আন্তর্জাতিক ডেস্ক: খাশগজি হত্যার কারণে তিন বছর আগে চরম ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছিলেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। কিন্তু সৌদি রাজপুত্র হিসেবে তাঁর পাঁচ বছর পূর্তির সময়ে পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশ্বনেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকে ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটছে তাঁর।
সৌদি রাজ পরিবারের ‘ক্রাউন প্রিন্স’ হিসেবে সালমানের অভিষেক হয়েছিল ২০১৭ সালের ২১ জুন৷ গত মঙ্গলবার, অর্থাৎ মাত্র দু’ দিন আগেই অভিষেকের পাঁচ বছর পূর্ণ হলো।
পাঁচ বছর পূর্তির সময়টা দারুণ কাটাচ্ছেন ৩৬ বছর বয়সি সৌদি যুবরাজ। কে বলবে ২০১৮ সালের অক্টোবরে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনসুলেটে জামাল খাশগজি নিহত হওয়ার পর এই সালমানই ভয়ঙ্কর দুর্বিপাকে পড়েছিলেন! কে বলবে তখন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী সমস্বরে এবং প্রায় একই সুরে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো সৌদি সাংবাদিক খাশগজি হত্যার ‘মূল হোতা’ সন্দেহে সালমানের বিরুদ্ধে লাগাতার তোপ দেগেছেন!
গত কিছুদিনে দু বছর আগের সেই সমালোচকদের সঙ্গেই তো গুরুত্বপূ্র্ণ সব বৈঠক করেছেন মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস)।
চলতি সপ্তাহের শুরুতে কায়রোতে বসেছিলেন মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ এল-সিসির সঙ্গে৷ পরের বৈঠকটা ছিল আম্মানে, জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আব্দুল্লাহর সঙ্গে৷ তারপর বুধবার সালমানের রাজকীয় বিমান নেমেছে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায়, হ্যাঁ, এবার সেই রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ানের সঙ্গেই বৈঠক, যিনি খাশগজি হত্যার পর কড়া কড়া কথা বলেছিলেন বিস্তর।
তুরস্কের অর্থনীতি এখন ধুঁকছে। অন্যদিকে এগিয়ে আসছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। খাশগজি হত্যার পর সৌদি আরব আর তুরস্কের বাণিজ্যিক সম্পর্কে চরম অবনতি ঘটে। তুরস্কের পণ্য আমদানি ভয়াবহভাবে কমিয়ে দেয় সৌদি আরব। ২০২১ সালে আগের বছরের তুলনায় ৬২.৩ ভাগ কমে আমদানি ৩.৩২ বিলিয়ন রিয়ালে (৮৮৬ মিলিয়ন ডলার) গিয়ে ঠেকলে নড়েচড়ে বসে এর্দোয়ান প্রশাসন।
ফলে খাশগজি হত্যাকে ঘিরে সৌদি আরবের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বড় হয়ে ওঠা প্রশ্নটা সরাসরি আর না তুলে একটু ভিন্ন কৌশলে যায় আঙ্কারা। রিয়াদের সমালোচনার ধার কমতে থাকে।
গত এপ্রিলে খাশগজি হত্যাকাণ্ডের ২৬ সৌদি সন্দেহভাজনের মামলা আঙ্কারা থেকে চলে যায় রিয়াদের আদালতে। সেই মাসে এর্দোয়ানও যান সৌদি আরব সফরে।
ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ের ভিজিটিং ফেলো সিন্সিয়া বিয়াঙ্কো মনে করেন, ‘‘খাশগজি হত্যার পর আরব বিশ্বে মোহাম্মদ বিন সালমানের ভাবমূর্তি যে ভীষন খারাপ হয়ে গিয়েছিল, তার পেছনে এর্দোয়ানের খুব বড় ভূমিকা ছিল।”
কিন্তু তুরস্কের অর্থনীতি এবং আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সৌদি আরবের প্রতি এর্দোয়ানের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারে বদলে দিয়েছে। বুধবার তুরস্ক সফর শুরু করেছেন পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমে ‘এমবিএস’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠা মোহাম্মদ বিন সালমান৷ এ সফরে দু দেশের মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সাক্ষর হওয়ার কথা।
খাশগজি হত্যার তিন বছর পূর্তির আগে শুধু তুরস্ক, মিশর আর জর্ডানই নয়, যুক্তরাষ্ট, ফ্রান্সসহ পাশ্চাত্যের অনেক দেশেরই ‘সৌদি-নীতি’ বদলেছে। খাশগজি নিহত হওয়ার পর হত্যাকাণ্ডের ‘সন্দেহভাজন নির্দেশদাতা’ হিসেবে আকারে-ইঙ্গিতে সালমানের বিরুদ্ধে অনেক তোপ দেগেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান, তবে সরাসরি নাম উল্লেখ করে কখনোই কিছু বলেননি৷ এক্ষেত্রে জো বাইডেন ছিলেন ব্যাতিক্রম।
প্র্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় খাশগজি হত্যার কারণে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বহুবার বলেছেন তিনি। নির্বাচিত হবার পর সালমানের সঙ্গে বৈঠকে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর তার অবস্থানও বদলেছে।
আগামী ১৫ জুলাই তাই সৌদি আরব সফরে যাচ্ছেন বাইডেন। বলা বাহুল্য, দু’ দিনের সেই সফরে এমবিএস-এর সঙ্গে বসে দীর্ঘ আলোচনায় অংশ নিতে হবে তাকে।
খাশগজি হত্যার পর ভাবমূর্তি পূনরুদ্ধারের কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন মোহাম্মদ বিন সালমান।
জার্মানিভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক সেন্টার ফর অ্যাপ্লায়েড রিসার্চ-এর বিশেষজ্ঞ সেবাস্টিয়ান সন্স মনে করেন, এই মুহূর্তে সেই চ্যালেঞ্জে সালমান নিজেকে পুরোপুরি জয়ী দাবি করতেই পারেন।
সন্স ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাইডেন তার (সালমান) কাছে আসবেন, মাক্রোঁ ইতিমধ্যে ঘুরে এসেছেন, বরিস জনসনও গিয়েছিলেন সেখানে। তাই বলা যেতে পারে, খাশগজি হত্যাকে যারা খুব বড় সমস্যা হিসেবে দেখেছিলেন, তারাই কিন্তু তাকে (সালমান) আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে একরকমের গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে দিলেন। এটা তার জন্য বিশাল এক জয়৷ এই জয়কে তিনি নিশ্চয়ই ঘরোয়া রাজনীতি এবং প্রোপাগান্ডা চালানোর কাজে ব্যবহার করবেন।”
(ডয়চে ভেলে)
Own the headlines. Follow now- Zoom Bangla Google News, Twitter(X), Facebook, Telegram and Subscribe to Our Youtube Channel