মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি : আজকাল বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যেসব বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য ও ঝগড়া-বিবাদ হয়ে থাকে তার মধ্যে অন্যতম একটি ব্যাপার হলো, স্ত্রীর নিজ পিত্রালয় বা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া।
স্ত্রী মাঝেমধ্যে পিতা-মাতা বা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যেতে চায়; কিন্তু অনেক সময় স্বামী তার অনুমতি দিতে চায় না। ফলে এনিয়ে তাদের মাঝে শুরু হয় ভীষণ দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। আর এ দ্বন্দ্ব কখনো বিবাহ বিচ্ছেদ পর্যন্তও গড়ায়।
এজন্য অনেকে জানতে চান যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে স্ত্রীর জন্য নিজ পিত্রালয় ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাবার অধিকার আছে কি না? থাকলে তা স্বামীর অনুমতি সাপেক্ষে নাকি অনুমতি ছাড়া? আর কতদিন পরপর বেড়াতে যাওয়ার অধিকার থাকবে? নিম্নে এ বিষয়ে শরীয়তের নির্দেশনা উল্লেখ করা হলো।
ইসলাম নারীদেরকে স্বামীর গৃহে অবস্থান করার জোরালো নির্দেশ দিয়েছে। আর বিশেষ কোনো প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে স্বামীর অনুমতি নেওয়াকে আবশ্যক করেছে।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা খাসআম গোত্রের এক নারী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে বললো, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাকে বলুন, স্ত্রীর ওপর স্বামীর কি কি হক রয়েছে?
নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আর স্ত্রী, স্বামীর অনুমতি ছাড়া নিজ ঘর থেকে বের হবে না। যদি সে এমনটি করে তবে আসমানের ফেরেশতা, রহমতের ফেরেশতা এবং আজাবের ফেরেশতাগণ তার ফিরে না আসা পর্যন্ত তার প্রতি অভিসম্পাত করতে থাকেন।’ (মুসনাদে বাযযার, মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদিস: ৭৬৩৮)
প্রসিদ্ধ ইফকের ঘটনায় উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, আমি আমার পিতা-মাতার কাছে গিয়ে এই জঘন্য অপবাদ সম্পর্কে সঠিক খবর জানতে চাচ্ছিলাম। তাই আমি রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বললাম- ‘(হে আল্লাহর রাসুল!) আপনি কি আমাকে আমার পিতা-মাতার কাছে যাওয়ার অনুমতি দিবেন?’ [সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩৮৩৫]
উল্লেখিত হাদিসের ব্যাখ্যায় আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী বলেন- ‘আয়েশা রদ্বিয়াল্লাহু আনহা-এর এ কথা থেকে বুঝা গেল যে, স্ত্রী স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার পিতামাতার বাড়িতে যাবে না।’ [উমদাতুল ক্বারী ১৩/২৩৫]
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) এক বিবাহিতা নারীর ব্যাপারে বলেন-যার মা অসুস্থ ছিল- ‘মাকে দেখতে যাওয়ার চেয়ে স্বামীর আনুগত্য করা তার জন্য অধিক জরুরি। তবে স্বামী তাকে অনুমতি দিলে ভিন্ন কথা।’ (শরহু মুনতাহাল ইরাদাত ৩/৪৭)
তবে একজন মানুষ স্বাভাবিকভাবে নিজের পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবন যাপন করতে পারে না। বিশেষত বিয়ের পর মেয়েরা স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার পর বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, পরিচিতজন এবং চেনা-জানা পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। এক অপরিচিত জায়গায় এবং অপরিচিত মানুষের সাথে তাদেরকে বসবাস করতে হয়।
