আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভিয়েতনামের সবথেকে বড় শহর ‘সাইগন’, যার বর্তমান নাম ‘হো চি মিন সিটি’। ১৯৪৪ সালের ৬ এপ্রিল এই শহরে জন্মগ্রহণ করেছিল জন্মসূত্রে ভারতীয় বাবা এবং ভিয়েতনামি মায়ের গর্ভে এক শিশুসন্তান। বিবাহসূত্রে আবদ্ধ না হওয়ার কারণে শিশুসন্তানটিকে কখনওই পিতৃপরিচয় দিতে রাজি হননি তাঁর বাবা। হয়তো এই কারণেই পরবর্তী জীবনে তিলে তিলে শিশুটিকে অপরাধ জগতের দিকে ঠেলে দিয়েছিল তাঁর মানসিক যন্ত্রণা। মাত্র ১৯ বছর বয়সে কারাগারের মুখ দেখেছিলেন তিনি। তাঁর ঝকঝকে স্মার্ট চেহারা, সুন্দর বিনয়ী স্বভাব সকলকে মুগ্ধ করত। এটিই ছিল তাঁর প্রথম এবং প্রধান হাতিয়ার। আসলে বহু অপরাধীর মতোই, মনের ভেতর একরাশ অন্ধকার ছড়িয়ে দিয়েছিল তাঁর বিপন্ন শৈশব। ইনি হলেন কুখ্যাত অপরাধী চার্লস শোভরাজ। জন্মদাতা পিতা হলেন শোভরাজ হারচার্ড ভাবানি ও জন্মদাত্রী মা হলেন ত্রান লোয়াং ফুন।
শোভরাজের জন্মদাতা তাঁর জন্মকে স্বীকৃতি না দেওয়ার ফলে, তাঁর মা ফ্রান্সের এক সেনানায়ককে বিবাহ করেন। তিনি শোভরাজকে দত্তক নিতে রাজি হয়েছিলেন, কিন্তু ততদিনে শোভরাজ অন্ধকার জগতের দিকে পা বাড়িয়ে দিয়েছেন। ধীরে ধীরে নিজের পরিবার থেকে তিনি আলাদা হয়ে যান। স্কুলের বোর্ডিং থেকে দু’বার পালিয়েছিলেন তিনি। ফ্রান্স থেকে সাইগন ফিরে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। যদিও তা সম্ভব হয়নি। এরপর ধীরে ধীরে ডাকাতি, ড্রাগ এবং হিরের চোরাচালানের এক অন্ধকার জগতে তলিয়ে গিয়েছিলেন শোভরাজ।
মাত্র ১৯ বছর বয়সে প্রথম জেল খেটেছিলেন শোভরাজ। তাঁর অসম্ভব সুন্দর ব্যবহার এবং ঝকঝকে চেহারা মুগ্ধ করেছিল জেলকর্তাদের। এটাই ছিল চার্লসের হাতিয়ার এবং কৌশল। তাঁর নম্র ব্যবহার উল্টোদিকের লোকটিকে সহজেই তাঁর প্রতি বিশ্বাসভাজন করে তুলত। অসংখ্যবার ধরা পড়েও জেল থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছেন শোভরাজ। ১২ থেকে ৩০টি খুনের অপরাধী তিনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, তাঁর শিকার ছিল হিপি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক তরুণ প্রজন্ম। গোয়েন্দা দফতরের বক্তব্য অনুযায়ী, সিয়াটেলের এক তরুণীই ছিল তাঁর প্রথম শিকার। খুন করে যাঁকে থাইল্যান্ডের এক সমুদ্র-খাঁড়িতে ভাসিয়ে দিয়েছিল চার্লস। শোভরাজের আরও একটি ব্যক্তিত্ব ছিল, তা হলো, তিনি কথা বলতে পারতেন নানা ভাষায়। তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিল তীব্র আকর্ষণী ক্ষমতা, যা মেয়েদের সহজে আকৃষ্ট করত। ওষুধ দিয়ে বেহুঁশ করার পর সর্বস্ব লুঠ করে, বহু ক্ষেত্রে খুন করে মসৃণভাবে সেখান থেকে চলে যেতে সক্ষম হতেন চার্লস। এই আশ্চর্য ক্ষমতার জন্য তাঁর আরেক নাম হয়েছিল, ‘দ্য সারপেন্ট’ অর্থাৎ ‘সাপ’। সাপের মতোই ধুর্ত এবং বিষময় ছিলেন তিনি। খুনের ধরন দেখে তাঁকে বলা হতো, ‘দ্য স্প্লিটিং কিলার’।
