সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি শায়খ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আলে শাইখ গত মঙ্গলবার ইন্তেকাল করেছেন। তিনি ছিলেন সমকালীন ইসলামি বিশ্বে অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি। এই আলেমের জীবন ও কর্মধারা সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বে বিশেষভাবে আলোচিত। তিনি শুধু একজন ফকিহ বা মুফতি ছিলেন না, বরং রাষ্ট্রীয় নীতি ও ধর্মীয় প্রভাবের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন এক অন্যতম মুখপাত্র ছিলেন।
১৯৪৩ সালের ৩০ নভেম্বর মক্কা নগরীতে তার জন্ম। তিনি আলে আশ-শাইখ পরিবারভুক্ত, যারা মুহাম্মদ বিন আবদুল ওহাবের বংশধর। এই পরিবার বহু প্রজন্ম ধরে সৌদি আরবের ধর্মীয় নেতৃত্বে আসীন। খুব অল্প বয়সেই তিনি পিতৃহীন হন এবং শৈশব থেকেই জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে শুরু করেন। জন্ম থেকেই তার দৃষ্টিশক্তি দুর্বল ছিল। মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি সম্পূর্ণ দৃষ্টি হারান। দৃষ্টিহীন হয়েও তিনি নিরলস সাধনায় হয়ে ওঠেন সমসাময়িক যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম।
কোরআন মুখস্থ করার মাধ্যমে তার প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা হয়। পরে তিনি শরিয়তের শিক্ষায় অগ্রসর হন। তিনি সৌদি আরবের নামকরা আলেমদের কাছে তাফসির, ফিকহ, আকিদা ও আরবি ভাষাশিক্ষা গ্রহণ করেন।
শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৬৫ সালে রিয়াদের ইমাম দাওয়াহ ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু হয়। পরে তিনি ইমাম মুহাম্মদ বিন সৌদ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শরিয়াহ কলেজে অধ্যাপনা করেন। পাশাপাশি তিনি রিয়াদ ও মক্কার গুরুত্বপূর্ণ মসজিদগুলোতে ইমামতি ও জুমার নামাজ পড়ান। ১৯৮৭ সালে তিনি সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হাইআতু কিবারিল উলামার সদস্য হন। ১৯৯১ সালে স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং ১৯৯৫ সালে গ্র্যান্ড মুফতির উপদেষ্টা পদে উন্নীত হন। ১৯৯৯ সালে গ্র্যান্ড মুফতি শায়খ আবদুল আজিজ বিন বাজের মৃত্যুর পর কিং ফাহদের নির্দেশে তিনি গ্র্যান্ড মুফতি নিযুক্ত হন। এরপর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় গ্র্যান্ড মুফতি হিসেবে শায়খ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আলে শাইখ অসংখ্য ফতোয়া দিয়েছেন। এর মধ্যে কিছু বিশ্ব জুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তার সেসব ফতোয়ার যেমন সমর্থক ছিল, তেমনি সমালোচকও কম ছিল না।
রাষ্ট্রীয় ঘটনাপ্রবাহেও তার বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। ২০১৫ সালের হজে মিনা দুর্ঘটনায় যখন বহু হাজি নিহত হন, তখন তিনি সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন নায়েফকে দায়মুক্ত ঘোষণা করে বলেন, এটি মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এবং আল্লাহর দেওয়া তাকদির। এ বক্তব্য অনেকের কাছে ক্ষমতাসীনদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট মনে হয় এবং সৌদি প্রশাসনিক কাঠামোতে ধর্মীয় কর্র্তৃত্ব ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আবার ২০১৬ সালে তিনি ইরানি নেতৃত্বকে অমুসলিম আখ্যা দিয়ে কড়া সমালোচনা করেন, যা সৌদি-ইরান দ্বন্দ্বকে আরও প্রকট করে।
ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারে তার অবদানও উল্লেখযোগ্য। তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন, যার মধ্যে ফতোয়া সংকলন, আকিদা, ফিকহ ও ইবাদতের বিধান সম্পর্কিত বই রয়েছে। তিনি রেডিও ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে দীর্ঘদিন মানুষের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তার লেখা ও খুতবায় কোরআন-সুন্নাহর প্রতি দৃঢ় আনুগত্যের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
২০২৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তিনি ৮৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। প্রায় আড়াই দশক সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর তার প্রয়াণে দেশটির ধর্মীয় অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে।
শায়খ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আলে শাইখের জীবন ছিল একদিকে একনিষ্ঠ আলেমের, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় কর্র্তৃত্বের ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর। তার কর্ম ও ফতোয়া কখনো ইসলামি চিন্তার মূলস্রোতে আলোচিত, আবার কখনো সমালোচনার ঝড় তুলেছে। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই, আধুনিক সৌদি আরবের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন গঠনে তার ভূমিকা ছিল গভীর ও প্রভাবশালী।
লেখক:মাদ্রাসাশিক্ষক ও ধর্মীয় নিবন্ধকার
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।