তাকী জোবায়ের : গত দুই মাস ধরে অস্থিরতা চলছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইওকে ৩ মাসের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো, এর প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে ৭ পরিচালকের চিঠি পাঠানো, এমডিকে কাজে ফেরাতে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ।
এসবের মধ্যেই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেল, মার্কেন্টাইল ব্যাংকে চাকরিকালে প্রায় ১১ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় মতিঝিল থানায় করা দুদকের মামলায় স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি মো. হাবিবুর রহমানসহ তিনজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। তবে ‘মিথ্যাভাবে’ তাকে এই মামলায় ফাঁসানো হয়েছে বলে জুমবাংলা’কে বলেছেন হাবিবুর রহমান।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপ-সহকারি পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ঢাকার সিনিয়র বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন গত রবিবার (২৮ এপ্রিল) এই পরোয়ানা জারি করেছেন। চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি তিনি ৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছিলেন।
মামলার চার্জশিট থেকে জানা যায়, এই মামলার অন্যতম আসামী হাবিবুর রহমান ২০০০-২০০৩ সালে মার্কেন্টাইল ব্যাংকে কর্মরত অবস্থায় ব্যাংকের গ্রাহক প্যাট্রিক ফ্যাশনস লি: এর নামে ঋণ প্রস্তাবের সুপারিশ করেন। এবং পরবর্তীতে পুনঃতফসিলের সুপারিশ করেন। তিনি উক্ত ব্যাংকের ক্রেডিট ডিভিশনের তৎকালীন ইনচার্জ হিসেবে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নির্বাহী কমিটির সভায় প্যাট্রিক ফ্যাশনসের সিআইবি রিপোর্ট সম্পর্কিত অসত্য তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করান। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি না পাওয়ায় উক্ত ঋণ প্রস্তাবের মঞ্জুরিপত্র ইস্যু করেনি মার্কেন্টাইল ব্যাংক। মঞ্জুরিপত্র ছাড়াই কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে ওই প্রতিষ্ঠানকে ৭ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ঋণ দেন হাবিবুর রহমান। পরবর্তীতে তিনি ওই ঋণ পুনঃতফসিলের জন্যও সুপারিশ করেন। ঋণের সুদ বাবদ ৩ কোটি ৭১ লাখ ৩ হাজার টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক। ওই ঋণ আত্মসাতের ঘটনায় সব মিলিয়ে ১১ কোটি টাকা হারিয়েছে ব্যাংকটি। ঘটনার সময় মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ক্রেডিট ডিভিশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্টের (এভিপি) দায়িত্বে ছিলেন হাবিবুর রহমান।
প্রায় ১৫ বছর পর এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসলে ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর দুদকের তৎকালিন সহকারি পরিচালক (বর্তমানে উপ-পরিচালক) মো: জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে হাবিবুর রহমান সহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় মামলা করেন। মামলার চার্জশিটে ৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এরা হলেন, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান, ঋণ গ্রহিতা প্রতিষ্ঠান ‘প্যাট্রিক ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফরহাদ হোসেন, ব্যাংকটির তৎকালিন অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ফরেন এক্সচেঞ্জ ইনচার্জ কাজী জাহিদ হাসান, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের তৎকালিন সিনিয়র এসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও শাখা ম্যানেজার নবী-উস- সেলিম, মো: রবিউল ইসলাম। এদের মধ্যে হাবিবুর রহমান, কাজী ফরহাদ ও কাজী জাহিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।
ঋণ আত্মসাতের ঘটনায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিষয়ে জানতে চাইলে মো. হাবিবুর রমহান মুঠোফোনে জুমবাংলা’কে বলেন, ‘আমাকে এই মামলায় মিথ্যাভাবে ফাঁসানো হয়েছে। বিষয়টি আমি আইনীভাবে মোকাবেলার চেষ্টা করছি।’
এখনো তিনি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন কি না- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দুই তিন দিন পরে এই বিষয়ে আপনাকে জানাতে পারবো।’
তবে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজবা উদ্দিন আহমেদ মুঠোফোনে জুমবাংলা’কে জানিয়েছেন, মো. হাবিবুর রহমান এখনও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও’র দায়িত্বে রয়েছেন।
হাবিবুর রহমানকে নিয়ে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে অস্থিরতা
