আপনার প্রিয়জনের শেষ কথাগুলো যদি কেউ ভুলভাবে উচ্চারণ করে, মর্মান্তিকভাবে বিকৃত করে, তাহলে কেমন লাগবে? একটু কল্পনা করুন তো… সেটাই প্রতিদিন ঘটে চলেছে অগণিত মুসলিমের সাথে, যখন পবিত্র কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত হয় ভুল মাখরাজে, বিকৃত উচ্চারণে, নিয়ম না জেনে। ঢাকার মোহাম্মদপুরের এক মসজিদে জুমার নামাজের সময় ইমাম সাহেব “ر” (রা) এর জায়গায় “ড়” উচ্চারণ করলেন, “غَفُورٌ رَّحِيمٌ” হয়ে গেল “গাফুরুন ড়াহিম”। নামাজিরা কেউ টেরও পেলেন না। কিন্তু সেই ভুল উচ্চারণে মহান আল্লাহর সুমহান গুণবাচক নামের অর্থই পাল্টে গেল! এই তো গেল একটি উদাহরণ। প্রতিদিন, বাংলাদেশের লক্ষ মসজিদে, কোটি ঘরে, স্কুলে-মাদ্রাসায়, এমনকি গণমাধ্যমেও পবিত্র কুরআনের তিলাওয়াতের সময় সঠিক কুরআন তিলাওয়াতের নিয়ম উপেক্ষিত হচ্ছে। শুধু একটি শব্দের ভুল উচ্চারণ কুরআনের অর্থই পরিবর্তন করে না, বরং তা আমাদের ঈমানের ভিতকেও নড়বড়ে করে তোলে। তাহলে, এই নিয়মের গুরুত্বই বা কতটুকু? কেনই বা এটি প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরজে আইনের মতো অপরিহার্য?
Table of Contents
সঠিক কুরআন তিলাওয়াতের নিয়ম কেন আপনার ঈমানের অপরিহার্য অংশ?
কুরআন শুধু একটি গ্রন্থ নয়; এটি আল্লাহর সরাসরি বাণী, মানবজাতির জন্য চূড়ান্ত হিদায়াত, একটি জীবন্ত মুজিজা। এর প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি স্বরচিহ্ন (হারকাত) আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে নির্ভুলভাবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত করবে এক অক্ষরেও, তার জন্য রয়েছে একটি নেকী, আর প্রতিটি নেকী দশটি নেকীর সমতুল্য।” (তিরমিজি)। কিন্তু এই সওয়াবের দাবিদার হতে গেলে শর্ত কী? সেটাই হলো ‘সঠিকভাবে’ তিলাওয়াত করা।
তিলাওয়াত শুধু পড়া নয়; এটি একটি ঐশী সংলাপ:
আপনি যখন কুরআন তিলাওয়াত করেন, আপনি সরাসরি আল্লাহর সাথে কথা বলছেন। এই সংলাপে যদি ভুল থাকে, যদি শব্দ বিকৃত হয়, তাহলে কি তা শ্রোতার প্রতি সম্মানজনক হয়? ভাবুন, আপনি রাষ্ট্রপতির সাথে কথা বলছেন, কিন্তু তার নামই ভুল উচ্চারণ করলেন! সঠিক কুরআন তিলাওয়াতের নিয়ম মানে কুরআনের প্রতি মৌলিক সম্মান প্রদর্শন। এটি তাজবিদের (Tajweed) শাস্ত্রীয় জ্ঞান – যে বিদ্যা কুরআনের প্রতিটি অক্ষরকে তার নির্দিষ্ট মাখরাজ (উচ্চারণস্থল) ও সিফাত (বৈশিষ্ট্য) অনুযায়ী সুস্পষ্টভাবে উচ্চারণের শিক্ষা দেয়। যেমন:
- ‘ق’ (ক্বাফ) গলার গভীর থেকে উচ্চারিত হয়, ‘কাফ’ নয়।
- ‘ث’ (ছা) জিভের ডগা দিয়ে, ‘তা’ বা ‘সা’ নয়।
- ‘ض’ (দ্বাদ) জিভের পাশ দিয়ে, যা ‘ড়’ বা ‘দ’ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভাবুন। চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল বা রংপুরের চরের মানুষজন প্রাকৃতিকভাবেই তাদের আঞ্চলিক ভাষার প্রভাবে কিছু নির্দিষ্ট অক্ষর উচ্চারণে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। কিন্তু কুরআনের ক্ষেত্রে সেই স্বাচ্ছন্দ্য বা অভ্যাসের অজুহাত চলে না। এই নিয়ম না জানার ফলেই আমরা শুনি ‘ছালাত’ এর বদলে ‘সালাত’, ‘যাকাত’ এর বদলে ‘জাকাত’ – যার ফলে অর্থই বদলে যায়!
