জহুরুল হক বুলবুল: বাচ্চার প্রচণ্ড কান্না। আমার সামনে সিটে বসা মহিলাটি কিছুতেই বাচ্চার কান্না থামাতে পারছেন না। কাঁদতে কাঁদতে ছয়-সাত বছরের বাচ্চা বলছে—গাড়ি না ছাড়লে চলো হেঁটে যাব মা। ভাবলাম, হয়তো পরের কোনো স্টপেজে নেমে যাবেন ভদ্রমহিলা। কিন্তু জিগ্যেস করে জানতে পারলাম—গন্তব্যস্থল গোপালপুর, যা এখনো ৪৫ কিলোমিটার দূরে। অক্টোবর মাসে ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার পথে টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ডে ঢাকা-গোপালপুরের একটি বাসে এই ঘটনা। একে তো গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা—তার ওপর বাসস্ট্যান্ডে প্রায় ২০ মিনিট ধরে গাড়ি দাঁড়ানো। গাড়ি চলতে থাকলে গাড়িতে বাতাস ঢুকে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়।
দেশের বিভিন্ন বড় বাসস্টপেজে বাসগুলোর প্রায় একই চিত্র। যাত্রাস্থল থেকে ছেড়ে আসা পরের বাস যে পর্যন্ত না এসে পৌঁছবে—সে পর্যন্ত ছেড়ে আসা আগের বাসটি অপেক্ষা করে যাত্রীর জন্য। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ঢাকা-জামালপুর, ঢাকা-শেরপুর, ঢাকা-ধনবাড়ী, ঢাকা-সরিষাবাড়ী, ঢাকা-ভূঁঞাপুর, ঢাকা-গোপালপুরসহ প্রায় বাসগুলোর একই অবস্থা। টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ডে দীর্ঘ অপেক্ষা যাত্রীর জন্য। বাসস্ট্যান্ডে শুধু গাড়ি আর গাড়ি। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা উত্তরবঙ্গগামী বাসসহ অন্য বাস মিলে গাজীপুরের চন্দ্রা স্টপেজেও গাড়ির সারি। বাসের হেলপার যাত্রী, যাত্রীদের ব্যাগ, শিশুদের নিয়ে করে টানাটানি—এতে যাত্রীরা খুব অস্বস্তিতে পড়েন।
অধিকাংশ বাসস্ট্যান্ডে নেই ভালো পাবলিক টয়লেট। পাবলিক টয়লেট না থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। বিশেষ করে বেশি সমস্যা হয় নারী যাত্রীদের।
টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহ বা ময়মনসিংহ থেকে টাঙ্গাইল ছেড়ে আসা বাসগুলোও মধুপুর বাসস্টপেজে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে পরের বাসটি না আসা পর্যন্ত। যাদের জরুরি প্রয়োজন, পরে ছেড়ে আসা বাসটি থেকে অনেক যাত্রীই নেমে আগে ছেড়ে আসা সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাসটিতে ওঠেন। কিন্তু এটা বয়স্ক, অসুস্থ, নারী, ভারী ব্যাগ যাদের আছে তাদের পক্ষে এভাবে গাড়ি বদল করা সম্ভব হয় না। যারা গাড়ি বদল করে সামনের গাড়িতে ওঠেন তারাও হন ভোগান্তির শিকার। আগেই পরিশোধ করা ভাড়া ফেরত নেওয়া, সামনের গাড়িতে সিট পাওয়া, সিট না পেলে দাঁড়িয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এভাবে নানা রকম হয়রানির শিকার হতে হয় যাত্রীদের। সারা দেশে বড় বাসস্ট্যান্ডের কমবেশি প্রায় একই চিত্র।