২০২৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে তৃতীয় প্রজন্মের শরিয়াহ্ ভিত্তিক এই ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদে আছেন মো. হাবিবুর রহমান। এর আগে তিনি ইউনিয়ন ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) এবং তার আগে এনসিসি ব্যাংক ও যমুনা ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া মার্কেন্টাইল, প্রাইম ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
যোগদানের মাত্র এক বছরের মাথায়ই ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নিয়ে পরিচালনা পর্ষদে অস্বস্তি ও বিভক্তির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে হাবিবুর রহমানকে বাধ্যতামূলক ছুটির ঘটনায়। গত ৩ মার্চ তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে ও প্রতিকার চেয়ে গত ১৪ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি দেন স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৭ পরিচালক। ওই চিঠি থেকে উঠে আসে হাবিবুর রহমানকে ছুটিতে পাঠানোর ঘটনার বিস্তারিত।
চিঠিতে ব্যাংকের পরিচালকরা জানান, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ অসুস্থ থাকায় ৩৮৮তম পর্ষদ সভার সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন ভাইস চেয়ারম্যান মনজুর আলম। প্রায় দুই ঘণ্টা সভা চলার পর পরিচালক কাজী খুররম আহমেদ জরুরি কথা আছে জানিয়ে সভা থেকে ব্যাংক এমডি হাবিবুর রহমান ও ডিএমডি মোহন মিয়াকে বের করে দেন।
এমডি ও ডিএমডি বাইরে গেলে কাজী খুররম হঠাৎ বলতে শুরু করেন, ‘আমার নিকট একটি চিঠি এসেছে, আমাদের এমডি সাহেব জামায়াতে ইসলামীর লোক এবং উনি মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িত। বিদেশে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছেন। উনাকে এ ব্যাংকে রাখা যাবে না। এই মুহূর্ত থেকেই উনাকে ছুটিতে পাঠাব এবং ডিএমডি মোহন মিয়া ওনার দায়িত্ব পালন করবেন। উনাকে ব্যাংকে রাখলে ব্যাংকের ইমেজ নষ্ট হয়ে যাবে এবং যেকোনো মুহূর্তে পুলিশ আমাদের গ্রেপ্তার করতে পারে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগ দায়েরকারী পরিচালকরা বলেছেন, ‘পরিচালক কাজী খুররমই হাবিবুর রহমানকে এমডি হিসেবে নিয়োগের বিষয়ে প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন এবং আমরা পরবর্তীতে সম্মতি প্রদান করি।’
চিঠিতে পরিচালকরা জানান, পর্ষদ সভায় এমডিকে জোরপূর্বক ছুটিতে পাঠানোর খুররমের প্রস্তাবে দুজন পরিচালক তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং দুজন পরিচালক সম্মতি না থাকায় নীরব থাকেন। সভায় উপস্থিত দুজন স্বতন্ত্র পরিচালক কাজটি ঠিক হয়নি বলে মন্তব্য করেন। ওই সভায় ১৫ জন পরিচালক অংশগ্রহণ করেন, যাদের মধ্যে ৫ জন অনলাইনে অংশগ্রহণ করেন। অনলাইনে অংশগ্রহণকারী পরিচালকরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তড়িঘড়ি করে সভা শেষ করে দেন কোম্পানি সচিব (চলতি দায়িত্ব) আলী রেজা।
৩৮৮তম পর্ষদ সভার পর ৩ মার্চ কাজী খুররমের একক সিদ্ধান্তে এমডি হাবিবুর রহমানকে তিন মাসের জোরপূর্বক ছুটিতে পাঠানো হয়।
যদিও এমডির বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের বিষয়ে পর্ষদ সভায় এজেন্ডা আকারে না এনে বিবিধ বিষয়ে আলোচনা করার বিষয়টি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে বলে জানান অভিযোগকারী পরিচালকরা। সভায় সর্বসম্মতিতে সিদ্ধান্ত না হওয়ার পরও একজন পরিচালকের জোরপূর্বক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া নিয়মমাফিক হয়নি বলেও প্রতিবাদ জানিয়েছেন তারা। সভার একপর্যায়ে এমডিকে ছুটিতে পাঠানোর বিষয়টি মূল চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিনের উপস্থিতিতে সুরাহার প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। এমডিকে জোরপূর্বক ছুটিতে পাঠানোর ব্যাপারে গত ২৭ ফেব্রুয়ারির বিআরপিডি সার্কুলার নম্বর ৫ যথাযথভাবে পরিপালন করা হয়নি বলে চিঠিতে জানান পরিচালকরা।
এই ঘটনায় স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ ও তার ছেলে ওই ব্যাংকের পরিচালক কাজী খুররম আহমেদকে তলব করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমডিকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর কারণ জানতে চাইলে সন্তোষজনক কোন জবাব দিতে পারেননি তারা। পরে এমডিকে পুনঃবহালের নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসময় তাদেরকে জানিয়ে দেওয়া হয়, এ ধরণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংককে অবগত করতে হবে। এমডি নিয়োগ অপসারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যংকের নির্দেশনার পর হাবিবুর রহমানের বিষয়টি ৩১ মার্চের পর্ষদ সভায় আলোচনা হলেও সুরাহা হয়নি বলে জানা গেছে। তবে ব্যাংক থেকে তাকে অপসারণও করা হয়নি। এর মধ্যেই মো. হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার খবর এলো।
ওকালতি পড়ে কৃষি উদ্যোক্তা : মাসুদের ‘হালাল আয়’ কোটি টাকারও বেশি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।