আবদুল লতিফ মন্ডল : সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিলের বিষয়টি আবার গণমাধ্যমে আলোচনায় এসেছে। ৬ মার্চ দ্য ডেইলি স্টারের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, “The public administration ministry is pushing to relax a provision in the law that stipulates the submission of annual wealth statements every five years by public servants-a move that can encourage corruption among the 14 lakh government employees. The ministry now proposes that the government, if needed, collects the employees’ wealth statements from their annual tax returns to the National Board of Revenue instead of getting it straight from the employees. It also suggests that those who do not file their income tax return will have to submit their wealth statement in a prescribed every December. The ministry has proposed these in the draft amendment to the government Servant (Conduct) Rules 1979”. সংক্ষেপে যার অর্থ দাঁড়ায়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর এমন একটি বিধি সংশোধনের চিন্তাভাবনা করছে, যা সরকারি কর্মচারীদের প্রতি পাঁচ বছর বাদে সরকারের কাছে তাদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করেছে। মন্ত্রণালয় প্রস্তাব করেছে, সরকার প্রয়োজন মনে করলে আয়কর বিভাগ থেকে কোনো কর্মচারীর সম্পদ বিবরণী সংগ্রহ করতে পারবে। যারা আয়কর বিবরণী জমা দেন না, তাদের নির্ধারিত ছকে সম্পদের বিবরণী জমা দিতে হবে। মন্ত্রণালয় এ মর্মে একটি খসড়া প্রস্তাব সরকারের কাছে পেশ করেছে। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, আইন মন্ত্রণালয় পরীক্ষিত খসড়াটির সংশোধনী প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটিতে উপস্থাপনের অপেক্ষায় রয়েছে। উল্লেখ্য, এবার বিষয়টিতে সরকারের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে। আগে সরকার গুরুত্বারোপ করেছিল আয়কর অফিসে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া ছাড়াও নিজ নিজ দপ্তরে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দাখিল বাধ্যতামূলক করায়। এবারের লক্ষ্য তাদের নিজ নিজ দপ্তরে সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়া থেকে অব্যাহতি প্রদান। যেসব সরকারি কর্মচারী আয়কর অফিসে আয়কর বিবরণী জমা দেবেন, তাদের নিজ নিজ দপ্তরে তথা সরকারের কাছে সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়া থেকে অব্যাহতি প্রদান কতটা যৌক্তিক হবে, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
১৯৭৯ সালে প্রণীত সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার ১৩ বিধির ১নং উপবিধিতে বলা হয়েছে, প্রত্যেক সরকারি কর্মচারীকে চাকরিতে প্রবেশের সময় যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তার অথবা তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন শেয়ার সার্টিফিকেট, সিকিউরিটি, বিমা পলিসি ও দশ হাজার টাকা বা এর অধিক সর্বমোট অলংকারাদিসহ সব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি সম্পর্কে সরকারের নিকট ঘোষণা দিতে হবে। আর উপবিধি-২-এ বলা হয়েছে, প্রত্যেক সরকারি কর্মচারীকে প্রতি বছর পর ডিসেম্বর মাসে ১নং উপবিধির অধীন ঘোষণায় বা সর্বশেষ দাখিলকৃত বিবরণীতে প্রদর্শিত সম্পত্তির হ্রাস-বৃদ্ধির বিবরণী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের নিকট দাখিল করতে হবে। দুই দশক পর সরকার ২০০২ সালের শেষদিকে উপবিধি-২-এ সংশোধনী এনে সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধির বিবরণী দাখিলের সময় ‘প্রতিবছর পর ডিসেম্বর মাস’-এর পরিবর্তে ‘প্রতি পাঁচ বছর পর ডিসেম্বর মাস’ করে। প্রত্যেক বছরের পরিবর্তে পাঁচ বছর পরপর সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধির হিসাব দাখিলের বিধান বিষয়টির গুরুত্ব বহুলাংশে কমিয়ে দেয় এবং সরকারি চাকরিজীবীদের এ বিষয়ে অনাগ্রহী করে তোলে।
সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব দাখিল নিয়ে যে বিতর্ক রয়েছে তা হলো, সরকারি চাকরিজীবীর সম্পদের সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের বিবরণী দাখিলের বাধ্যবাধকতা। অনেকের মতে মূল সমস্যা এখানেই। এক্ষেত্রে সম্পদের হিসাব নিতে হবে বিপুলসংখ্যক মানুষের, অন্তত ৩৫ লাখ ব্যক্তির। সরকারের এ সক্ষমতা নিয়েও তাদের প্রশ্ন রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আলোচনায় যাওয়ার আগে দেখা যাক বিধিমালায় সরকারি চাকরিজীবীর পরিবার বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে। বিধিমালা অনুযায়ী, যারা সরকারি কর্মচারীর পরিবারের সদস্য বলে অন্তর্ভুক্ত, তারা হলেন তার সঙ্গে বসবাসরত অথবা বসবাসরত নন স্ত্রী/স্বামী, সন্তান বা সৎসন্তান এবং তার সঙ্গে বসবাসরত এবং তার ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল তার নিজের বা স্ত্রীর/স্বামীর আত্মীয়স্বজন। এর কারণ সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালায় উল্লিখিত পরিবারের সদস্যরা সরকারি চাকরিজীবীর আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে। তাদের সম্পদের উৎস সরকারি চাকরিজীবীর বৈধ বা অবৈধ আয় কিনা, তা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। অসৎ সরকারি কর্মচারীরা অন্যায়ভাবে অর্জিত অর্থ তাদের স্পাউস, সন্তান বা আত্মীয়স্বজনের নামে স্থানান্তর করেন-এমন নজিরের অভাব নেই। সেদিক বিবেচনায় পরিবারের সদস্য নির্ধারণে বিদ্যমান সংজ্ঞাটি যথাযথ হয়েছে।
