জুমবাংলা ডেস্ক : পাঁচ বছর আগে বিদেশি জাতের একটি আমগাছ দিয়ে ছাদবাগান শুরু করেন রেজিনা সাফরীন। ইন্দোনেশিয়ার ‘কিং অব চাকাপাত’ নামের ওই গাছটি পেতে তাকে গুনতে হয় চার হাজার টাকা। শখ-সাধ্য আর পছন্দকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে মুকুলসহ আম গাছটি কিনে বিপাকে পড়েন তিনি। কারণ বেশি দামি গাছ কেনায় পরিবারের লোকজন তাকে নিয়ে হাসাহাসি করেন। কিন্তু বছর না যেতেই কিং অব চাকাপাত গাছের ফলনে সবার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। চার হাজারে কেনা গাছটিতে প্রায় আধা মণ আম ধরে। যার মূল্য ছিল ২০ হাজার টাকার উপরে। এরপর আর থেমে থাকেননি তিনি।
এখন রেজিনা সাফরীনের ছাদবাগানে রয়েছে দেশি-বিদেশি ১৮টি জাতের আমগাছ। এছাড়া রয়েছে নানা জাতের শাকসবজি, ফুল ও ফলের গাছ। রয়েছে ঔষধি গাছও। ২০১৮ সালে শুরু করা এ ছাদবাগানে এখন পর্যন্ত তার খরচ সাড়ে চার লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। আর তার এই ছাদবাগান থেকে বছরে দেড় লাখ টাকার মতো টাটকা ও বিষমুক্ত ফল ও সবজি মিলছে।
প্রায় নয় শতাংশ জমির উপর নির্মিত পাঁচতলা ভবনের ছাদে থাকা বাগানটির আয়তন ৩ হাজার স্কয়ার ফিট। এতে গাছগাছালি ছাড়াও রয়েছে কবুতর পালনের আলাদা শেড। অনেকেই তার কাছ থেকে ছাদবাগানের পরামর্শ নিতে আসেন।
রংপুর নগরীর মুন্সিপাড়া এলাকার বাসিন্দা রেজিনা সাফরীন। তিনি মর্নিং গ্লোরি চিলড্রেন্স স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল। এর পাশাপাশি তিনি দীর্ঘদিন ধরে রংপুর জেলা শিশু একাডেমিতে আবৃত্তি প্রশিক্ষক, রংপুর বেতার কেন্দ্রে সংবাদ পাঠক ও উপস্থাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রায় দশ বছর রেজিনা সাফরীন স্বামীর সঙ্গে ইরানে ছিলেন। তার স্বামী চিকিৎসক মো. ইসপাহাক। সংসারে দুই সন্তানের মধ্যে মেয়ে চিকিৎসক সুমায়রা সাফরীন ঢাকায় মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। আর ছেলে মেজর তাওহীদ ইব্রাহীম ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আছেন। বর্তমানে দেশে পরিবার ও ব্যক্তিগত কাজের পাশাপাশি ছাদবাগানের পরিচর্যার মধ্য দিয়ে অন্যরকম পরিতৃপ্তি অনুভব করতে পেরে আনন্দিত সফল এই নারী।
সম্প্রতি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে ছাদবাগানের আদ্যোপান্ত নিয়ে কথা বলেন রেজিনা সাফরীন। তিনি জানিয়েছেন তার শখ, স্বপ্ন আর সফলতার কথা। জানিয়েছেন কীভাবে ছাদবাগান গড়েছেন, কোন কোন জাতের গাছ লাগিয়েছেন এবং পরিচর্যার কথা।
২০১৮ সালে রংপুর জিলা স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত বৃক্ষমেলার একটি স্টলে মুকুলসহ বিদেশি জাতের কিং অব চাকাপাত ম্যাংগো গাছ দেখে ভালো লাগে তার। সেখান থেকেই ছাদবাগান গড়ার শখ হয় রেজিনা সাফরীনের। ওই বছরেই গড়ে তোলেন ছাদবাগান। ধৈর্য ধরে নিয়মিত পরিচর্যা করে এখন তিনি সফল ছাদবাগানি। শুরুতে পরিবার থেকে ছাদে বাগান গড়তে অনীহা থাকলেও পরে তার স্বামী ও সন্তানরা উৎসাহ জুগিয়েছেন।
তিনি আরও জানান, ছাদবাগান থেকে নিয়মিত ফল ও শাকসবজি পাওয়ায় তাকে আগের মতো বাজারমুখী হতে হয় না। বরং নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের মাঝেও বিতরণ করেন। স্বল্প খরচে দেশি-বিদেশি গাছের চারা দিয়ে তিনি ছাদবাগানটি সুন্দর করে সাজিয়েছেন। তার এই বাগান দেখতে প্রতিবেশীদের পাশাপাশি অনেক দর্শনার্থীরাও প্রতিনিয়ত আসছেন।
