ইসতিয়াক আহমেদ, ঢাবি প্রতিনিধি: প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমরা সর্বপ্রথম যে জিনিসটার খোঁজ করি, তা হলো ঘড়ি। প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিটি কাজের হিসাব রাখতে ঘড়ি ছাড়া বর্তমানে জীবন কল্পনা করাই যেন অসম্ভব। এনালগ ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দকে ছাড়িয়ে আরও নিঁখুত সময় দিতে এখন আমাদের কাছে জায়গা করে নিয়েছে আরও আধুনিক ডিজিটাল ঘড়ি। তবে প্রাচীনকালে যখন এত উন্নত প্রযুক্তি ছিল না, তখন কীভাবে সময় নির্ণয় করত মানুষ?
প্রাচীনকালে বিভিন্ন সভ্যতায় সময় গণনার জন্য সূর্যঘড়ির ব্যবহার হয়েছে। মিশরীয় সভ্যতার পাশাপাশি পারস্য, গ্রিক, রোমানদের মধ্যেও সূর্যঘড়ির ব্যবহার দেখা গেছে। কয়েক হাজার বছর ধরে, একেবারে উনবিংশ শতাব্দীর গোড়া অব্দি, সূর্যঘড়ির মাধ্যমে নিখুঁতভাবে সময় মাপা হতো।
তাই বলা যায় ঘড়ির প্রাচীনতম সংস্করণ হলো সূর্যঘড়ি বা Sundial। আকাশে সূর্যের অবস্থান ও মাটিতে এর ছায়া, এ দুইয়ের ওপর ভিত্তি করে সময়ের হিসাব নিকাশ করা হয় এই যন্ত্রে।
প্রত্নতাত্ত্বিক রেকর্ড অনুযায়ী সর্বপ্রথম সূর্যঘড়ি বা ছায়া ঘড়ি ব্যবহারের কথা জানা যায় আনুমানিক ১৫০০ খ্রীস্টপূর্বে প্রাচীন মিশরীয় ও ব্যবীলনীয় জ্যোতির্বিদ্যায়। তবে অনুমান করা হয় মানুষ তারও আগে থেকেই ছায়ার অবস্থান হিসাব করে সময় নির্ণয় করত, তবে তা প্রমাণ করা কঠিন। এমনকি ওল্ড টেস্টামেন্ট-এর ‘ঈসাইয়াহ ৩৮:৮’-তে সূর্যঘড়িকে ‘আহাজের ডায়াল’ (The Dial of Ahaz) বলে নির্দেশ করা হয়েছে।
সূর্যঘড়িতে সময় নির্ণায়ক হিসেবে একটি সরু প্রান্তবিশিষ্ট চিকন রড থাকে। সূর্যের আলোতে রাখলে এর পৃষ্ঠ দাগ কাটা ঘন্টা নির্দেশকগুলোতে ওই রডের ছায়া পড়ে। সূর্য যখন আকাশে পূর্ব থেকে পশ্চিমে সরতে থাকে, ওই রডের ছায়াও তখন বিভিন্ন ঘন্টা রেখায় অবস্থান করতে থাকে। তবে এই ঘড়িতে সময় সঠিকভাবে নিরুপণের জন্য সূর্যঘড়িকে অবশ্যই নক্ষত্রের হিসেবে উত্তরদিকে অবস্থান করে রাখতে হবে।
ভারতের কোণার্ক সূর্যমন্দিরে রয়েছে একটি সূর্যঘড়ি। পূরীর রাজধানী ভুবনেশ্বরে গেলে দেখা মিলবে এই মন্দির আর সূর্যঘড়ির। ১২৩৮ সালে কলিঙ্গের রাজা নরসিংহ দেব মন্দিরটি স্থাপন করেন।
আমাদের দেশের একমাত্র সূর্যঘড়ির দেখা পাওয়া যাবে ঢাকার ওয়ারীতে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী বলধা গার্ডেনে। দর্শণার্থীদের জন্য উন্মুক্ত এই অংশে চাইলেই যে কেউ দেখে আসতে পারবেন সূর্যঘড়ি। তবে গাছগাছালির ছায়া আর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এখন অনেকটাই অচল সেটি।
১৯০৯ সালে তৎকালীন ঢাকার বলধার (বর্তমানে গাজীপুর) জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী নির্মাণ করেন একটি মনোরম উদ্ভিদ উদ্যান। সারাবিশ্বের নানা রকম দুর্লভ উদ্ভিদ এনে সেখানে রোপণ করেছেন তিনি। এখানে প্রায় ৮০০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই এই বাগানের সৌন্দর্যবর্ধন করে আসছে বাগানের সূর্যঘড়িটি। প্রতিবছরই ঘড়িটি সংস্কার করা হলেও দর্শণার্থীরা এর উপর বসে ছবি তোলার কারণে ঘন্টা রেখার দাগগুলো কিছুটা মিশে গিয়েছে৷
এই সূর্যঘড়িতে কম্পাসের ফলার মতো আনুভূমিক লোহার পাত রয়েছে। লোহার পাতের নিচে একটি অর্ধ-গোলাকার চাকতিতে ছায়া পড়ে। ১৮০ ডিগ্রি কোণে বাঁকানো এ চাকতির ভেতরের ছয় থেকে ১৯ পর্যন্ত অঙ্ক-দাগাঙ্কিত আছে। দাগগুলোর চিহ্ন নির্দেশক সংখ্যাগুলো ঘণ্টা নির্দেশক হিসেবে ব্যবহার হয়। সূর্যঘড়ির লোহার পাতটির ওপর সূর্যের আলো পড়লে তার ছায়া অর্ধগোলাকার চাকতির যে অঙ্কের ওপর পড়ে তখন ততটা বাজে। এর পাশে আর একটি ছোট আকৃতির মিনিট নির্দেশক রয়েছে। সূর্যের অবস্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর ছায়ার অবস্থানেরও পরিবর্তন ঘটে। আর ছায়ার অবস্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সময়েরও পরিবর্তন হয়।
বলধা গার্ডেনের দুটি অংশ রয়েছে; সাইকি ও সিবিলি। তার মধ্যে সাইকিতে সাধারণ দর্শণার্থীদের প্রবেশ নিষেধ। এ উদ্যানের সিবিলি অংশেই দেখা মিলবে সূর্যঘড়ির। এছাড়াও রয়েছে আশোক, নাগকেশর, ম্যাগনোলিয়া, অনিন্দ্যসুন্দর ক্যামেলিয়াসহ নানা রকম দেশি বিদেশী দূর্লভ সব উদ্ভিদ। এই বলধা গার্ডেনে এসেই ক্যামেলিয়া ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতাটি রচনা করেছিলেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।