পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। এর আয়তনের ৬০ ভাগ বাংলাদেশে, আর বাকি ৪০ ভাগ ভারতে। যদি বলা হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এলাকা কোনটি? তাহলে একবাক্যে উঠে আসে সুন্দরবনের নাম। বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী, এখানে রয়েছে ৩২০ প্রজাতির পাখি। এর মধ্যে কিছু কিছু পাখি শুধু সুন্দরবনেই দেখা যায়। যেমন পুরো পৃথিবীতে মহাবিপন্ন কালোমুখ প্যারাপাখি, যার দেখা শুধু এই বনেই মেলে। এখানে বিচরণ করে চামচঠুঁটো বাটান, কুন, পালসি কুড়া ঈগল, বড় গুটি ঈগল, মদনটাকসহ অসংখ্য বিপন্ন প্রজাতির পাখি।
রয়েছে অসংখ্য পরিযায়ী ও সৈকত পাখি। বিস্তৃত প্রাকৃতিক পরিবেশ, আন্তঃদেশীয় সীমানায় অবস্থান এবং দুর্গম যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে সুন্দরবন পেয়েছে এই প্রাণিবৈচিত্র্য।বাংলাদেশের পদ্মা ও নিম্নপদ্মা অববাহিকার অঞ্চলগুলোর একটি বড় অংশ, বিশেষ করে জলাভূমি আন্তঃসীমানা এলাকায় অবস্থিত। এই আন্তঃসীমানা এলাকাগুলোর বৃহত্তর যশোর ও কুষ্টিয়া অঞ্চলে রয়েছে একাধিক বাঁওড়, বিল। এ ছাড়া বৃহত্তর রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুরে রয়েছে অসংখ্য বিল। এই বিলগুলোকে কেন্দ্র করে টিকে আছে অসংখ্য পাখি।
যাদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের আইইউসিএনের লাল তালিকায় থাকা পাখিদের একটি বড় অংশ। সাদা গলা মানিকজোড়, মদনটাক, কালো গলা মানিকজোড়, রাঙা মানিকজোড়, ছোট ধলাকপাল রাজহাঁস, বড় গুটি ঈগল, কালা মাথা কাস্তেচরা, বাংলা শকুন, দেশি গুটি ঈগল উল্লেখযোগ্য। প্রতি বছর এই বিল ও বাওড়গুলোতে আসে অজস্র পরিযায়ী পাখি। বিভিন্ন প্রজাতির বুনো হাঁস, কাস্তেচরা, ডুবুরি, মানিকজোড়, সাপপাখি, পানকৌড়ি, লাল ঠেঙ্গি, বিভিন্ন প্রজাতির সৈকত পাখি এখানকার উল্লেখযোগ্য জলচর পাখি।
বাংলাদেশের আন্তঃসীমানা এলাকাগুলোর নদীগুলো বন্যপ্রাণীর, বিশেষ করে বিপন্ন বন্যপ্রাণীর গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল। বাংলাদেশ গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা অববাহিকার একটি বদ্বীপ। এ দেশের শিরা-উপশিরার মতো প্রবহমান অসংখ্য নদনদী। পদ্মা, সুরমা, কুশিয়ারা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, মহানন্দাসহ আমাদের দেশে রয়েছে অসংখ্য আন্তঃসীমানা নদী। আর এই নদীগুলো এবং এর চরগুলো, বিশেষ করে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র এবং তিস্তা পাখিদের এক অনন্য আবাসস্থল হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের বিপন্ন প্রাণীর, বিশেষ করে পরিযায়ী পাখিদের এক বড় অংশের দেখা মেলে এই আন্তঃসীমানা এলাকার নদী ও চরগুলোতে।
শীত মৌসুমে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মা নদীর আন্তঃসীমানা এলাকাগুলোতে বসে অজস্র পাখির সমাহার। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আন্তঃদেশীয় সীমানা এলাকায় বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সেখানে প্রায় তিন শ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। এ ছাড়া কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র এবং লালমনিরহাটের তিস্তা অববাহিকার মুখেও একই রকম অবস্থা দেখা যায়।