বিভিন্ন ভাষায় কথা বলার সুবাদে এবং এক ধনী স্বেচ্ছাসেবীর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ফলে ওপরমহলেও কিছু জানাশোনা হয়ে গিয়েছিল শোভরাজের। প্যারিসে থাকার সময় এক অভিজাত, রক্ষণশীল পরিবারের তরুণী শাঁতাল কোম্পাগ্যাননের প্রেমে পড়েন তিনি। জীবনে বোধহয় এই প্রথমবার এবং শেষবারের মতো শোভরাজ কাউকে ভালবেসেছিলেন। শোভরাজের অপরাধের ইতিহাস জানতেন সেই তরুণী, এবং দ্বিতীয়বার গাড়ি চুরির অপরাধে হাজতবাসের ঘটনাও তিনি জানতেন। কিন্তু তবু তাদের ভালবাসা অটুট ছিল।এরপর তাঁরা বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন এবং ১৯৭০ সালে তৃতীয়বার গ্রেফতারি এড়ানোর জন্য অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে ফ্রান্স ছেড়ে এশিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। নকল নথিপত্র নিয়েই পূর্ব ইউরোপ ঘুরে মুম্বই পৌঁছন তাঁরা। পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পর্যটকদের ওপর লুটপাট চালান তাঁরা। এরপর মুম্বইতে জন্ম হয় তাঁর কন্যা ‘ঊষা’-র। মুম্বই এসে শোভরাজ গাড়ি চুরির চক্র তৈরি করে ফেলেন। চোরাচালানের পাশাপাশি তাঁর নতুন নেশা হয়ে দাঁড়ায় জুয়া। ভারতে এসে আবার ডাকাতির ঘটনায় ধরা পড়েন তিনি এবং জামিনের টাকা জোগাড় করে কোনওরকমে আবারও মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে পালান ‘কাবুল’। পৃথিবীজুড়ে এইভাবে ডাকাতি, জুয়া, চোরাচালান, খুন এবং আরও বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ আজও পর্যন্ত কোনও অপরাধীকে করতে দেখা যায়নি। থাইল্যান্ড, নেপাল,ভারত, মালয়েশিয়া, ফ্রান্স, আফগানিস্তান, তুরস্ক, গ্রিস এই দেশগুলি ছিল তাঁর বিচরণক্ষেত্র।
কাবুলে শুরু হয় শোভরাজের অপরাধের আর এক নতুন ধারা। এবার তাঁর মূল নিশানা ছিল ‘হিপি সম্প্রদায়’। এখানে তিনি আবার ধরা পড়েন এবং অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা হওয়ায় অসুস্থতার ভান করে হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানেই রক্ষীদের মাদকাসক্ত করে পালিয়ে যান। এবার তাঁর গন্তব্য ছিল ইরান। সেখানে তিনি একাই যান এবং মেয়েকে নিয়ে স্ত্রী ছিলেন কাবুলে। স্বামীর অপরাধ আর মেনে নিতে পারছিলেন না স্ত্রী শাঁতাল। বহু চেষ্টা করেও তিনি চার্লসকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারলেন না। তিনি শিশুকন্যা ঊষাকে নিয়ে ফিরে এলেন প্যারিসে। তিনি শোভরাজকে ভালবাসতেন। তবু তিনি ঠিক করেছিলেন, সুপথে না ফিরলে তিনি স্বামীর মুখ দর্শন করবেন না।
এরপর দু’বছর শোভরাজের কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি। পর্যটকদের কাছ থেকে চুরি করা পাসপোর্টের সাহায্যে পূর্ব ইউরোপের নানা জায়গায় তিনি ঘুরে বেড়াতে লাগলেন এবং হিপিদের কাছে রত্ন-ব্যবসায়ী বলে নিজের পরিচয় দিলেন। ক্রমে ক্রমে বড় হতে লাগল তাঁর অপরাধচক্র। অজয় চৌধুরী নামে এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত তাঁর অপরাধের মূল সঙ্গী ছিল। এরপর ১৯৭৫ সালে তাঁর নামে খুনের অভিযোগ উঠে এল। মসৃণ ভাবে অপরাধ করা সত্ত্বেও সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো ছিল তাঁর একটা নেশা। ১৯৭৬ সালে দিল্লিতে একদল ফরাসি তরুণকে নিশানা করেন শোভরাজ। স্নাতকোত্তর স্তরের ওই ছাত্রদের গাইড হিসেবে পরিচয় দেয় চার্লস। বিশ্বাস অর্জনের পর তাঁদের হাতে তুলে দেন বিষ মেশানো ওষুধ। মুখে বলেন, সেগুলি আমাশয়ের ওষুধ। কিন্তু তিনজন