রেজিনা সাফরীন বলেন, আমার বাগানে সারা বছর শাকসবজি ও ফলমূল থাকে। আমি স্কুল ছাড়া ব্যক্তিগত বিভিন্ন কাজ শেষ করে যখনই সময় পাই ছাদের উপরে চলে আসি। সকালে ও বিকেলে বাগানের পরিচর্যা করি। তবে বেশির ভাগ সময় আমার স্বামী বাগানের দেখাশুনা করে থাকে। বাগান থেকে যেসব ফল ও শাকসবজি পাচ্ছি সবই ফরমালিনমুক্ত। সব বিষমুক্ত এবং টাটকা-সতেজ।
তার ছাদবাগানে রয়েছে- ইন্দোনেশিয়ার কিং অব চাকাপাত ম্যাংগো, থাইল্যান্ডের মহিলিসা ম্যাংগো, আপেল ম্যাংগো, থ্রি টেস্টেড ম্যাংগো, ভারতের চোষা ম্যাংগো, ভিয়েতনামের কিউজি ম্যাংগো, মালয়েশিয়ার আইভরি রেড ম্যাংগো, জাপানের আমেরিকান ক্যান্ট ম্যাংগো, বাংলাদেশের আম্রপালি, হাঁড়িভাঙা, খিরসাপাত, বারি-৪, বারি-৮, বারি-১২, মল্লিকা, গোপালভোগসহ বারোমাসি আম। এছাড়া আছে সিঙ্গাপুরী মালটা, মালয়েশিয়ান মালটা, থাই মালটা, থাই জম্বুরা, থাই শরিফা, কাগজি লেবু, ইক্ষু, জাম গাছ, আনার, আলু বোখারা, সাউথ ইস্ট আমেরিকান চেরি, সিঙ্গাপুরী চেরি, মালবেরি, রেড লেডি পেঁপে, টক জলপাই, মিষ্টি জলপাই, তেঁতুল, ড্রাগন ফল।
শুরুতে একটু কষ্ট হয়েছে, এখন তার সুফল পাচ্ছেন জানিয়ে রেজিনা সাফরীন বলেন, আমার বাগানের বেশির গাছ বিদেশি জাতের। এখন ধৈর্যের ফল পাচ্ছি। প্রতি বছর রাসায়নিক ও বিষমুক্ত শাকসবজি ও ফল খাচ্ছি। এতে আমার বাজারনির্ভরতা কিছুটা কমে এসেছে। পরিবারের পুষ্টির চাহিদা মিটছে, সঙ্গে আর্থিক সাশ্রয়ও হচ্ছে। বাগানে বারোমাসি আম ছাড়াও ১৮ জাতের আম গাছ রয়েছে। গত বছর প্রচুর আম ধরেছিল।
তিনি আরও বলেন, কিং অব চাকাপাত ম্যাংগো খুব দামি। একেকটা আম পরিপক্ব হলে এক থেকে দেড় কেজি ওজন হয়ে থাকে। বাইরে এই আমের কেজি ১ হাজার টাকার উপরে। এ আম খুব মিষ্টি হয়। আমার বোন একবার খাগড়াছড়ি থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ৫টি আম কিনে এনেছিল। তখনই বুঝতে পারি এই আম খুব লাভজনক, যদিও আমরা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছি না। তবে লাখ টাকার মতো আম এই ছাদবাগান থেকে পাচ্ছি। নিজেরা তো খাচ্ছি পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী এবং সন্তানদেরও দিচ্ছি।
আম ছাড়াও রেজিনা সাফরীনের ছাদে রয়েছে লাল-হলুদ-সবুজ কাপ সিকাম, টমেটো, চেরি টমেটো, গোলাপজাম, জামরুল ও মেহেদী গাছ। ফুলের মধ্যে আছে নীলপদ্ম, শিউলি, গোলাপ, টগর, গন্ধরাজ, বেলি, থাই কাঠগোলাপ, কামিনী, হাসনাহেনা, মাধবীলতা ও পেকালয়েট ফ্লাওয়ার। শীতে ডালিয়া, গাঁদা, সূর্যমুখী ফুলও থাকে। বিদেশি লাল কলা, মালভোগ কলা, সাগর কলা ছাড়া পুঁইশাক, পালংশাক, লালশাক, কচুশাক, ঢেড়স, রসুন, আদা, হলুদ, আলু, পেঁয়াজ, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া চাষ করা হয়।
স্কুলশিক্ষক রেজিনা বলেন, এটা আমার শখের বাগান, লাভ-লোকসানের হিসাব তেমন করি না। তবে বাগানে অবসর সময় কাটিয়ে এবং ভালো ফলন দেখে মনে প্রশান্তি খুঁজে পাই। বাড়ির ছাদ ফাঁকা না রেখে ছোট পরিসরে হলেও বাগান করা উচিত। এতে শুরুতে একটু কষ্ট হলেও পরে মনমানসিকতা বদলে যাবে। বিশেষ করে যখন গাছে গাছে ফুল, ফল, সবজি দেখবেন, তখন অন্য রকম অনুভূতি কাজ করবে। তাছাড়া ফরমালিনমুক্ত নিরাপদ ফল এবং সবজির জন্য ছাদবাগান এখন বেশি গুরুত্ব বহন করছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যা বলছে
