জুমবাংলা ডেস্ক : পদ্মার তীরঘেঁষা খাস জমি কেটে মাটি বিক্রি করছেন বিএনপি-ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। প্রতিদিন অন্তত শতাধিক ট্রাক মাটি বিক্রি হচ্ছে। সরকারি সম্পদ রক্ষায় লাল পতাকা আর সরকারি সাইনবোর্ড টাঙানো হলেও বন্ধ করা যায়নি বিএনপি-ছাত্রদলের আগ্রাসন। উপরন্তু অভিযানে গিয়ে লুটেরাদের অস্ত্রের মুখে পড়েন ইউএনও!
এভাবে নির্বিচারে মাটি কাটায় ঝুঁকির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) দুটি সীমান্ত ফাঁড়ি (বিওপি)। পদ্মায় বিলীনের পথে তীরবর্তী চারঘাটের রাওথা, গোপালপুর, পিরোজপুর ও টাংগন এলাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চারঘাট পৌরশহরের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা নদী। যেখান থেকে মাটি খনন করা হচ্ছে, সেটি পদ্মা নদীর মোহনার উত্তর পাশ। এখান থেকে খরস্রোতা বড়ালের জন্ম। স্থানীয়দের কাছে স্থানটি বালু ঘাট নামে পরিচিত। ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত ২৯৭ নম্বর দাগে ৯ দশমিক ৫০ একর জমিতে মাটি খনন না করতে সম্প্রতি চারঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লাল পতাকা আর সাইনবোর্ড টাঙিয়েছিলেন। সামাজিক বনায়নের আওতায় চারঘাটের ঐতিহ্যবাহী কিছু ঘয়ের চারা রোপণ করা হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি-ছাত্রদলের একপক্ষ সেই সাইনবোর্ড খুলে, খয়ের চারাগুলো উপরে ফেলে আবারো মাটি খনন শুরু করেছেন।
আগে আওয়ামী লীগ এখন বিএনপি-ছাত্রদল!
সরকারি ওই জমিটি এতদিন বালু মহাল হিসেবে ইজারা দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু নদী তীরবর্তী পুলিশ একাডেমি, বিজিবির চারঘাট বিওপি এবং চারঘাট বিকল্প বিওপি ঝুঁকির মুখে পড়ায় বছর তিনেক ধরে জমিটি আর ইজারা দেওয়া হয়না। তবে ইজারা দেওয়া বন্ধ হলেও সেসময় আওয়ামী লীগের লোকজন প্রভাবখাটিয়ে বালু মহাল শাসন করতেন। গত বছর আওয়ামী সরকার পতনের পর সরকারি এই জমিটির দখল নেন চারঘাট বিএনপি ও ছাত্রদলের একটা পক্ষ। নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে বালু মহালের ওই জমিটির মাটি কেটে বিক্রি করছেন তারা। কাটা পড়ছে বড়ালের তীরও।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন নেতাকর্মী জানান, হাসিনা সরকার পতনের পর থেকে বালুঘাটটি দখলে নিয়েছেন চারঘাট উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মুরাদ পাশা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক জহুরুল হক জীবন, উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মতলেবুর রহমান মতলেব। এদের মধ্যে মতলেবের নামে দেশের বিভিন্ন থানায় অস্ত্র, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও মাদকের ১২টি মামলা রয়েছে। আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
পৌর ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান সান্টু জানালেন, তিনি রাজশাহী জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বলের মতাদর্শী হলেও ‘ঘাটের মালিক মতলেব’। মতলেবের হয়েই তিনি ঘাট দেখাশুনা করছেন।
সাবেক ছাত্রদল নেতা মতলেবুর রহমান মতলেব বলছেন, ‘বিএনপির বঞ্চিত নেতাকর্মীরাই বালুঘাট তদারকি করছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা তো বালু কাটছি না। ভরাট মাটি কাটছি। ইজারা দিলে বালু কাটব।’
তবে উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মুরাদ পাশা সরকারি জমির মাটি কেটে বিক্রির বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমি কোনো হাটঘাটের সাথে নাই।’
চারঘাট উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক জহুরুল হক জীবন মোবাইল ফোনে ইত্তেফাককে বলেন, ৫ আগস্টের আগে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম, সাবেক মেয়র ইকরামুল, সাবেক প্রাণী সম্পদ মন্ত্রীর ছেলে আখতারুজ্জামান রনি সরকারি ওই বালু মহাল থেকে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করতেন। কিন্তু ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক মামলা হলে সেসব ব্যক্তিরা ২৫ শতাংশ বালু স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করে আত্মগোপনে যান। এ বিষয়ে তিনি এর চেয়ে বেশি কিছু জানেন না। সামাজিকভাবে মানহানি করতেই একটা মহল তাকে জড়িয়ে সরকারি জমির মাটি কেটে বিক্রির অভিযোগ তুলেছেন। মূলত এসব ব্যাপারে তিনি কিছু জানে না।
