বাংলাদেশের সরকারি চাকরিজীবীরা দীর্ঘদিন ধরে টাইম স্কেল এবং সিলেকশন গ্রেড নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ও সীমাবদ্ধতার মধ্যে ছিলেন। এই সুবিধাগুলো ছিল মূলত সেইসব কর্মচারীদের জন্য, যারা দীর্ঘ সময় একই পদে চাকরি করে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সময়ের সাথে সাথে এসব নিয়মে পরিবর্তন এসেছে এবং ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী টাইম স্কেল এবং সিলেকশন গ্রেডের পরিবর্তে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উচ্চতর গ্রেড প্রবর্তন করা হয়। এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব কিভাবে টাইম স্কেল প্রথার বিবর্তন ঘটেছে এবং সম্প্রতি আপিল বিভাগের একটি রায়ের মাধ্যমে এর যে নতুন ব্যাখ্যা ও দিকনির্দেশনা এসেছে, তা সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য কী অর্থবহ হয়ে উঠেছে।
সরকারি চাকরিজীবীদের টাইম স্কেল: পূর্ববর্তী নিয়ম ও বর্তমান বাস্তবতা
টাইম স্কেল প্রথা ১৯৮৩ সাল থেকে চালু ছিল এবং এটি বিভিন্ন জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্ত ছিল ২০০৯ সাল পর্যন্ত। এই প্রথার মাধ্যমে একজন সরকারি কর্মচারী নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত একই পদে চাকরি করলে, পদোন্নতি ছাড়াই তার বেতনক্রম উন্নীত হতো। এক্ষেত্রে মূলত দুইটি ধাপ ছিল — একটি ৮ বা ১০ বছর পরে, আরেকটি আরও কয়েক বছর পরে। এই সুবিধার উদ্দেশ্য ছিল পদোন্নতির সুযোগ সীমিত এমন পদে কর্মরতদের আর্থিক প্রণোদনা প্রদান।
Table of Contents
তবে ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেলের মাধ্যমে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল করে নতুন একটি ব্যবস্থা চালু করা হয় — উচ্চতর গ্রেড। এই নিয়ম অনুযায়ী, কোনো কর্মচারী যদি একই পদে ১০ বছর চাকরি করেন, তবে ১১তম বছরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি উচ্চতর গ্রেড পাবেন। এরপর আরও ৬ বছর চাকরি করলে ১৭তম বছরে দ্বিতীয়টি পাবেন।
টাইম স্কেল ও উচ্চতর গ্রেড নিয়ে আইনি জটিলতা: হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রায়
২০১৭ সালের পরিপত্রে অর্থ মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয় যে যারা ইতোমধ্যে দুইটি টাইম স্কেল বা সিলেকশন গ্রেড পেয়েছেন, তারা নতুন স্কেলে আর কোনো উচ্চতর গ্রেড পাবেন না। যারা একটিমাত্র পেয়েছেন, তারাও আর দ্বিতীয়টি পাবেন না — এই রকম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। অনেক চাকরিজীবী এই সিদ্ধান্তকে অন্যায্য মনে করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। হাইকোর্ট রায়ে বলে, যারা একটি টাইম স্কেল বা সিলেকশন গ্রেড পেয়েছেন, তারা দ্বিতীয়টি পাবেন না — এই ব্যাখ্যা আইনের পরিপন্থী। ফলে হাইকোর্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রকে আংশিকভাবে অবৈধ ঘোষণা করে।
এরপর সরকার আপিল করে। আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে, যারা আগে টাইম স্কেল বা সিলেকশন গ্রেড পেয়েছেন, তারাও উচ্চতর গ্রেডের জন্য আইনগতভাবে উপযুক্ত। অর্থাৎ তারা দ্বিতীয় গ্রেডও পাবেন। এই রায়ের ফলে প্রায় ১৫ লাখ সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী উপকৃত হবেন।
সেনাবাহিনীকে অভিযান চালাতে বলেছে ভারত, পাল্টা সতর্ক পাকিস্তান
আর্থিক প্রভাব ও প্রশাসনিক নির্দেশনা
