আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে বিশ্বের জ্বালানি বাজার। একদিকে বাড়ছে জ্বালানি তেল ও সোনার দাম, অন্যদিকে দরপতন ঘটছে শেয়ারবাজারে। তবে বিশ্বের চোখ এখন হরমুজ প্রণালিতে। যুদ্ধের তীব্রতা বাড়লে বিশ্বের জ্বালানি তেল সরবরাহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রণালি বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে। কালের কণ্ঠের প্রতিবেদন থেকে বিস্তারিত-
এর আগে এমন হুমকি দিয়েছে ইরান। এতে জ্বালানি তেলের দাম ১০০ ডলারে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিনিয়োগকারীরা।
গত শুক্রবার ইরানে ইসরায়েলের হামলার মধ্য দিয়ে যুদ্ধের সূচনা হওয়ার পরপরই জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে ৭ শতাংশের বেশি বেড়েছে। শনি ও রবিবার বাজার বন্ধ থাকায় নতুন পরিস্থিতি বোঝা যাবে আগামী কাল সোমবার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান-ইসরায়েলের এই যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অবকাঠামো আক্রান্ত হতে পারে। জ্বালানি তেল ও গ্যাস ক্ষেত্রও লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে স্পর্শকাতার পয়েন্ট হরমুজ প্রণালি।
হরমুজ প্রণালি ঝুঁকিতে : ইরান ও ওমানের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা সরু জলপথ হরমুজ প্রণালি পারস্য উপসাগরকে আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে।
৫৫ থেকে ৯৫ কিলোমিটার প্রশস্ত এই রুট দিয়ে প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি ব্যারেল তেল ও তেলজাত পণ্য পরিবহন করে বিশ্বের শিপিং সংস্থাগুলো, যা বিশ্বব্যাপী তেল সরবরাহের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। সংঘাতময় পরিস্থিতিতে হরমুজ প্রণালিতে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছে পণ্যবাহী জাহাজগুলো। এখন পর্যন্ত জাহাজ চলাচল অব্যাহত রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থাই ধীরে ধীরে এ অঞ্চলকে কার্যত অচল করে দিতে পারে।
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শিপিং সংস্থা বিমকোর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা ইয়াকব লারসেন জানান, হরমুজ প্রণালি ও লোহিত সাগর এড়িয়ে চলার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন অনেক জাহাজ মালিক।
তাঁর ভাষায়, পরিস্থিতি খুবই উত্তেজনাপূর্ণ। তিনি আরো বলেন, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও পারমাণবিক আলোচনায় ইরানের অনুপস্থিতি জাহাজচালকদের উদ্বেগ আরো বাড়িয়েছে।
এই বছরের শুরুর পর থেকে বৈশ্বিক সমুদ্রপথে বাণিজ্যকৃত জ্বালানির ৩৪ শতাংশ হরমুজ দিয়েই চলেছে, যা বন্ধ হলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকট দেখা দিতে পারে। এর প্রভাবে এরই মধ্যে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দামে বেড়েছে। ব্রিটিশ মেরিটাইম সিকিউরিটি কম্পানি অ্যামব্রে হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছে, সামরিক সংঘর্ষের আশঙ্কায় জাহাজগুলো যেন হরমুজ প্রণালি ও ইরানি জলসীমা এড়িয়ে চলে। তারা বিকল্প রুট বেছে নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছে। সেই সঙ্গে জাহাজ মালিকদের তাঁদের জাহাজের সঙ্গে কোনো ইসরায়েলি সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, তা যাচাই করার পর আরব সাগর, ওমান উপসাগর কিংবা পারস্য উপসাগরে প্রবেশের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ইরানের হাতে এর আগে গ্রিসের মালিকানাধীন ট্যাংকার জব্দ হওয়ায় এবার গ্রিস নিজ দেশের জাহাজ মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যে তারা যেন হরমুজ প্রণালি পারাপারের তথ্য সরকারের কাছে জমা দেন। ডেটা ও অ্যানালিটিকস প্রতিষ্ঠান কেপলার জানায়, এখনো বড় কোনো পরিবর্তন ধরা পড়েনি, তবে তারা নজর রাখছে।
এদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন করে আবারও হুথির হামলার আশঙ্কায় আগের মতো স্বাভাবিকভাবে জাহাজ চলাচলের সম্ভাবনা নেই। নৌ ও আকাশ পথে পণ্যবাহী পরিবহন চলাচলের হার বিশ্লেষণকারী প্ল্যাটফর্ম জেনেটার প্রধান বিশ্লেষক পিটার স্যান্ড জানিয়েছেন, এই পরিস্থিতি বন্দরজটে পরিণত হতে পারে, তেলের দাম বাড়তে পারে ও জাহাজ ভাড়াও বেড়ে যেতে পারে। পাশাপাশি শিপিং কম্পানিগুলো এখন ‘নিরাপত্তা সারচার্জ’ ধার্য করতে পারে।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন জয়েন্ট মেরিটাইম ইনফরমেশন সেন্টার (জেএমআইসি) জানিয়েছে, হরমুজ প্রণালি এখনো খোলা আছে ও বাণিজ্যিক চলাচল স্বাভাবিক। তবে তারা সব শিপিং কম্পানিকে নিরাপত্তা পরিকল্পনা, নাবিক কল্যাণ এবং জরুরি সাড়া দেওয়ার প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে বলেছে। সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও ইরাক তাদের বেশির ভাগ তেল ও গ্যাস রপ্তানি করে হরমুজ প্রণালি দিয়ে, বিশেষত এশিয়া অঞ্চলে।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে : বাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং ইকোনমিকস জানায়, ইরান-ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি হামলা শুরু হওয়ার পর গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের ডব্লিউটিআই অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ৭.২৬ শতাংশ বেড়ে প্রতি ব্যারেল হয় ৭২.৯৮ ডলার। এক সপ্তাহে এই তেলের দাম বেড়েছে ১৩.০১ শতাংশ। এর পাশাপাশি লল্ডনের অপরিশোধিত ব্রেন্ট জ্বালানি তেলের দাম ৭.০২ শতাংশ বেড়ে প্রতি ব্যারেল হয় ৭৪.২৩ ডলার। এক সপ্তাহে এই তেলের দাম বেড়েছে ১১.৬৭ শতাংশ।
সোনার দাম ঊর্ধ্বমুখী : ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে বাড়ছে সোনার দাম। অর্থনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কায় বিনিয়োগকারীরা সোনায় নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছেন। গত শুক্রবার বিশ্ববাজারে সোনার দাম ১.৩৬ শতাংশ বেড়ে প্রতি আউন্স হয় তিন হাজার ৪৩২ ডলার। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে সোনার দাম আউন্সপ্রতি তিন হাজার ৫০০ ডলারে উঠে নতুন রেকর্ড গড়েছিল; সোনার দাম এখন আবার তার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত সোনার চাহিদা বাড়বে আর এতে দাম আরো বাড়ার সম্ভাবনা আছে। বিষয়টি হলো সোনা থেকে সুদ পাওয়া যায় না ঠিক, সুদের হার কমার আশঙ্কা থাকলে এর আকর্ষণ বেড়ে যায়। মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের নীতিতে সম্ভাব্য পরিবর্তনের আভাসও সোনার দামে ঊর্ধ্বমুখী চাপ তৈরি করেছে। ফলে অনেকে এখনই বিনিয়োগ নিশ্চিত করে নিচ্ছেন; কারণ বাজার পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য আলোচনায় অনিশ্চয়তার কারণে গত সপ্তাহের শুরু থেকেই সোনার দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এই অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল। যদিও দুই দেশের আলোচনায় কিছু অগ্রগতির আভাস মিলেছে, বাণিজ্যচুক্তির সুস্পষ্ট শর্ত না থাকায় বাজারে আস্থার ঘাটতি রয়ে গেছে।
শেয়ারবাজারে বড় পতন : সংঘাতের জেরে গত শুক্রবার ওয়াল স্ট্রিটে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের পতন হয়েছে। সেখানে তেলের দাম বাড়লেও বেশির ভাগ খাতের শেয়ারই নিম্নমুখী ছিল। বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দাও জোন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজ ১.৮ শতাংশ কমে ৪২১৯৭.৭৯ পয়েন্টে বন্ধ হয়েছে। এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক ১.১ শতাংশ হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯৭৬.৯৭ পয়েন্টে এবং টেকনোলজিভিত্তিক নাসডাক কম্পোজিট ১.৩ শতাংশ পড়ে হয়েছে ১৯৪০৬.৮৩ পয়েন্ট। ফ্রাংকফুর্টের ডেক্স সূচক পড়েছে ১.৫ শতাংশ এবং টোকিওর নিক্কি সূচক পড়েছে ০.৯ শতাংশ। সূত্র : সিএনবিসি, এএফপি, রয়টার্স, ট্রেডিং ইকোনমিকস।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।