শুধু ধর্মীয় কর্তব্য নয়, ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা:
কুরআন হিফজের ধারা রাসূল (সা.) থেকে শুরু হয়ে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন, ইমামগণ এবং আজ পর্যন্ত অসংখ্য হাফেজে কুরআনের মাধ্যমে একটি অবিচ্ছিন্ন সনদ (ইসনাদ) সহকারে চলে আসছে। এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। সঠিক তিলাওয়াত এই ঐতিহ্যেরই অংশ। বাংলাদেশের জাতীয় কুরআন তিলাওয়াত প্রতিযোগিতাগুলোতে (যেমন ইসলামিক ফাউন্ডেশন আয়োজিত) প্রতিযোগীদের মূল্যায়নের সবচেয়ে বড় মাপকাঠি কি? তাজবিদের নিয়মের কঠোর অনুসরণ! এখানে একটি ভুল মাদ্দ (টান) বা গুননা (নাসালাইজেশন) পুরো পারফরম্যান্সকে নষ্ট করে দিতে পারে। এটি প্রমাণ করে সঠিক কুরআন তিলাওয়াতের নিয়ম শুধু ব্যক্তিগত ইবাদত নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার রক্ষার প্রশ্নও বটে।
আধ্যাত্মিক প্রভাব ও ইবাদতের কবুলিয়াত:
নামাজের একটি অপরিহার্য অংশই হলো কুরআন তিলাওয়াত। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে, নামাজে সূরা ফাতিহার তিলাওয়াত ফরজ। কিন্তু যদি তা সঠিক কুরআন তিলাওয়াতের নিয়ম অনুসারে না পড়া হয়, বিশেষ করে এমন ভুল যা শব্দের অর্থ পরিবর্তন করে দেয় (যেমন ‘أنعمتَ’ উচ্চারণে ‘ত’ এর জবর-যের ভুল হলে), তাহলে নামাজই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। শুধু নামাজ নয়, অন্যান্য ইবাদতেও কুরআন তিলাওয়াতের ভূমিকা কেন্দ্রীয়। ভুল তিলাওয়াত ইবাদতের আন্তরিকতা ও সওয়াবকে ম্লান করে দেয়। অন্যদিকে, সঠিক ও সুরেলা তিলাওয়াত হৃদয়কে নরম করে, চোখে অশ্রু আনে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভে সহায়ক হয় – যেমনটি প্রায়শই শুনি আমাদের প্রিয় ক্বারিদের কণ্ঠে।
তাজবিদের নিয়ম উপেক্ষা করলে কী ক্ষতি? শুধু ভুল নয়, ভয়ংকর বিপদ!
সঠিক তিলাওয়াতের গুরুত্ব না বোঝার সবচেয়ে বড় কারণ হলো ভুলের পরিণতি সম্পর্কে সচেতনতার অভাব। মনে রাখতে হবে, কুরআনের একটি অক্ষরের পরিবর্তনই পুরো অর্থকে উল্টে দিতে পারে, যা কুফরীর কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে!
