মো. শাহ আলম টুকু, বাসস : পদ্মা সেতু বাগেরহাটসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি বেকারত্ব দূর হবে এবং দারিদ্রতা হ্রাস পাবে।বাগেরহাট জেলায় অবস্থিত মোংলা বন্দর জাতীয় অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখার পাশাপাশি অর্থনীতির ধারাকে আরো শানিত করবে।পদ্মা সেতু চালু হলে মোংলা বন্দরের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আরও নতুন দিগন্ত উন্মোচন হবে। খান জাহান আলী বিমান বন্দর ও খুলনা-মংলা রেললাইনের কাজ শেষ হলে বিনিয়োগকারীরা বিমান যোগে অথবা সড়ক পথে স্বল্প সময়ে মোংলা বন্দরে আসতে পারবেন। একই সাথে সড়ক , বিমান ও রেল যোগাযোগের মাধ্যমে এ বন্দরের সাথে সারা দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। মোংলা বন্দরের সাথে যোগাযোগ দ্রুত এবং সহজ হওয়ায় শিল্প ও বাণিজ্যের অভূতপূর্ব আগ্রগতির পাশাপাশি যোগাযোগ অবকাঠামো শক্তিশালী হবে। পদ্মা সেতু ঘিরে এ অঞ্চলে গার্মেন্টস-সহ নানা ধরনের ইন্ডাস্ট্র্রি করতে উদ্যোক্তারা আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে।পাশ্ববর্তী দেশ গুলো মংলা বন্দর ব্যাবহারে উদ্যোগি হবে।ফলে বন্দরটি অধিক মুনাফা অর্জনের মধ্যদিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখাতে সক্ষম হবে। এতে বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এতে একদিকে যেমন বেকারত্ব দূর হবে তেমনি এ অঞ্চলের দারিদ্রতা হ্রাস পাবে।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, গত এক দশকে বন্দরের গতিশীলতা অনেক বেড়েছে। পদ্মা সেতু চালু হলে বাড়তি চাপ সামাল দিতে এরই মধ্যে পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। এতে গোটা বাগেরহাট জেলায় অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য তৈরি হবে।এ বন্দরটিতে ছয়টি জেটি, তিনটি মুরিং বয়া, ২২টি অ্যাংকোরেজ এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন ১১টি প্রতিষ্ঠানের জেটির মাধ্যমে মোট ৪২টি জাহাজ একসঙ্গে হ্যান্ডলিং করা সম্ভব।এছাড়া চারটি ট্রানজিট শেড, দুটি ওয়্যার হাউস, চারটি কনটেইনার ইয়ার্ড, দুটি কার ইয়ার্ডের মাধ্যমে বার্ষিক এক কোটি মেট্রিক টন কার্গো এবং এক লাখ টিইউজ কনটেইনার এবং ২০ হাজারটি গাড়ি হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা রয়েছে বন্দরের।বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আরও আটটি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। এসব কাজ শেষ হলে বন্দরের সক্ষমতা অনেক গুন বাড়বে।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ মুসা বলেন, পদ্মা সেতু হয়ে গেলে ঢাকা থেকে সবচেয়ে কাছের সমুদ্র বন্দর হবে মোংলা। যেমন- চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকার দুরত্ব ২৬০ কিলোমিটার আর মোংলার দুরত্ব হবে ১৭০ কিলোমিটার। প্রায় ১০০ কিলোমিটার কম হবে। এ সুবিধাটা মোংলা বন্দর পাবে। আশা করা যায়, বন্দর ব্যবহারকারীদের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পাবে। এরই মধ্যে অনেক আমদানি-রপ্তানিকারক বন্দর ব্যবহারে তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, ‘পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে এ বন্দরে অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আরেকটা বড় প্রকল্প-মহাসড়কে ছয় লেনে উন্নীত করার কাজ বাস্তবায়ন চলছে। বন্দরের আউটার বার ড্রেজিং সম্পন্ন হয়েছে। ইনারবার ড্রেজিংয়ের (জেটি থেকে পশুর নদী) কাজও শুরু হয়েছে। বন্দরে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এর সুফল পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কোনও প্রকল্পই পিছিয়ে নেই।
পদ্মা সেতু বন্দরের জন্য আশীর্বাদ হবে উল্লেখ করে চেয়ারম্যান আরও বলেন, এ বন্দর দিয়ে কার্গো, কনটেইনার এবং গাড়ি আমদানি বেশি হবে। চলতি বছরে গাড়ি ও কার্গো আমদানিতে যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তার থেকে বেশি আমদানি হয়েছে। ‘চলতি অর্থবছরে মে মাস পর্যন্ত বন্দরে জাহাজ এসেছে ৮২৮টি ও গেছে ৮৩০টি। এতে বন্দরের মোট আয় হয়েছে ৮ হাজার ৩০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। পদ্মা সেতু চালু হলে আগামী অর্থবছরে আমরা রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব আয় করতে পারব বলে আশাবাদী।’ বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আরো জানান, বিজিএমইএ নেতারা তার সঙ্গে এরই মধ্যে বৈঠক করেছেন। কয়েকটি বড় পোশাক কোম্পানিও পদ্মা সেতু চালুর সঙ্গে পণ্য রপ্তানিতে এ বন্দর ব্যবহারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