কিন্তু এতে লাভ কি কারো হচ্ছে? হচ্ছে না। মালিক, শ্রমিক, যাত্রী, পথচারী—সবার ক্ষতি হচ্ছে। বাসগুলো অপেক্ষা করে প্রধানত যাত্রীর জন্য। বাসগুলো ২০-২৫ মিনিট অপেক্ষা করে যে যাত্রী পায়, যদি কোনো বাসই যাত্রী ওঠানামা ছাড়া অতিরিক্ত এক মিনিটও সময় না নেয়, তাহলেও একই যাত্রী পাবে। এভাবে স্ট্যান্ডে দীর্ঘক্ষণ বাস অপেক্ষা করায় হচ্ছে সময়ের অপচয়, বাসস্ট্যান্ডগুলোতে হচ্ছে যানজট। এতে পথচারীদের ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করে। বাসের ইঞ্জিন চালু থাকায় হচ্ছে পরিবেশদূষণ। আয়ু কমে যায় বাসের ইঞ্জিনের, হচ্ছে শব্দদূষণও। অনেক মুমূর্ষু রোগীর হয় কষ্ট, অফিসগামী মানুষ সময়মতো পৌঁছাতে পারেন না অফিসে। সব মিলে ভোগান্তি চরম আকার।
সর্বোপরি হচ্ছে জ্বালানির অপচয়। অথচ বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এবং জ্বালানি তেল আমদানি কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর পাশাপাশি ডিজেলচালিত সব বিদ্যুৎকেন্দ্রেও আপাতত বন্ধ রাখছে। আর জ্বালানি খাতে ভর্তুকি লাগাম টানার কথা বলছে অর্থ বিভাগ।
এছাড়াও ছোট স্টপেজগুলোতেও ইচ্ছেমতো বাস থামিয়ে রাখে। অন্য বাস যাতে না যেতে পারে—এজন্য আড়াআড়ি করে বাস রেখে পুরো রাস্তা আটকে রাখার দৃশ্য নিত্যদিনের। এটাই যেন নিয়ম। এতে ব্যক্তিগত গাড়িগুলোও আটকা পড়ে হয় যানজটের সৃষ্টি। ভাড়া নিয়ে বাস কন্ডাকটর ও যাত্রীদের মধ্যে প্রায়ই বাগবিতণ্ডা লেগেই থাকে।
নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছা বাসগুলোর জন্য আরো ভয়ংকর অবস্থা। বাসগুলো ছাড়ার পর রাস্তায় সময় নষ্ট করে, যাত্রী পাওয়ার আশায়। একদিকে নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে হবে, অন্যদিকে পরে যারপরনাই বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালায়। তখন মনে হয় যেন গাড়ি চালানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কারণ আগে কে নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছবে। এসব বাসের লাগামহীন গতি এবং ট্রাফিক আইনের তোয়াক্কা না করায় সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান একটি কারণ।
আমাদের দেশে যারা সড়কপথে চলাচল করেন, বলা চলে জীবনের ঝুঁকি, হয়রানির শিকার—এটা বিবেচনায় নিয়েই বোধহয় ঘর থেকে বের হন। দিনদিন সারা দেশে যেভাবে যে হারে সড়ক দুর্ঘটনা ও যাত্রী হয়রানি বেড়ে চলছে—তাতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে, এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাতায়াত করতে হলে বিপদ যেন নিত্যসঙ্গী—তা বলাই বাহুল্য।
সব পরিবহন সেক্টরে এক নৈরাজ্য বিরাজ করছে দীর্ঘদিন ধরেই। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যা খুশি তা-ই করা হচ্ছে এ সেক্টরে। অথচ অর্থনৈতিকভাবে খুব সংকটময় সময় অতিবাহিত করছি আমরা। স্বয়ং সরকারপ্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে নানাভাবে কৃচ্ছ্রসাধনের নির্দেশ ও অনুরোধ জানানো হচ্ছে। এমন একটি সময়ে শুধু পরিবহন সেক্টরে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি ও কর্মঘণ্টা অপচয় হচ্ছে। পরিবহন সেক্টরে এসব নৈরাজ্য কোনোমতেই আর চলতে দেওয়া উচিত নয়। এ অবস্থা থেকে মুক্তি চায় সাধারণ যাত্রীগণ।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, কালিহাতী শাজাহান সিরাজ কলেজ, টাঙ্গাইল
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।