এ পরিস্থিতিতে তাদের মনে মাঝেমধ্যে পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের সাক্ষাৎ লাভের আগ্রহ ও বাসনা সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এ অবস্থায় তাদের এ বাসনা পূরণ না করে তাদেরকে পিত্রালয়ে গমনে বাধা দেওয়া সুষ্ঠ দাম্পত্য জীবন যাপন ব্যাহত করার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এজন্য ফকীহরা স্ত্রীর পিত্রালয়ে গমনকে তার ন্যায্য হক বা অধিকার বলে সাব্যস্ত করেছেন। তারা বলেছেন, পিতা-মাতা কাছাকাছি অবস্থান করলে এবং তাদের নিকট যাওয়া-আসা সহজ ও ফেতনামুক্ত হলে সপ্তাহে একবার তার পিত্রালয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। আর পিত্রালয় দূরে হলে বা আসা-যাওয়ায় কোনোরূপ ফেতনার আশংকা হলে কিংবা ব্যক্তিগত অথবা পারিবারিক কোনো সমস্যা থাকলে সেক্ষেত্রে এলাকার প্রচলন অনুযায়ী যতদিন পর মেয়েদের পিত্রালয়ে যাওয়া ভালো মনে হয় ততদিন পর-পর পিত্রালয়ে যেতে পারবে।
আর পিত্রালয় সফরসম দূরত্বে (বর্তমান হিসেবে ৭৭ কি:মি: প্রায়) হলে যাতায়াতের সময় সঙ্গে স্বামী বা কোনো মাহরাম পুরুষ থাকতে হবে। আর অন্যান্য মাহরাম আত্মীয়ের বাড়িতে বছরে একবার দেখা-সাক্ষাতের জন্য যাওয়ার অনুমতি আছে।
অতএব স্বামীর উচিত সময়-সুযোগ ও প্রয়োজন বুঝে স্ত্রীকে মাঝে-মধ্যে তার পিতামাতা এবং অন্যান্য মাহরাম আত্মীয়ের সাথে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ করে দেওয়া। আর স্ত্রীর পিতা-মাতা অসুস্থ হলে এবং মেয়ের খেদমতের মুখাপেক্ষী হলে সেক্ষেত্রে স্ত্রীকে তার বাবা-মার দেখাশোনার জন্য যাওয়ার অনুমতি দেওয়া স্বামীর কর্তব্য।
তবে পিত্রালয় বা নিকটাত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে স্বামীর অনুমতি ছাড়া বেশি সময় অবস্থান করা যাবে না। অন্যথায় সে স্বামীর অবাধ্য হিসেবে গণ্য হবে এবং গুনাহগার হবে। আর যাতায়াতের সময় পরিপূর্ণ পর্দা রক্ষা করতে হবে এবং নিজেকে সবরকমের ফেতনা থেকে মুক্ত রাখতে হবে।
দাম্পত্য জীবন সুখময় এবং পারিবারিক শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থেই স্বামীর আনুগত্য করা স্ত্রীর জন্য জরুরি। আল্লাহ তাআলা পুরুষকে পরিবারের পরিচালক বানিয়েছেন এবং স্ত্রীর উপর কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা অর্পণ করেছেন। সুতরাং স্ত্রী যদি স্বামীর আনুগত্যকে উন্মুক্ত হৃদয়ে গ্রহণ না করে তাহলে পারিবারিক শৃঙ্খলা ভেঙ্গে যেতে বাধ্য। আল্লাহ তায়ালা হেফাযত করুন।
পরিশেষে বলবো, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে পারস্পরিক বিশ্বাস, ভালোবাসা ও সুসম্পর্ক বজায় রেখে যে কোনো সমস্যা সহজে সমাধান করা যায়। এগুলো দাম্পত্য জীবনের অপরিহার্য দাবি। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের চাহিদা ও হক আদায় করবে এবং অপরের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখবে। এতে নিজেদের মাঝে যে কোনো প্রকার মতবিরোধ ও মনোমালিন্য সৃষ্টি হওয়া থেকে বাঁচা যাবে।
এরপরও কোনো বিষয়ে মতবিরোধ হলে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও দাম্পত্য জীবনের বৃহত্তর স্বার্থে উভয়কে ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে এবং যথাসম্ভব দ্রুত সমাধান করতে হবে। তাহলে দুজনের দাম্পত্য জীবন অবারিত সুখ, শান্তি ও অনাবিল ভালোবাসায় ভরে থাকবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআ’লা প্রতিটি মুসলমানের জীবনকে সুখময় ও শান্তিময় করে দিন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।