জুমবাংলা ডেস্ক: স্বামীর অনুপস্থিতিতে অন্য সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন স্ত্রী। সে কথা জানতে পেরে স্ত্রীর প্রেমিকের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন স্বামী। স্ত্রী এবং তার সন্তানদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করায় স্ত্রীর সেই প্রেমিককে খুন করেছিলেন তিনি। এরপর থানায় আত্মসমর্পণ করেন।
সিনেমার চিত্রনাট্যের মতো নাটকীয় ঘাতপ্রতিঘাতে ভরপুর এ কাহিনী। তবে এর চরিত্রেরা কাল্পনিক নয়। ঘটনাও সত্য। পঞ্চাশের দশকে তৎকালীন বম্বেতে এই খুনের মামলা ঘিরে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল পুরো দেশে। প্রেম, দাম্পত্য, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, ঈর্ষা এবং খুনের মিশেলে মোড়া যে কাহিনী পরে ঠাঁই নিয়েছিল ওয়েব সিরিজ থেকে বলিউডি ছবির পর্দায়।
স্ত্রী সিলভিয়ার প্রেমিককে খুনের অভিযোগে কাঠগড়ায় উঠেছিলেন নৌসেনা কম্যান্ডার কাবস মানেকশ নানাবতী। তবে খুন করলেও তৎকালীন বম্বের জেলা ও দায়রা আদালতে জুরিদের বিচারে নির্দোষ সাব্যস্ত হন তিনি। নয় জন জুরির মধ্যে কেবলমাত্র এক জনই এ রায়ের বিপক্ষে ছিলেন।
অনেকের দাবি, ‘নানাবতী ভার্সাস স্টেট অফ মহারাষ্ট্র’ মামলায় পর থেকেই এ দেশে বিচারপ্রক্রিয়ায় জুরিপ্রথার চলন তুলে দেওয়া হয়েছিল। তবে তা ঠিক নয়। ষাটের দশকে বেশ কয়েকটি মামলায় বিচারে অংশ নিয়েছিলেন জুরিরা। যদিও সেই মামলাগুলো নানাবতী মামলার মতো চাঞ্চল্যকর ছিল না।
এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৫৯ সালের ২৭ এপ্রিল কাজ সেরে কাফ প্যারেড এলাকায় নিজের বাড়ি ফিরেছিলেন নৌসেনার তৎকালীন লেফটেন্যান্ট কম্যান্ডার নানাবতী। স্ত্রীকে আনমোনা বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করায় উত্তরে তার স্বীকারোক্তি মিলেছিল। জানিয়েছিলেন, স্বামীর অনুপস্থিতিতে অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ফেলেছেন। প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্ক হলেও তাকে বিয়ে করবেন কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন নানাবতীর স্ত্রী সিলভিয়া। সে কথাও স্বামীর কাছে স্বীকার করেছিলেন বলে সংবাদমাধ্যমের দাবি।
সিলভিয়ার থেকে তার প্রেমিক প্রেম ভগবানদাস আহুজার নাম জেনে নিয়েছিলেন নানাবতী। ঘটনাচক্রে, আহুজা ছিলেন নানাবতীর বন্ধু। মালাবার হিল এলাকায় নেপিয়ান সি রোডের ‘জীবনজ্যোত’ নামে একটি অভিজাত অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন আহুজা। আহুজার অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার আগে নৌসেনার ফাঁড়িতে গিয়েছিলেন নানাবতী। মিথ্যা কারণ দেখিয়ে সেখান থেকে নিজের পিস্তল এবং ছয়টি কার্তুজ নিয়ে নেন। এরপর সোজা আহুজার অফিসে পৌঁছন।