মোংলা বন্দরে এলপিজি ফ্যাক্টরি , সিমেন্ট ফ্যাক্টরিসহ ছোট-বড় মিলে ৩৮৬টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া বন্দরের মধ্যে ইপিজেডে ৫০টির অধিক শিল্প-কলকারখানা আছে। এর সংখ্যা ৮০ থেকে ৯০-এ উন্নীত হবে বলে আশা করছে ইপিজেড কর্তৃপক্ষ। বন্দরেরমালামাল ও এসব ফ্যাক্টরির মালামাল পরিবহনে ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল খুলনা-মোংলা মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীত করা। বাগেরহাট সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘১৯৮৪ সালে সড়কটি নির্মাণ হওয়ার পর থেকে প্রশস্ত করা হয়নি। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এ সড়কে যানবাহনের চাপ আরও বাড়বে। সে কারণে সড়কটির বাগেরহাট অংশের সাড়ে ৩০ কিলোমিটার রাস্তা ছয় লেনে উন্নীতকরণ এখন সময়ের দাবি।‘ইতোমধ্যেই প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্পটি ডোনারের মাধ্যমে করা যায় কি না সে ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ চিন্তাভাবনা করছে। কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের বৈঠকও হয়েছে বিষয়টি নিয়ে।’
বাগেরহাট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি শেখ লিয়াকত হোসেন লিটন বলেন, মোংলা বন্দর দিয়ে ’২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোংলা বন্দর দিয়ে গাড়ি আমদানি শুরু হয়। ওই বছর গাড়ি এসেছিল ২৫৫টি। প্রতি মাসে তিন থেকে চার হাজার রিকন্ডিশন গাড়ি আমদানি হচ্ছে। এ বন্দর দিয়ে গাড়ি আমদানিতে খরচ অনেক কম। পদ্মা সেতু চালু হলে গাড়ি আমদানি আরও বাড়বে। ‘বর্তমানে আমদানি করা গাড়ি ঢাকায় নিতে আরিচা ফেরিঘাট ব্যবহার করা হয়। যার কারণে মোংলা থেকে একটি গাড়ি ঢাকায় নিতে কমপক্ষে ৭ ঘণ্টা সময় লাগে। পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেলে ৩ ঘণ্টা সময় লাগবে। ফলে সময় অর্থ দুটোই সাশ্রয় হবে।সেতুটি চালু হলে ব্যবসায়ীরা যেদিন গাড়ির অর্ডার পাবে, সেদিনই ক্রেতার হাতে তা তুলে দিতে পারবে। কম সময়ে গাড়ি খালাস ও রাখার পর্যাপ্ত জায়গা থাকায় ব্যবসায়ীরা এ বন্দর দিয়ে আমদানি করতে বেশি পছন্দ করছেন। পদ্মা সেতু চালু হলে বন্দর দিয়ে আমদানিতে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ আরও বাড়বে। চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) মে মাস পর্যন্ত এ বন্দর দিয়ে আমদানি করা হয়েছে ২০ হাজার ৯টি।পদ্মা সেতু চালু হলে গাড়ি ব্যবসায় দের পাশাপাশি পোশাক কারখানার মালিকরাও এর সুবিধা পাবেন। তিনি বলেন, এখানে অনেকগুলো পর্যটন হোটেল-মোটেল স্থাপন হবে। সবকিছু মিলিয়ে লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
বাগেরহাট খানজাহান আলী কলেজের অধ্যক্ষ ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির আজীবন সদস্য খোন্দকার আছিফ উদ্দিন রাখি বলেন, পদ্মা সেতু বাগেরহাটের তথা দক্ষিণাঞ্চলের বিনিয়োগ ব্যবস্থার দ্বার খুলে দিয়েছে। সৃষ্টি হচ্ছে কর্মসংস্থান। পদ্মা সেতুকে ঘিরে এ অঞ্চলের মৎস্য, কৃষি, পর্যটন, অকাঠামোসহ সব খাতের প্রসার ঘটবে। মোংলা বন্দরের আমদানি-রফতানির প্রভাব বাগেরহাটের মানুষের ওপর পড়বে। রামপাল তাপবিদ্যুৎ এ উন্নয়নকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নেবে। দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগের জন্য এরই মধ্যে উদ্যোক্তাদের মধ্যে নীরব প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। মোংলা বন্দরের দুপাশে বিনিয়োগের গোল্ডেন লাইন সৃষ্টি হচ্ছে। এরই মধ্যে অনেকে জমি কিনে শিল্প-কারখানা করার জন্য প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে। এরফলে এ অঞ্চলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে, এখানকার শ্রমিকেরা বাড়িতে থেকেই কাজ করতে পারবেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।