জগৎ নয়। নজর করে দেখলে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে এমন কিছু জিনিস এখানে চোখে পড়বে। বায়ু ধীরে ধীরে বইছে। এটাকে বাতাস অবশ্য ঠিক বলা যায় না। পৃথিবীর বাতাস ক্ষিপ্র, দমকা, অস্থির প্রকৃতির। কিন্তু এখানে অনুভূতিটা এমন হয় যেন একটা বিশাল নদীর মধ্যে ডুবে আছে। আর সে নদীর পানি শান্ত গম্ভীর ভাবে, ধীরেসুস্থে একই দিকে বয়ে চলেছে।
এই শান্ত স্রোতের তাড়নায় ছোট ছোট নুড়ি পাথর জমির ওপর দিয়ে অলস গতিতে গড়িয়ে গড়িয়ে চলেছে। ধোঁয়ার মধ্যে কোথাও কোথাও চোখে পড়ে মন্থরগতিতে ভাসমান ঘোলাটে ধারা—সম্ভবত ধুলো। দূরের দিকে তাকালে দেখতে পাবে পাথরগুলো সামান্য নড়াচড়া করছে, যেমন আমাদের এই পৃথিবীতে খুনির ওপরকার গরম হাওয়ার ভেতর দিয়ে তাকালে দেখতে পাও। মোটের ওপর বায়ুর অস্বাভাবিক ঘনত্ব পরিষ্কার উপলব্ধি করা যায়।
যখন জমির ওপর পা ফেল তখন পায়ের তলা থেকে কুয়াশা ওপরে ভেসে ওঠে আর স্রোতে ধীরে ধীরে তা একপাশে সরে যেতে থাকে। পৃথিবীর নদীর তলার পলিমাটির মতো। দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন। স্রোত চাপ দেয়। মনে হয় যেন কেউ হাতের তালু তোমার গায়ে ঠেকিয়ে আলতো করে, অথচ জেদ ধরে তোমাকে ধাক্কা মারতে মারতে এগিয়ে যেতে বলছে।
স্রোতের মুখে চলা সহজ! কিন্তু স্রোতের বিপরীতে চলা বড় কঠিন। তোমাকে নীচু হয়ে খুঁজতে হবে কোথায় পায়ের ভর দেওয়া যায়। পা তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়ে। স্পেসস্যুটের ভেতরে গরম এখনও টের পাওয়া যাচ্ছে না। কেবল পায়ের তলায়, বুটের পুরু সোল্ থাকা সত্ত্বেও ইতিমধ্যেই গরম লাগছে। অগ্নি-তপ্ত জগৎ বলতে আমরা যাকে জানি সেটা এই গ্রহের ওপরকার একটা পাতলা স্তর মাত্র। গভীরে অনেকটা ঠান্ডা। সেখানে তাপমাত্রা মোটে ৩০০ ডিগ্রি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।