আহুজার অফিসে গেলেও সেখানে তার দেখা পাননি নানাবতী। এর পর সেখান থেকে আহুজার অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে ওঠেন তিনি। সঙ্গে ছিল গুলিভরা পিস্তলটি। অবশেষে স্ত্রীর প্রেমিকের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে তার মুখোমুখি হন নানাবতী। সটান জিজ্ঞাসা করেন, নানাবতীর স্ত্রীকে তিনি বিয়ে করবেন কি না? তার তিন সন্তানের দায়িত্ব নিতে পারবেন কিনা? কোনো প্রশ্নের জবাবেই ‘হ্যাঁ’ বলেননি আহুজা। আহুজার জবাবের প্রত্যুত্তরে তাকে তিনটি বুলেট ‘উপহার’ দিয়েছিলেন নানাবতী। ঐ অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আহুজার নিথর দেহ মিলেছিল। খুনের আগে দুইজনের মধ্যে হাতাহাতিতে নানাবতীর পিস্তল থেকে আরো দুইটি বুলেট বেরিয়েছিল বলে দাবি। যদিও সেগুলি লক্ষ্যভেদ করেনি।
স্ত্রীর প্রেমিককে খুনের পর থানায় পৌঁছন নানাবতী। মুম্বই ফেবলস বইয়ে সে কাহিনির বর্ণনা দিয়েছেন লেখক জ্ঞান প্রকাশ। খুনের দিনই শহরের তৎকালীন ডেপুটি পুলিশ কমিশনার জন লোবোর অফিসে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন নানাবতী। মুম্বই ফেবলস অনুযায়ী, সুঠাম গড়নের এক সুপুরুষ পার্সি ওই পুলিশকর্তার অফিসে ঢুকে বলেন, ‘এক জনকে গুলি করেছি।’ উত্তরে নির্লিপ্ত গলায় লোবো বলেন, ‘তিনি মৃত। গামদেবী থানা থেকে এখনই জানতে পেরেছি।’ শুনে নানাবতীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। এ ভাবেই নানাবতীর আত্মসমর্পণের দৃশ্য বর্ণনা করেছেন জ্ঞান প্রকাশ। যদিও বাস্তবে ঠিক এমনটাই ঘটেছিল কিনা, তা জানা যায়নি।
‘খুনির স্বীকারোক্তির’ আগেই ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিল গামদেবী থানার পুলিশ। তদন্তকারীরা জানিয়েছিলেন, আহুজার অ্যাপার্টমেন্টের বাথরুমে ভাঙা কাচ ছড়িয়েছিল। দেওয়ালে এবং দরজার হাতলে মিলেছিল রক্তের দাগ। মেঝেয় পড়েছিল একটি বাদামি রঙের ফাঁকা খাম। তার উপরে লেখা- লেফ্টেন্যান্ট কম্যান্ডার কেএম নানাবতী। আহুজাকে খুনের মামলা গোড়ায় উঠেছিল জেলা ও দায়রা আদালতে। খুনের মামলা হলেও থ্রিলারের যাবতীয় রসদ মজুত ছিল এ মামলায়। সুন্দরী বিদেশিনি স্ত্রী। ইংরেজ স্ত্রীর প্রেমে বুঁদ এক পার্সি নৌসেনা আধিকারিক। এবং অবশ্যই স্ত্রীর ধনী, অবিবাহিত সিন্ধ্রি প্রেমিক। খুনের মামলার এ হেন পাত্র-পাত্রীর আবেদন আমজনতা থেকে তথাকথিত শহুরে বিদ্বজ্জনের অন্দরমহলে গিয়ে পৌঁছেছিল। সংবাদপত্রের পাতায় মামলার খুঁটিনাটি ছাপামাত্রই গ্রোগাসে গিলতে শুরু করেছিলেন পাঠকেরা।
১৯৫৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মামলার শুনানি শুরু হয়েছিল। আদালতে নিজের জবানবন্দিতে নানাবতীর দাবি ছিল, ঘটনার দিন বাড়ি ফিরে সিলভিয়াকে কাছে টেনে নিলেও সাড়া পাননি। সিলভিয়া তাকে ভালোবাসেন কিনা জানতে চাইলে নিরুত্তর ছিলেন স্ত্রী। তবে কি অন্য কারও প্রেমে মগ্ন সিলভিয়া? সিলভিয়া কি তার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন? এবার স্ত্রীর উত্তর ছিল-‘না’। সিলভিয়ার প্রেমিকের থেকেও ‘আশানুরূপ’ উত্তর পাননি নানাবতী। সংবাদমাধ্যমের দাবি, সিলভিয়াকে প্রেমিকা নয়, শয্যাসঙ্গিনী হিসাবেই দেখতেন আহুজা। ফলে তার বা নানাবতীর সন্তানদের দায়িত্ব নিতে চাননি। মাসখানেক শুনানির পর জুরিদের রায়ে নির্দোষ সাব্যস্ত হন নানাবতী। সেই রায় শুনে হাততালি দিয়ে ওঠেন আদালতকক্ষে উপস্থিত লোকজন। যদিও ঐ রায় খারিজ করে বম্বে হাই কোর্টে মামলা পাঠিয়ে দেন জেলা ও দায়রা আদালতের বিচারক। এবার মামলা পৌঁছয় হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে।
