জুমবাংলা ডেস্ক : যশোরের চৌগাছা উপজেলার সিংহঝুলি ইউনিয়নের মশিউরনগর গ্রামের বিশাল খেতের মাঝ দিয়ে চলে গেছে মেঠোপথ। সেই পথে শয়ে শয়ে হাঁস হেলেদুলে যাচ্ছে। পেছনে লাঠি হাতে আছেন দুজন মানুষ। কিছুক্ষণ পরই হাঁসগুলো নেমে যায় খেতের পানিতে। শুরু করে খাবার আহরণ। এর একটু দূরেই বিল। সেখানেও মেলে শামুক, গুগলি আর পতঙ্গ। হাঁসগুলোর লক্ষ্য সেদিকে যাওয়ার। এই দৃশ্য মঙ্গলবার সকালের। যশোরের বিভিন্ন গ্রামের বিলে, জলাশয়ে হাঁস চরানোর দৃশ্য অভূতপূর্ব নয়। কিন্তু এভাবে সারিবদ্ধভাবে হাজারে হাজার হাঁসের উপস্থিতি একেবারেই নতুন। কিন্তু এই হাঁস এখানকার কারও নয়। এগুলো পরিযায়ী, প্রায় চারশ কিমি. দূর থেকে তাদের এখানে আনা হয়েছে।
দেশের জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা যুগান্তর-এ আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত সাংবাদিক তৌহিদ জামান-এর এক প্রতিবেদনে এমনি তথ্য উঠে এসেছে।
পরিযায়ী হাঁস : মশিউরনগরের মাঠে যে হাঁসগুলো চরে বেড়াচ্ছে, সেগুলো হচ্ছে খাকি ক্যাম্পবেল। এগুলোকে থাই ক্যাম্পবেলও বলা হয়ে থাকে। একটি জনপ্রিয় প্রজাতি, ডিম ও মাংসের জন্যে পরিচিত। পালনও সহজ। হাঁসের পেছনে পেছনে লাঠি হাতে আসা দুই যুবকের একজন হলেন মাহবুব আলম (২৭)। তিনি হাঁসের মালিক। সঙ্গে সহযোগী আতিকুর রহমান। তিনি তার বেতনভুক্ত কর্মী।
জুন মাসের প্রথমদিকে (ঈদের ৫ দিন আগে) মাহবুব আলম তার বড় ভাই বায়েজিদ এবং সহযোগী আতিকুর রহমান ২৩শ হাঁস নিয়ে যশোরের চৌগাছা উপজেলার সিংহঝুলি ইউনিয়নের মশিউরনগরে আসেন। এর আগে তিনি জানতে পারেন, এবার শিলাবৃষ্টিতে এই অঞ্চলের ধান মাঠেই নষ্ট হয়ে গেছে। হাঁসের খাবারের জন্যে উপযুক্ত জায়গা হিসাবে তিনি এই এলাকাকে বিবেচনা করেন। আর তাই হাঁস-মুরগি পরিবহণে দুটি পিকআপ; যার ভাড়া প্রায় ৪৫ হাজার টাকা খরচ করে কিশোরগঞ্জ জেলার ইতনা উপজেলার বুর্শিকুড়ুন গ্রাম থেকে রওয়ানা হন। প্রায় ৪শ কিমি. পাড়ি দিয়ে তিনি আস্তানা গাড়েন মশিউরনগর গ্রামের মুদি ব্যবসায়ী আবু তাহেরের পুকুর পাড়ে।
পুকুর ও পাড়সংলগ্ন স্থানে অবস্থান : মশিউরনগরে পিকআপ থামিয়ে মাহবুব আলম কথা বলেন জমির মালিক আবু তাহেরের সঙ্গে। তাহেরের মালিকানাধীন পুকুর ও পাড়সংলগ্ন উঁচু জায়গা মিলিয়ে প্রায় দশ বিঘা। মাসখানেকের জন্য দশ হাজার টাকায় তিনি ভাড়া দেন এই ভ্রাম্যমাণ হাঁস খামারি মাহবুবকে। সেখানে টিনের একটি চালা করে তার ভেতরে রান্না ও থাকার স্থান এবং পাশের বড় জায়গা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে হাঁসের অস্থায়ী খামার। এখানে মাহবুবরা মাসখানেক থাকবেন। এরপরের গন্তব্য নাটোরের তাড়াশ উপজেলায়।
হাঁসদের সারা দিন : সকাল ৮টার দিকে হাঁসগুলোকে বের করা হয় ঘের থেকে। এরপর প্রথমে পাশের পুকুরে কিছু সময় চরে বেড়ায়। পুকুরে আছে শামুক ও গুগলি। এরপর তারা বেরিয়ে পড়ে বিলের দিকে; যেখানে ফসলি জমি ডুবে আছে পানিতে। সেখানে থাকা কচি ঘাস, নতুন করে গজানো ধানের চারা কিংবা কীটপতঙ্গ-সেগুলো খুঁটে খুঁটে খাওয়াই লক্ষ্য। সারা দিন চরানোর পর বিকাল ৫টার দিকে হাঁসগুলো নিয়ে আসা হয় থাকার জায়গায়।