এখন দেখা যাক সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দাখিলের নিয়ম শিথিল করে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালায় সংশোধনী আনার যৌক্তিকতা কতটুকু। আয়কর অফিসে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া এবং সরকারি কর্মচারীর নিজ দপ্তরে সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিল করার উদ্দেশ্য এক নয়। আয়কর অফিসের লক্ষ্য হলো কর আদায় করা। দুর্নীতি দমন কমিশন বা অন্য কোনো সরকারি সংস্থা কোনো সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাব না চাইলে আয়কর অফিস রিটার্ন দাতার সম্পদের বৃদ্ধি নিয়ে তেমন উদ্বেগে থাকে না। অন্যদিকে সরকারি কর্মচারীর নিজ দপ্তরে সম্পদের বিবরণী দাখিলের মাধ্যমে তার সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করা সরকারের উদ্দেশ্য। তাই একটি অপরটির বিকল্প নয়।
দেশের দুর্নীতির চক্রে সরকারি কর্মচারীদের ভূমিকা অত্যন্ত শক্তিশালী। এখানে সরকারি কর্মচারী বলতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে বা কোনো করপোরেশন বা তার অধীন সেবা প্রদানকারী বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। প্রশ্ন হলো, সরকার সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা অনেকগুণ বাড়িয়ে দিলেও তারা সরকারি চাকরি আইনের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন কেন? দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বিলম্ব এবং আইনের দুর্বলতার কারণে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়াকে মূলত এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে। গত তিন দশকে সরকারি কর্মচারীদের দলীয়করণকেও এর জন্য অনেকটা দায়ী করা যায়। দলবাজ সরকারি কর্মচারীরা হয়ে উঠেছেন দুর্নীতিবাজ। অন্য দুজন হলেন রাজনীতিক, বিশেষ করে যিনি/যারা প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী পদে নিয়োজিত এবং বেসরকারি খাতের ব্যক্তি। আমাদের দেশে নির্বাচনব্যবস্থা, তা জাতীয় বা স্থানীয় যে পর্যায়েই হোক, অর্থ ও পেশিশক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। নির্বাচন কমিশন এসব নির্বাচনে যে ব্যয়সীমা নির্ধারণ করে দেয়, তা মেনে চলার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই নির্বাচিত হওয়ার পর এসব জনপ্রতিনিধির লক্ষ্য থাকে নির্বাচনে ব্যয়িত টাকা আয় করা এবং পরবর্তী নির্বাচনের জন্য টাকা জোগাড় করা। এজন্য তারা দুর্নীতির আশ্রয় নেন। বেসরকারি খাত, বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা দুর্নীতির জন্য কম দায়ী নন। বেসরকারি খাত বিভিন্নভাবে দুর্নীতি করে। কর ফাঁকি দিতে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তাদের প্রকৃত সম্পদ ও লাভের পরিমাণ কর কর্মকর্তাদের দেখায় না। আমদানি-রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে কর ফাঁকি দেওয়া একটি মামুলি ব্যাপার। এ সম্পর্কিত খবর আমরা পত্রপত্রিকায় প্রায়ই দেখে থাকি। তাই দেশে দুর্নীতির মূলে রয়েছে এ তিন পক্ষের যোগসাজশ।
সরকারের এ উদ্যোগ বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হয়েছে। দ্য ডেইলি স্টারের উপর্যুক্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, সরকারের এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে তা ১৪ লাখ সরকারি কর্মচারীর মাঝে দুর্নীতির প্রসারকে উৎসাহিত করবে। সাবেক ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকে বলছেন, এতে সম্পদবিবরণী দাখিলের প্রক্রিয়া আরও দুর্বল হয়ে পড়বে এবং দুর্নীতি বৃদ্ধি পাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, যৌক্তিকতা থাকার কারণেই বিধিমালা প্রণয়নের সময় আয়কর রিটার্ন ছাড়াও সম্পদ বিবরণী দাখিলের বিধান করা হয়েছিল এবং বর্তমানেও সে যৌক্তিকতা ফুরিয়ে যায়নি। বরং দুর্নীতি বৃদ্ধির কারণে তা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের আগে সরকারের উচিত হবে বিষয়টি ভালোভাবে ভেবে দেখা।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
[email protected]
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।