১৯৬০ সালের ১১ মার্চ আহুজাকে খুনে দোষী সাব্যস্ত হন নানাবতী। তাকে যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা দেয় বম্বে হাই কোর্ট। যদিও সে সাজা মাফ করে দেন মহারাষ্ট্রের তৎকালীন রাজ্যপাল। কয়েক মাস পরে রাজ্যপালের নির্দেশকে খারিজ করে সুপ্রিম কোর্ট। এরপর নানাবতীকে জেলে পাঠানো হয়। ১৯৬৩ সালে স্বাস্থ্যজনিত কারণে নানাবতীর প্যারোলের আবেদন মঞ্জুর করে হাই কোর্ট। সব মিলিয়ে বছর তিনেক জেলে ছিলেন নানাবতী। প্যারোলের বছরখানেক পর তার সাজা মাফ করে দেন মহারাষ্ট্রের তৎকালীন রাজ্যপাল তথা জওহরলাল নেহরুর বোন বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত। সাজা থেকে অব্যাহতির পর ১৯৬৮ সালে সিলভিয়া এবং সন্তানদের নিয়ে কানাডা চলে যান নানাবতী। ২০০৩ সালের ২৪ জুলাই মৃত্যু হয় তার।
এই মামলা নিয়ে শহরের সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড থেকে শুরু করে দেশের বহু সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে নানাবতীকে নায়কের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। খলনায়কের ভূমিকায় দাঁড় করানো হয়েছিল আহুজাকে। মামলা চলাকালীন জনসমর্থনও ছিল নানাবতীর পক্ষে। পার্সি সম্প্রদায়ের একাংশ তার সমর্থনে মিছিলও বার করেছিলেন। এই চর্চিত মামলার জেরে শিরোনামে উঠে এসেছিলেন এর আইনজীবীরাও। আইনজীবীদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য রাম জেঠমলানিকে নিয়োগ করেছিলেন আহুজার বোন। আদালতে গিয়ে সওয়াল না করলেও দেশভাগের পর করাচি থেকে আসা এই তরুণ আইনজীবীর পেশাগত জীবনে সদর্থক ছাপ ফেলেছিল এই মামলা।
অন্য দিকে, নানাবতীর হয়ে আদালতে দাঁড়িয়েছিলেন পার্সি শিল্পকলার বিশেষজ্ঞ, বায়ুসেনা আধিকারিক তথা আইনজ্ঞ কার্ল জামশেদ খণ্ডালাওয়ালা। পরে যাকে পদ্মশ্রী দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল। নানাবতী মামলার উপর ভিত্তি করে বলিউডে দুইটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। প্রথম বার ১৯৭৩ সালে গুলজারের পরিচালনায় ‘অচানক’। যাতে নানাবতীর ভূমিকায় ছিলেন বিনোদ খন্না। সিনেমার দর্শকদের জন্য যার গল্প লিখেছিলেন আর এক পরিচালক খোয়াজ়া আহমেদ আব্বাস। এর বহু বছর পর ২০১৬ সালে এসেছিল ‘রুস্তম’। তুমুল জনপ্রিয় হয় অক্ষয় কুমারের সে ছবি। অন্য দিকে, ২০১৯ সালে ওটিটি-র পর্দায় আসে একতা কপূরের ‘দ্য ভার্ডিক্ট’। ঐ ওয়েব সিরিজ নিয়েও কম হইচই হয়নি।
সূত্র: আনন্দবাজার
চোখের ধাঁধা: ছবির পাতাগুলির মধ্যে লুকিয়ে আছে একটি ব্যাঙ, পারলে খুঁজে বের করুন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।