অর্থ বিকৃতি: ঈমান-ভঙ্গের ঝুঁকি:
তাজবিদের ক্লাসিক উদাহরণ হলো ‘قُلْ’ (কুল) এবং ‘قَالَ’ (কালা) এর পার্থক্য। ‘কুল’ অর্থ ‘বলুন’ (আল্লাহর আদেশ), ‘কালা’ অর্থ ‘সে বলল’ (কোনো ব্যক্তির উক্তি)। এখন, যদি কেউ সূরা কাফিরুনের প্রথম আয়াত “قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ” (কুল ইয়া আইয়ুহাল কাফিরুন) উচ্চারণ করে “قَالَ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ” (কালা ইয়া আইয়ুহাল কাফিরুন), তাহলে অর্থ দাঁড়ায়, “সে (কেউ একজন) বলল, হে কাফিরগণ!” – যা সম্পূর্ণ ভুল এবং আল্লাহর বাণীকে মানুষের কথায় পরিণত করে, আল্লাহ আমাদের সকলকে হিফাজত করুন! এটি গুরুতর শিরকপ্রসূত ভুল।
অনুরূপভাবে, “رَبَّنَا بَارِكْ لَنَا” (হে আমাদের রব, আমাদের জন্য বরকত দান করুন) এর ‘ب’ (বা) এর উপর যথাযথ জবর না দিলে (‘ব’ এর জায়গায় হালকা করে পড়লে) শোনাতে পারে “رَبَّنَا تَارِكْ لَنَا” (হে আমাদের রব, আমাদেরকে পরিত্যাগ করুন) – যা সম্পূর্ণ বিপরীত এবং ভয়াবহ অর্থবাহী!
বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে বা শহুরে কিছু মক্তবে, যেখানে যোগ্যতাসম্পন্ন উস্তাদ না থাকেন, সেসব জায়গায় এমন ভুল তিলাওয়াত শোনা দুর্ভাগ্যজনকভাবে অস্বাভাবিক নয়। এই সঠিক কুরআন তিলাওয়াতের নিয়ম না জানা বা মানার অজ্ঞতা কত বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
ইবাদত বিনষ্টকরণ:
যেমনটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, নামাজের মধ্যে ফরজ সূরা ফাতিহা বা অন্য কোনো সূরার তিলাওয়াতে যদি এমন ভুল হয় যা শব্দের অর্থ পরিবর্তন করে, তাহলে নামাজ শুদ্ধ হয় না। ফিকহের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ফাতাওয়া আলমগীরী’তে স্পষ্ট বলা আছে যে নামাজে কুরআনের শব্দ বিকৃত করা নামাজ ভঙ্গের কারণ। শুধু নামাজ নয়, দুআ, তাওবাহ, যিকির – যে কোনো ইবাদতে কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করার সময় সঠিক কুরআন তিলাওয়াতের নিয়ম অপরিহার্য। ভুল উচ্চারণে দুআ কবুল না হওয়ারও আশঙ্কা থাকে।
ঐতিহ্য রক্ষায় ব্যর্থতা ও বিভ্রান্তি ছড়ানো:
কুরআন তিলাওয়াতের সঠিক পদ্ধতি না জানা বা অবহেলা করার অর্থ হলো চৌদ্দশ বছরের অমূল্য ঐতিহ্যকে অবজ্ঞা করা। এটি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ভুল তিলাওয়াত শেখার ধারা চালু করে, যা সংশোধন করা কঠিন হয়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের একজন প্রখ্যাত অধ্যাপক প্রায়ই বলতেন, “আমরা যদি আজ তাজবিদকে গুরুত্ব না দিই, আগামী প্রজন্ম কুরআনকে তার আসল সৌন্দর্য ও নির্ভুলতায় শুনতে পাবে না।” এছাড়া, ভুল তিলাওয়াত শুনে অন্যদের শেখার ক্ষেত্রেও বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
বাংলাদেশে কুরআন শিক্ষার বর্তমান চিত্র: সুযোগ ও সংকট
বাংলাদেশে কুরআন শিক্ষার প্রসার প্রশংসনীয়। অসংখ্য মক্তব, মাদ্রাসা, হিফজ বিভাগ, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং বেসরকারি সংস্থা কুরআন শিক্ষায় নিয়োজিত। ঢাকার মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট, চট্টগ্রামের হালিশহর, খুলনার খালিশপুরের মতো এলাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য নামকরা কুরআন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর লাখ লাখ শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক তাদের আয়োজিত মৌলিক কুরআন শিক্ষা কোর্সে অংশ নেয়।
কিন্তু চ্যালেঞ্জগুলোও প্রকট:
- যোগ্য উস্তাদের স্বল্পতা: অনেক মক্তব বা প্রাথমিক স্তরের কোর্সে তাজবিদে পারদর্শী, সনদপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাব রয়েছে। শিক্ষক নিজে যদি সঠিক কুরআন তিলাওয়াতের নিয়ম পুরোপুরি না জানেন, তাহলে তিনি কীভাবে শিখাবেন?
