দেশজুড়ে ভোক্তাদের মধ্যে চরম উদ্বেগ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে সয়াবিন তেলের দাম হঠাৎ করে বাড়ার কারণে। একদিকে রমজান ও ঈদ পরবর্তী চাহিদা, অন্যদিকে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-কর অব্যাহতি শেষ হওয়া—সবকিছু মিলিয়ে বাজারে তৈরি হয়েছে তীব্র অস্থিরতা। তেল ব্যবসায়ীদের সমিতি এই দামের পরিবর্তনকে যুক্তিসংগত দাবি করলেও, সাধারণ মানুষের কষ্টের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে বোতলজাত এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৪ টাকা বাড়িয়ে ১৮৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আগে ছিল ১৭৫ টাকা।
সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধি: বাস্তবতা ও পটভূমি
সয়াবিন তেলের দাম নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় মার্চ মাসের শেষদিকে, যখন ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানার মালিকদের সমিতি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে। তারা বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১৮ টাকা এবং খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম ১৩ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। মূল কারণ ছিল ভোজ্যতেলের ওপর শুল্ক-কর অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া।
Table of Contents
সরকার ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত সয়াবিন ও পাম তেলের ওপর আমদানি শুল্ক ও কর রেয়াত দিয়েছিল, যার ফলে মূল্য কিছুটা নিয়ন্ত্রিত ছিল। তবে সেই রেয়াত ৩১ মার্চ শেষ হয়ে গেলে মিল মালিকরা চাপ বাড়াতে শুরু করে নতুন দাম কার্যকর করার জন্য।
১৩ এপ্রিল রাতে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঘোষণা দেয় যে, বোতলজাত এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৮৯ টাকা এবং পাঁচ লিটার বোতলের দাম ৯২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দামও বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৬৯ টাকা প্রতি লিটার।
দাম বৃদ্ধির পেছনের অর্থনৈতিক কারণসমূহ
বিশ্লেষকদের মতে, সয়াবিন তেলের দামের এই বৃদ্ধি শুধু স্থানীয় নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাজারের বিভিন্ন গতিপথের সাথেও যুক্ত। তবে বিশ্ববাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম গত কয়েক মাসে স্থিতিশীল ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের টনপ্রতি দাম ছিল ১,০৪৮ ডলার, যা ফেব্রুয়ারিতে বেড়ে ১,০৬৯ ডলার হলেও মার্চে কমে আসে ১,০০৫ ডলারে। পাম তেলের ক্ষেত্রেও একই রকম প্রবণতা দেখা গেছে।
তাহলে বাংলাদেশে হঠাৎ করে এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কারণ কী? স্থানীয় বাজারে চাহিদা ও সরবরাহে ভারসাম্যহীনতা, মিল মালিকদের কৃত্রিম সংকট তৈরি এবং শুল্ক সুবিধার প্রত্যাহার—এই সবই একসঙ্গে মিলে দামের ওপর প্রভাব ফেলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমদানিকৃত তেলের ভ্যাট, পরিবহন খরচ, উৎপাদন খরচ ও বাজারজাতকরণ ব্যয় সব মিলিয়েই দামের এই গতি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) জানিয়েছে, ৬ মাস ধরে শুল্ক অব্যাহতি কার্যকর থাকলেও সেটি দীর্ঘ সময় বজায় রাখা সম্ভব নয়। এ কারণে শুল্ক সুবিধা প্রত্যাহার করার পর দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়।
সরকারি সংস্থা ও মিল মালিকদের মধ্যে দর-কষাকষি
দামের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে সরকার ও মিল মালিকদের মধ্যে কয়েকবার বৈঠক হয়েছে। ৬ ও ৮ এপ্রিল বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন এই বিষয়ে বৈঠক করেন, কিন্তু কোনো চূড়ান্ত সমাধান আসেনি। মিল মালিকরা প্রতি লিটারে দাম ১৯০ টাকার বেশি চাইলেও বাণিজ্য উপদেষ্টা সেটি ১৯০ টাকার নিচে রাখতে চেয়েছেন। পরবর্তীতে ১৪ এপ্রিল থেকে নতুন দাম কার্যকর করা হয়।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা ও খুচরা বিক্রেতারা জানিয়েছেন, তেলের সরবরাহ ইচ্ছাকৃতভাবে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে যেন দাম বাড়ানো যায়। চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজার ও খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম বাড়ার আশঙ্কায় মজুত বাড়ানো হয়েছে। এই অবস্থা ভোক্তাদের কষ্ট বাড়িয়ে দিচ্ছে।
যদিও বাজারে সয়াবিন তেলের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে, তথাপি বোতলজাত তেলের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসেই আমদানিকৃত তেলের পরিমাণ ৩.৫ লাখ টন ছাড়িয়েছে, যা চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট।
তবুও, অনেক এলাকায় খোলা সয়াবিন তেল ১৭৩–১৮০ টাকা এবং পাম তেল ১৬৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি। এমন অবস্থায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে এমন মূল্যবৃদ্ধি রোধে কয়েকটি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। যেমন: আমদানির সময় দীর্ঘমেয়াদি শুল্ক-কর রেয়াত, দাম নির্ধারণে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া, এবং বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা।
এছাড়া, ন্যায্য মূল্যে তেল বিক্রির জন্য সরকার যদি একটি নির্ধারিত মূল্যছাড়ের বৃত্তি চালু করে, তবে নিম্ন আয়ের মানুষ উপকৃত হবে। একইসাথে, ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করেও ভোক্তাদের স্বস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
FAQs
- বর্তমানে সয়াবিন তেলের দাম কত?
বর্তমানে বোতলজাত এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৮৯ টাকা, যা আগে ছিল ১৭৫ টাকা। - সয়াবিন তেলের দাম কেন বাড়ানো হয়েছে?
শুল্ক-কর অব্যাহতি শেষ হওয়া, বাজারে কৃত্রিম সংকট এবং আন্তর্জাতিক মূল্যবৃদ্ধি—এই কয়েকটি কারণ মূলত দামের পেছনে কাজ করেছে। - খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের নতুন দাম কত?
প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬৯ টাকা, যা আগে ছিল ১৫৭ টাকা। - সরকার কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি?
সরকার বাণিজ্য উপদেষ্টা ও ট্যারিফ কমিশনের মাধ্যমে নিয়মিত বৈঠক করেছে, তবে এখনো পর্যন্ত কার্যকর মনিটরিং বা মূল্যছাড় নিশ্চিত করা যায়নি। - ভবিষ্যতে সয়াবিন তেলের দাম আবার বাড়তে পারে কি?
যদি আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি পায় বা শুল্ক-কর সুবিধা প্রত্যাহার থাকে, তবে দামের উপর প্রভাব পড়তে পারে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।