ছাত্র তাঁর দুরভিসন্ধি ধরে ফেলে। আচ্ছন্ন অবস্থাতেও তাঁরা ধরাশায়ী করে ফেলেন চার্লসকে। ফাঁসির বদলে ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয় শোভরাজের। তিহার জেলে কিন্তু তিনি ছিলেন রাজার হালে। দেহের মধ্যে লুকিয়ে রাখা মূল্যবান রত্ন নিয়ে এসে ঢুকেছিলেন কারাগারে এবং কারাকর্মীদের ঘুষ দিয়ে বশ করতে বেগ পেতে হয়নি তাঁকে। ১৯৮৬ সালে কারাবাসের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কারাকর্মীদের জন্য পার্টি দেন তিনি। সেখানে সবাইকে ঘুমের ওষুধ মেশানো খাবার খাইয়ে পালিয়ে যান। আবার ধরা পড়েন গোয়ার এক রেস্তোরাঁ থেকে এবং আরও দশ বছর বেড়ে যায় কারাবাসের মেয়াদ। ১৯৯৭ সালে মুক্তি পান ৫২ বছর বয়সি শোভরাজ ।এরপর ভারত থেকে ফিরে যান ফ্রান্সে।
প্যারিসের শহরতলিতে বিলাসবহুল জীবন কাটান শোভরাজ। সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকারের জন্য এবং নিজের ছবি তোলানোর জন্য মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করতেন তিনি। এরপর একদিন, হঠাৎই ২০০৩ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে তাঁকে দেখতে পান একজন সাংবাদিক। সাংবাদিকের কাছে সংবাদ পেয়ে একটি হোটেলের ক্যাসিনো থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে কাঠমান্ডু পুলিশ। ১৯৭৫ সালে দুই বিদেশি নাগরিককে খুনের অপরাধে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত করা হয়।
জীবনের যে কোনও পর্বেই শোভরাজ ছিলেন নিজের মেজাজে। সারা জীবনে ৩৫ বার জেল খেটেছেন চার্লস শোভরাজ এবং নানা উপায় অবলম্বন করে বারংবার জেল থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর জীবন যে কোনও কাহিনীকেই হার মানায়। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৭-এর মধ্যে ১২ থেকে ২৪টি (মতান্তরে ৩০টি) খুন করেন তিনি। এর মধ্যে বেশিরভাগই নারী। বিকিনি পরা, স্নানরতা নারীরা ছিল তাঁর প্রধান শিকার। শোভরাজের চেহারার মধ্যে ছিল আশ্চর্য এক ব্যক্তিত্ব এবং তীব্র আকর্ষণ ক্ষমতা। তাঁর আশ্চর্য সুন্দর ব্যবহারে মেয়েরা সহজেই আকৃষ্ট হয়ে পড়তেন। প্রেমের অভিনয় করে এদের ওষুধ দিয়ে বেঁহুশ করে তারপর সব লুঠ করে নিয়ে সমুদ্রের ধারে বা সুইমিং পুলে নিয়ে গিয়ে ডুবিয়ে দিতেন শোভরাজ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতো, জলে ডুবে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। স্বল্প পোশাকর তরুণীদের হত্যা করার জন্য তাঁকে ‘বিকিনি কিলার’ আখ্যা দেওয়া হয়।
১৯৯৭ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে শোভরাজ ফ্রান্সে যান। ভালোই দিন কাটছিল, কিন্তু হঠাৎ নেপালে তিনি কেন আসেন কেউ জানে না। নেপাল সরকার তাঁকে গ্রেফতার করল ১৯৭৫ সালের একটি অপরাধের কারণে। এখানে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পান এবং আজও বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। এখন তাঁর বয়স আটাত্তর বছর। রঙিন এই অপরাধীজীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু সিনেমা-সিরিজ, যার মধ্যে সাম্প্রতিক নেটফ্লিক্সের ‘দ্য সার্পেন্ট’।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।