- ভাষাগত জটিলতা: তাজবিদের নিয়ম-কানুন আরবি ভাষায় বিস্তারিতভাবে বর্ণিত। বাংলা মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্য এর সঠিক বোধগম্যতা এবং মাখরাজের সূক্ষ্মতা আয়ত্ত করা কষ্টসাধ্য।
- পরিমাণের চেয়ে গুণের অবহেলা: অনেক অভিভাবক শুধু তাদের সন্তানকে কুরআন ‘পড়তে’ শেখানোর দিকেই মনোযোগ দেন, ‘সঠিকভাবে পড়তে’ শেখানোর গুরুত্ব কম বোঝেন। দ্রুত খতম বা হিফজ সম্পন্ন করাটাই প্রায়শঃ মুখ্য হয়ে ওঠে।
- সামাজিক উদাসীনতা: সমাজে এই ধারণা প্রচলিত যে শুধু ‘পড়তে পারলেই হলো’, উচ্চারণ একটু আধটু ভুল হলে সমস্যা নেই। এই মানসিকতা সঠিক কুরআন তিলাওয়াতের নিয়ম শেখার পথে বড় বাধা।
আলোর দিক:
তবে আশার কথা হলো, ইন্টারনেট ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের কল্যাণে এখন ঘরে বসেই বিশ্বমানের ক্বারিদের থেকে তাজবিদ শেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশি তরুণ উদ্যোক্তারা তৈরি করছেন ইউটিউব চ্যানেল, মোবাইল অ্যাপ (যেমন ‘তাজবিদ মাস্টার’, ‘কুরআন বেসিক’), অনলাইন কোর্স প্ল্যাটফর্ম যেখানে স্টেপ বাই স্টেপ সঠিক কুরআন তিলাওয়াতের নিয়ম শেখানো হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটে আন্তর্জাতিক মানের কেরাত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে উঠছে।
সঠিক তিলাওয়াত শেখার পথ: আপনার যাত্রা শুরু হোক আজই!
ভয় পাবেন না। তাজবিদ শেখা অসম্ভব কিছু নয়। এটি একটি দক্ষতা, যা ধৈর্য ও নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে আয়ত্ত করা যায়। শুরু করার জন্য কয়েকটি বাস্তব পদক্ষেপ:
১. একজন যোগ্য ও সনদপ্রাপ্ত উস্তাদের সন্ধান করুন:
এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আশেপাশের মসজিদ, মাদ্রাসা বা ইসলামিক সেন্টারে যোগাযোগ করুন। প্রশিক্ষক যেন মুতাকাদ্দিমীন (প্রাচীন) ইমামদের (যেমন ইমাম হাফস, ইমাম ওয়ারশ) রেওয়ায়েতে দক্ষ এবং ব্যবহারিক তাজবিদে পারদর্শী হন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের বিভিন্ন শাখায় তাজবিদ কোর্সের ব্যবস্থা রয়েছে – এগুলো নির্ভরযোগ্য উৎস। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ওয়েবসাইট দেখে নিন।
২. মৌলিক মাখরাজ আয়ত্ত করুন:
শুরু করুন মৌলিক আরবি হরফগুলোর সঠিক উচ্চারণ (মাখরাজ) দিয়ে। বিশেষ মনোযোগ দিন সেই অক্ষরগুলোতে যেগুলো বাংলা বা স্থানীয় ভাষায় নেই (যেমন ث, ذ, ظ, ص, ض, ط, ق, ع, غ). প্রতিদিন অল্প সময় বরাদ্দ করুন (১৫-২০ মিনিট) শুধু এই অক্ষরগুলোর চর্চার জন্য। উচ্চারণ রেকর্ড করে শুনুন এবং উস্তাদের সাথে মিলিয়ে নিন।
৩. ছোট সূরা দিয়ে অনুশীলন শুরু করুন:
সূরা ফাতিহা, সূরা ইখলাস, ফালাক, নাস – এগুলোর সঠিক কুরআন তিলাওয়াতের নিয়ম নিখুঁতভাবে আয়ত্ত করুন। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি হারকাত (ফাতহা, কাসরা, দাম্মা), প্রতিটি মাদ্দ (টান), গুননা (নাকের স্বর) নিয়ে কাজ করুন। ধীরে ধীরে দীর্ঘ সূরার দিকে যান।
৪. শুনুন, শুনুন এবং শুনুন:
বিশ্ববিখ্যাত ক্বারিদের (যেমন শায়খ মাহমুদ খলিল আল-হুসারী, শায়খ আবদুল বাসিত আবদুস সামাদ, শায়খ মিশারি রশিদ আল-আফাসি, শায়খ সাদ আল-গামিদি) তিলাওয়াত নিয়মিত শুনুন। তাদের অনুকরণ করার চেষ্টা করুন। বাংলাদেশি ক্বারিদের মধ্যে শায়খ ক্বারী মুহাম্মদ রেজাউল করিম, ক্বারী সাইফুল ইসলাম প্রমুখের তিলাওয়াতও অনুসরণীয়। মনোযোগ দিন তাদের উচ্চারণ, ওয়াকফ (বিরতি), এবং সুরের তারতম্যে।
৫. ধৈর্য্য ও ইখলাস বজায় রাখুন:
তাজবিদ শেখা রাতারাতি হয় না। ভুল হবেই। সেটা স্বাভাবিক। হতাশ না হয়ে নিয়মিত চর্চা চালিয়ে যান। আপনার নিয়ত (ইখলাস) খালেস রাখুন – একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
জেনে রাখুন
প্রশ্ন: তাজবিদ ছাড়া শুধু বাংলা উচ্চারণে কুরআন পড়লে কি হবে?
উত্তর: তাজবিদ ছাড়া কুরআন পড়া, বিশেষ করে যদি উচ্চারণে এমন ভুল হয় যা শব্দের অর্থ পরিবর্তন করে দেয় (যেমন উপরে উল্লেখিত উদাহরণগুলো), তাহলে তা মারাত্মক সমস্যার কারণ হতে পারে। এটি অর্থ বিকৃতির মাধ্যমে আল্লাহর কালামের অবমাননা এবং নামাজসহ ইবাদত বিনষ্ট হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে। তাই সঠিক কুরআন তিলাওয়াতের নিয়ম অর্থাৎ তাজবিদ শেখা ফরজে কিফায়া (সমষ্টিগতভাবে অপরিহার্য)।
প্রশ্ন: আমি বয়স্ক, এখন তাজবিদ শেখা কি আমার পক্ষে সম্ভব?
উত্তর: একদম সম্ভব! বয়স সঠিক কুরআন তিলাওয়াতের নিয়ম শেখার কোনো বাধা নয়। অনেকেই বয়সের পরেও সফলভাবে তাজবিদ আয়ত্ত করেছেন। ধৈর্য, নিয়মিত চর্চা এবং একজন ভালো উস্তাদের সাহায্য নিন। শুরু করুন মৌলিক মাখরাজ ও ছোট সূরা দিয়ে। আল্লাহ তাআলা সহায় হবেন ইন শা আল্লাহ।
প্রশ্ন: অনলাইনে তাজবিদ শেখা কতটা কার্যকর?
উত্তর: অনলাইন কোর্স, ইউটিউব টিউটোরিয়াল বা অ্যাপের মাধ্যমে তাজবিদ শেখা আজকাল খুবই জনপ্রিয় এবং কার্যকর হতে পারে, বিশেষ করে যদি সরাসরি উস্তাদ পাওয়া কঠিন হয়। তবে সতর্কতা হলো, শেখার পর আপনার উচ্চারণ একজন যোগ্য ব্যক্তিকে (উস্তাদ বা দক্ষ কাউকে) শুনিয়ে নিশ্চিত হওয়া জরুরি যে আপনি সঠিক কুরআন তিলাওয়াতের নিয়ম অনুসরণ করছেন। ভিডিও কলে বা অডিও রেকর্ডিং শেয়ার করে ফিডব্যাক নেওয়ার ব্যবস্থা অনেক প্ল্যাটফর্মে থাকে।
প্রশ্ন: সঠিক তিলাওয়াত শেখার জন্য কত সময় লাগতে পারে?