এই রায়ের ফলে সরকারের ওপর একটি বড় ধরনের আর্থিক চাপ পড়বে, কারণ বিপুলসংখ্যক কর্মচারী নতুন করে উচ্চতর গ্রেড পাবেন। প্রশাসনিকভাবে এটি বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়সমূহকে নতুনভাবে পরিপত্র জারি করতে হতে পারে। একইসঙ্গে কর্মচারীদের বেতন হালনাগাদ ও হিসাব-নিকাশ করতে হবে পূর্ববর্তী বছরের হিসাব ধরে। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলেও, কর্মচারীদের ন্যায্য অধিকার বাস্তবায়নে এটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
উচ্চতর গ্রেডের বাস্তবিক কার্যকারিতা
প্রকৃতপক্ষে উচ্চতর গ্রেড প্রথা একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত, যা টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের তুলনায় আরও স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য। একই পদে কর্মরত থাকলেও অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে বেতন উন্নীত করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটি সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহ বাড়াবে এবং দক্ষ কর্মচারীদের অনুপ্রাণিত করবে।
বাজেট ও ব্যবস্থাপনা
এত সংখ্যক কর্মচারীকে অতিরিক্ত বেতন প্রদান সরকারের বাজেট ব্যবস্থাপনায় চাপ তৈরি করবে। তবে এই খরচ দীর্ঘমেয়াদে সরকারি খাতে দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। যেহেতু উচ্চতর গ্রেড স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রদান করা হয়, তাই তা নিয়ে দুর্নীতি বা অনিয়মের সম্ভাবনাও কমে যাবে।
সরকারি চাকরিজীবীদের প্রতিক্রিয়া
রায়ের পর সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে স্বস্তির নিঃশ্বাস দেখা গেছে। তাদের মধ্যে অনেকেই মনে করছেন যে এটি তাদের ন্যায্য অধিকার ছিল যা এতদিন চাপা পড়ে ছিল। একইসঙ্গে এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে সরকারি চাকরির কাঠামোতে আরও আধুনিক ও কর্মক্ষম সংস্কার আনার পথ খুলে দিয়েছে।
FAQs
টাইম স্কেল কী?
টাইম স্কেল হলো সরকারি চাকরিতে পদোন্নতি ছাড়াই নির্দিষ্ট সময় পর বেতন বৃদ্ধির একটি পদ্ধতি। এটি অভিজ্ঞতা ও চাকরির মেয়াদের ভিত্তিতে প্রদান করা হয়।
উচ্চতর গ্রেড কীভাবে ভিন্ন?
উচ্চতর গ্রেড একটি নতুন প্রথা যা টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের পরিবর্তে চালু হয়েছে। এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেওয়া হয় নির্দিষ্ট সময়ের চাকরির পর।
এই রায়ের মাধ্যমে কতজন উপকৃত হবেন?
প্রায় ১৫ লাখ সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী এই রায়ের ফলে উচ্চতর গ্রেডের সুবিধা পাবেন।
কখন থেকে এই রায় কার্যকর হবে?
রায় কার্যকর হবে আপিল বিভাগের রায় ঘোষণার তারিখ থেকে। তবে মন্ত্রণালয়ের পরবর্তী নির্দেশনার ওপর নির্ভর করে বাস্তবায়ন শুরু হবে।
এই পরিবর্তনের জন্য বাজেট বরাদ্দ কীভাবে হবে?
বাজেট মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহের যৌথ আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারিত হবে এবং প্রয়োজনে সম্পূরক বাজেট ব্যবস্থাও নেওয়া হতে পারে।
রায়ে টাইম স্কেলপ্রাপ্তদের ভবিষ্যৎ কী?
রায়ের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছে যে পূর্বে টাইম স্কেলপ্রাপ্তরাও উচ্চতর গ্রেড পাবেন এবং তাদের ভবিষ্যতে আর কোনো বাধা থাকবে না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।