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে ছাদবাগান। ছাদবাগান ব্যস্ত নগর জীবনে একটু প্রশান্তির ছোঁয়া এনে দিতে পারে। গ্রামীণ আবহ আর টাটকা ফল-সবজির জুড়ি নেই ছাদবাগানে। রংপুরে ছোট-বড় মিলে সাড়ে চার শতাধিক ছাদবাগান রয়েছে। এ সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এতে বিপন্ন প্রকৃতির মাঝে সবুজের বিপ্লব ঘটছে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, ছাদবাগান ব্যয়বহুল হলেও শৌখিন বাগানিরা গড়ে তুলছেন। কেননা, ছাদবাগান থেকে কীটনাশক ও বিষমুক্ত ফল ও সবজি উৎপাদন করা সম্ভব। তাছাড়া গাছের প্রতি ভালোবাসা থেকে বাড়ির ছাদে ফল, সবজি ও ফুলের বাগান করে পরিবারের পুষ্টি চাহিদা মেটাচ্ছেন অনেকে।
তিনি আরও বলেন, ছাদবাগান থেকে প্রায় বারো মাসই ফল ও সবজির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা ছাদবাগানের পরামর্শ দিয়ে থাকি। ভবিষ্যতে ছাদবাগানের মাধ্যমে পুষ্টি নিরাপত্তা পূরণ হবে।
ছাদবাগানে আগ্রহীদের উদ্দেশ্যে ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, যাদের নিজের ছাদ পড়ে আছে, তারা ছাদবাগান করতে পারেন। এই বাগানে অল্প খরচে ফলন ভালো পাওয়া যায়। অবসর সময়টুকু ছাদবাগানে খরচ করুন, এতে সময় কাজে লাগবে। কারণ এখন ফসলি জমি কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে কংক্রিটের শহরে গাছ লাগানোর মতো জায়গা পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে। তাই যেকোনো জায়গার উপযুক্ত ব্যবহার করা ইতিবাচক দিক। আগে প্রয়োজন খোলামেলা জায়গা। হোক সেটা ছাদ কিংবা বারান্দা। যাতে সেখানে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো আসতে পারে। এর সঙ্গে মিলে দরকার অদম্য ইচ্ছাশক্তি। এই দুইয়ের মিশ্রণে কংক্রিটের ছাদ জুড়ে হতে পারে সবুজের সমারোহ।
ছাদবাগান করতে যা প্রয়োজন
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, ছাদবাগান করতে ড্রাম, সিমেন্ট বা মাটির টব, প্লাস্টিক ট্রে, জিওব্যাগ ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। বেলে-দোঁআশ মাটি বা লাল মাটি, পচা-শুকনা গোবর ও কম্পোস্ট, বালু ও ইটের খোয়া ইত্যাদি ব্যবহার করতে হয়। ছাদবাগানে ছোট আকারের গাছে বেশি ফল ধরে। বেঁটে প্রজাতির বর্ধনশীল ফল প্রদানকারী গাছই ছাদবাগানের জন্য উত্তম। কলমের চারা লাগালে দ্রুত ফল পাওয়া যায়।
ছাদবাগানে যে ধরনের গাছ দরকার
ছাদবাগানে যেসব গাছ ভালো জন্মে বারি আম-৩ (আম্রপালি), বারি আম-৪, বাউ আম-২ (সিন্দুরী), পেঁপে, আতা, শরিফা, আঙুর, বাতাবিলেবু, কুল, সফেদা, ছোট জাতের কলা, ছোট জাতের আনারস, কামরাঙা, জলপাই, পেয়ারা, করমচা, ডালিম, কমলা, মাল্টা, জামরুল ইত্যাদি। শাকসবজি মধ্যে লালশাক, পালংশাক, মুলাশাক, ডাঁটাশাক, কলমিশাক, পুঁইশাক, লেটুস, বেগুন, টমেটো, ঢ্যাঁড়স, চুকুর, ক্যাপসিকাম, শিম, বরবটি, শসা, করলা ইত্যাদি।
মসলাজাতীয় ফলনে রয়েছে মরিচ, ধনেপাতা, বিলাতি ধনিয়া, পুদিনা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, গোলমরিচ, পাম ইত্যাদি। ঔষধি গাছের মধ্যে অ্যালোভেরা, তুলসী, থানকুনি, চিরতা, স্টিভিয়া, গাইনোরা ইত্যাদি। ফুল জাতীয় গাছের মধ্যে গোলাপ, বেলি, টগর, জুঁই, গন্ধরাজ, জবা, টিকোমা, জারবেরা, শিউলি, এলামন্ডা, বাগান বিলাস ইত্যাদি ফুল ভালো জন্মে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।