উত্তর: সময় ব্যক্তিভেদে, নিয়মিত চর্চার পরিমাণভেদে এবং শেখার গভীরতার উপর নির্ভর করে। মৌলিক মাখরাজ ও সাধারণ নিয়ম (যেমন নুন সাকিন, মিম সাকিন, ইদগাম, ইখফা ইত্যাদি) আয়ত্ত করতে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে। তবে তাজবিদের পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান ও তার বাস্তব প্রয়োগে দক্ষতা অর্জন একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা জীবনের সাথে সাথে উন্নত হয়। মূল কথা হলো শুরু করে দেওয়া এবং ধারাবাহিক থাকা।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে কোথায় ভালো তাজবিদ কোর্স করানো হয়?
উত্তর: ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে নিয়মিত তাজবিদ কোর্স হয়। এছাড়া অনেক নামকরা কওমি ও আলিয়া মাদ্রাসায় বিশেষ তাজবিদ বিভাগ রয়েছে। ঢাকার দারুল উলূম মাদ্রাসা, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া, চট্টগ্রামের জামিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া, বগুড়ার জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মোহাম্মদপুরসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান মানসম্মত তাজবিদ প্রশিক্ষণ দেয়। অনলাইনে ‘আলিম লাইভ’, ‘কুরআনিক’ বা ‘বায়ানুল কুরআন’ এর মতো প্ল্যাটফর্মও ভালো কোর্স অফার করে।
প্রশ্ন: সঠিক তিলাওয়াত জানা না থাকলে কি কুরআন পড়া যাবে না?
উত্তর: অবশ্যই পড়তে পারেন এবং পড়া উচিত! কিন্তু একই সাথে সঠিক কুরআন তিলাওয়াতের নিয়ম শেখার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। ভুলের আশঙ্কা থাকলেও পড়া বন্ধ করবেন না, বরং ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার জন্য উস্তাদের সাহায্য নিন। আল্লাহ তাআলা আপনার প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতাকে মূল্য দেবেন।
সুতরাং, সঠিক কুরআন তিলাওয়াতের নিয়ম বা তাজবিদ কোনো অতিরিক্ত বাড়তি বিষয় নয়; এটি কুরআনের সাথে আমাদের সম্পর্কের অপরিহার্য ভিত্তি। এটি আল্লাহর কালামকে তার পবিত্রতা ও সৌন্দর্যের সাথে গ্রহণ করার একমাত্র সঠিক পন্থা। এটি শুধু উচ্চারণের নিয়ম নয়, বরং হৃদয়ের সম্মান, ঈমানের দাবি এবং আখিরাতে সাফল্যের সোপান। একটি ভুল অক্ষর শুধু একটি শব্দ নষ্ট করে না, বরং তা আমাদের আধ্যাত্মিক সওয়াবকে ম্লান করে দিতে পারে, এমনকি ইবাদতের কবুলিয়াতকেও প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে। বাংলাদেশের মাটিতে, আমাদের ঘরে ঘরে, মসজিদে মসজিদে, কুরআনের এই পবিত্র ধ্বনি যেন তার আসল রূপে, নির্ভুলভাবে ধ্বনিত হয় – সেই দায়িত্ব আমাদের সবার। আজই সিদ্ধান্ত নিন, আপনার কুরআন তিলাওয়াতকে সঠিক পথে আনতে একজন যোগ্য উস্তাদের সন্ধান শুরু করুন, অথবা নির্ভরযোগ্য অনলাইন রিসোর্সের সাহায্য নিন। আপনার এই পদক্ষেপ শুধু আপনার জন্য নয়, বরং আমাদের সমষ্টিগত ঈমানী দায়িত্ব পূরণের দিকেও এক মহৎ অগ্রযাত্রা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।