বালুঘাটে অস্ত্রের ঝনঝনানি
রাজনৈতিক সূত্র ও স্থানীয়রা বলছেন, বিএনপি-ছাত্রদলের অপর পক্ষও এই বালুঘাটের দখল নিয়ে মাটি বিক্রি করতে চায়। মূলত প্রতিপক্ষকে দমন করতেই দখলদার নেতাকর্মীরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পাহারায় থাকেন। বালুঘাটে গড়ে তোলা টিনের ঘরে থাকে অবৈধ অস্ত্রের মজুত। যেকোনো মানুষ ওই বালুমহালের দিকে গেলেই জেরার মুখে পড়তে হয়। দেখানো হয় ভয়-ভীতি। বিএনপি-ছাত্রদলের একটা পক্ষ বালুঘাটে এমন সশস্ত্র অবস্থান নেওয়ায় ভয়ে স্থানীয় লোকজন নদী তীরের দিকে যান না।
সরেজমিন ঘুরে
সরেজমিনে গিয়ে দেখা মিলল মাটিবাহী ড্রাম ট্রাকের। পদ্মার তীরঘেঁষা ওই জমিটি থেকে মাটি নিয়ে বিকট আওয়াজে চলছে সেসব ড্রাম ট্রাক। সমতল ভূমি কেটে অন্তত ২০ ফুট গর্ত করা হয়েছে। মাটি খনন আর ট্রাকের হিসাব রাখার জন্য নেতাকর্মীদের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে টিনের একটি ঘর। সেখানে পাওয়া যায় চারঘাট পৌর ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান সান্টু, স্থানীয় ছাত্রদল নেতা মো. ওয়াসিম এবং তাদের সহযোগী জরিব হোসেনকে।
এদের মধ্যে সান্টু জানান, তারা নদী তীরের ভরাট মাটি কেটে বিক্রি করছেন। প্রতি ট্রাক মাটি বিক্রি পাচ্ছেন ৪ হাজার টাকা। সেখানকার এক শ্রমিক সহজ সরল স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেন, রাত দিন মিলে এখান থেকে ১শ ট্রাকের ওপরে মাটি বিক্রি করেন। তবে রাতেই বেশি মাটি ওঠে। ট্রাক প্রতি ৪ হাজার টাকা হিসেবে প্রতিদিন অন্তত ৪ লাখ টাকার মাটি এখান থেকে বিক্রি করা হয়।
উপজেলা প্রশাসনের ভূমিকা
বিএনপি ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা যে জমিটি কেটে মাটি বিক্রি করছেন, সেই জমিটি বালুমহাল হিসেবে ইজারা না দিতে গত বছরের ৪ ডিসেম্বর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ হোসেন তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ করেন। ওই প্রতিবেদনে পৌর সদরের বালুমহাল ইজারা না দিয়ে ইউসুফপুর ইউনিয়নের সাহাপুরে বালুমহাল ইজারা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বালুমহালের আশেপাশে পদ্মা নদীর প্রস্থ রয়েছে ১ হাজার ২০০ মিটার। তবে ৫১৩ মিটার পর থেকেই ভারতের সীমানা। পদ্মা নদীর বাম তীর থেকে নদীর দেড় কিলোমিটার গভীরে গিয়ে বালু কাটার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু এই অংশে ৫১৩ মিটার পরেই ভারতীয় ভূখণ্ড হওয়ায় বালু কাটা বন্ধের সুপারিশ করা হয়। কয়েক দফা চেষ্টা করা হয় মাটি কাটা বন্ধের। কিন্তু প্রভাবখাটিয়ে বিএনপি-ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা এখন পর্যন্ত মাটি কেটে বিক্রি অব্যাহত রেখেছেন। গত ২০ ফেব্রুয়ারি উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ হোসেনকে নিয়ে বালু মহালটি পরিদর্শন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌস। পরিদর্শনের পর সেখানে সরকারি খাস জমির সীমানা নির্ধারণ করে লাল পতাকা টাঙিয়ে দেন। ‘এখানে মাটি কাটা যাবে না’ লেখা সংবলিত সাইনবোর্ডও টাঙানো হয়। সরকারি এই জমিটি রক্ষায় জার্মান ফেডারেল মিনিস্ট্রি ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের অর্থায়নে কিছু খয়ের গাছও রোপণ শুরু করা হয়।
অভিযানে যাওয়া ইউএনও’র সামনে অস্ত্রের মহড়া
সবশেষ গত ১১ এপ্রিল বিকালে সেখানে অভিযানে যান ইউএনও জান্নাতুল ফেরদৌস, এসি-ল্যান্ড আরিফ হোসেন ও থানার নতুন ওসি মিজানুর রহমান মাটি খননের কাজে ব্যবহৃত খননযন্ত্র বন্ধ করতে গেলে মতলেবুর রহমানের নেতৃত্বে ২০ থেকে ২৫ জন দেশিয় অস্ত্র নিয়ে তেরে আসেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে যাওয়ায় অভিযান বন্ধ করে ফিরে আসেন ইউএনও।
বিএনপি-ছাত্রদলের অস্ত্রের মুখে পড়ার বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে চারঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌস ইত্তেফাককে বলেন, বালু মহালের জমিটিতে অবৈধভাবে মাটি কেটে তা বিক্রি করা হচ্ছে। তিনি অভিযান দিয়েও বন্ধ করতে পারেননি। বাধ্য হয়ে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।