কালো মানিকজোড়, সাদা গলা মানিকজোড়, ইউরেশীয় চামচঠুঁটি, মদনটাক, কালো গলা মানিকজোড়, রাঙা মানিকজোড়, দেশি গাঙচোষা, ছোট ধলাকপাল রাজহাঁস, বড় গুটি ঈগল, কালা মাথা কাস্তেচরা, বাংলা শকুন, শতদাগী ঘাসপাখি, দেশি গুটি ঈগল উল্লেখযোগ্য বিপন্ন প্রজাতির পাখি, যা দেশের বিপন্ন প্রজাতির পাখিদের একটি বড় অংশ। শীত মৌসুমে এই এলাকাগুলোতে আসে জলচর ও শিকারি পরিযায়ী পাখিদের একটা বড় অংশ। বিভিন্ন প্রজাতির বুনো হাঁসে ভরে যায় চরগুলো। লেঞ্জা, পাতারি, বৈরাগী, বুনো রাজহাঁস, বামুনী, ভূতি, ফুলরি, সিথি, পিয়াং, মৌলভী, মার্গেন্সার, খুন্তে, গিরিয়া, চখাচখি উল্লেখযোগ্য বুনো হাঁস।
বিভিন্ন প্রজাতির ডুবুরি, বটেরা রাতচোরা, সারস, গগনবেড়, চামচঠুঁটো, কাস্তেচরা, মানিকজোড়, বিভিন্ন প্রজাতির সৈকত পাখি (খরমা, পাকরা উল্টোঠুঁটো, জিরিয়া, টিটি, বাটান, ডানলিন, চা পাখি, রাফ, চ্যেগা, জৌরালি, গুলিন্দা, কোয়েল বাবুবাটান, পানচিল, গাংচিল), ঘাসপাখি, প্রিনিয়া, ভরত, মুনিয়া, চটক এখানকার উল্লেখযোগ্য পাখি।
দেশের সর্ব উত্তরের সীমান্তবর্তী উপজেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া। ভারতের কোলঘেঁষা এই উপজেলার সমতল ভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য চা বাগান। সবুজ শ্যামল স্নিগ্ধ প্রকৃতির বুকে বাসা বেঁধে আছে পাথরের স্তূপ। বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে আছে পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহনীয় সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ। ডাহুক, করতোয়া ও মহানন্দা নদী বিধৌত বাংলাদেশের সর্বউত্তরের তেঁতুলিয়া উপজেলাকে উত্তর, দক্ষিণ এবং পশ্চিম—এই তিন দিক থেকেই ঘিরে রেখেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ আর পূর্ব দিকে আছে পঞ্চগড় সদর উপজেলা। সৌন্দর্যের চাদরে মোড়ানো অঞ্চলটিতে প্রকৃতিপ্রেমীরা কান পাতলেই শুনতে পাবেন শত রকমের পাখির কলকাকলি।
এখানে দেখা মেলে সব মিলে ১৭৪ প্রজাতির পাখি। তেঁতুলিয়ায় পাওয়া ১৭৪ প্রজাতির পাখির মধ্যে ১২২টি প্রজাতি স্থানীয়। বাকি ৫২টি প্রজাতি শীতকালীন অতিথি পাখি, যারা আমাদের দেশে উড়ে আসে খাদ্য ও আশ্রয়ের সন্ধানে। বনছাতারে, ঘুঘু, ফিঙে, কোকিল, মুনিয়া, খঞ্জন, ছাতিঘুরানি, শ্বেতাক্ষী, কাঠঠোকরা, প্যাঁচা, পানকৌড়ি ইত্যাদি এখানকার উল্লেখযোগ্য দেশি প্রজাতির পাখি। বিভিন্ন প্রজাতির বুনো হাঁস, সৈকত পাখি, ঘাস বনের পাখি, আঁশটে দামা, পরিযায়ী গায়ক পাখি এখানকার উল্লেখযোগ্য পরিযায়ী পাখি। এখানে আরও দেখা মেলে লাল ঘাড় কাস্তেচরার।
আইইউসিএন বাংলাদেশের লাল তালিকা অনুযায়ী, এ গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যমতে বেশ কিছু ঝুঁকিগ্রস্ত প্রজাতির পাখির দেখা মিলেছে এখানে। এর মধ্যে দেশি গুটি ঈগল, চারটি সংকটাপন্ন(VU) প্রজাতির হলদে চোখ ছাতারে, বড় গুটি ঈগল, শেখ ফরিদ, মদনটাক, কালা মাথা কাস্তেচরা অন্যতম। ভারতসংলগ্ন শেরপুর জেলার শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তজুড়ে জীববৈচিত্র্যে ঘেরা গারো পাহাড় অঞ্চল।
Get the latest Zoom Bangla News first — Follow us on Google News, Twitter, Facebook, Telegram and subscribe to our YouTube channel.