কে এই মাহবুব আলম : কিশোরগঞ্জের ইতনা উপজেলার বুর্শিকুড়ুন গ্রামের আব্দুর রশিদের ৫ ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে চতুর্থ মাহবুব আলম। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স সম্পন্ন করেছেন। চলতি বছর ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজে মাস্টার্সে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। বড় ভাই বায়েজিদ আগে থেকেই হাঁসের খামার করতেন। মাহবুব আলমের স্বপ্ন, লেখাপড়া শেষ করে চাকরির পেছনে ছোটা নয়। একজন সফল খামারি হওয়া।
তিনি বলেন, খুব ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি অল্প অল্প হাঁস পুষেছি। কিন্তু বড় আকারের এই ভ্রাম্যমাণ হাঁসের খামার গত দুই বছর ধরে চলছে। আমি চাই, এই হাঁস পালনের মাধ্যমে বিপ্লব ঘটাতে। সরকারি চাকরির পেছনে না ঘুরে এই হাঁস চাষের মাধ্যমে প্রতি মাসে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা উপার্জন সম্ভব বলে তিনি জানান।
হাঁসের ভ্রাম্যমাণ খামার : যশোরে আসার আগে, গত বছর মাহবুব কুমিল্লায় হাঁসের বহর নিয়ে গিয়েছিলেন। কারণ-হাঁসের খাবারের খরচ কমানো। বাড়িতে থাকলে প্রতিদিন দুই হাজার হাঁসের জন্য ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকার মতো লাগে। কিন্তু মাঠে চরানো হলে সেখানে খাবারের কোনো খরচ লাগে না।
তিনি বলেন, চৈত্র মাসে হাঁসের বাচ্চা সংগ্রহ করি প্রতিটি ৩৫ টাকা দরে। এখন প্রতিটি হাঁসের বয়স সাড়ে ৩ মাস। খরচ প্রতি হাঁসে প্রায় দুইশ টাকা। আজ (২৪ জুন মঙ্গলবার) ১০টি ডিম পেয়েছি। আশা করছি, দিন পনেরোর মধ্যে ৬০-৭০ শতাংশ হাঁস থেকে ডিম পাওয়া যাবে। এভাবে ৮ মাসে প্রতিটি হাঁস ২১০ থেকে ২৫০টি ডিম দেবে। এক বছর পর হাঁসগুলো মাংসের জন্য বিক্রি করে দেব। সেখানে প্রতিটি ৪শ থেকে ৫শ টাকা দাম পাওয়া যাবে।
এক বছরের মধ্যে ৪ মাস তারা হাঁস নিয়ে ঘুরে বেড়ান। বাকি সময় বাড়িতে থাকেন। এক বছরে সবমিলিয়ে প্রতিটি হাঁসের পেছনে খরচ গড়ে ২৬০০-২৭০০ টাকার মতো। ডিম এবং মাংসের জন্যে হাঁস বিক্রি থেকে পাওয়া যাবে ৩৬০০-৩৭০০ টাকার মতো। অর্থাৎ প্রতি হাঁসে লাভ ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা। সেই হিসাবে ২ হাজার হাঁসে লাভ হবে ১৮ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকার মতো।
হাঁসের খাবার খরচের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যখন ডিম দেওয়া শুরু করে তখন তাদের ধান, গম ও ফিড খাওয়াতে হয়। সেক্ষেত্রে প্রতিটি হাঁসের পেছনে দশ টাকার মতো খরচ। ডিম থেকে মিলবে ১৫ থেকে ১৬ টাকা। আর ভ্যাকসিন দিতে হয় ৩ মাসে একবার, কলেরা ও প্লেগের জন্যে। তাতে অবশ্য খরচ খুব একটা বেশি নয়।’
জমির মালিক আবু তাহেরের বক্তব্য : আবু তাহের বলেন, এবার শিলাবৃষ্টিতে আমাদের এলাকার ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কিশোরগঞ্জ থেকে মাহবুব তার হাঁস নিয়ে আমার এখানে আসেন। এই অঞ্চলের মানুষ মধুচাষিদের দেখেছেন মৌমাছির বাক্স নিয়ে সরিষা খেতে কিংবা লিচুর বাগানে যেতে। কিন্তু একপাল হাঁস নিয়ে তিন-চারশ কিমি. পাড়ি দিয়ে সেগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে লালন-পালন কখনোই দেখেননি। ভাবলাম জায়গা ভাড়া দিলে আমারও লাভ, ছেলেটিরও লাভ। সে কারণে মাসখানেকের জন্য দশ হাজার টাকায় তাকে জায়গাটি ভাড়া দিয়েছি।
স্থানীয়দের বক্তব্য : মশিউরনগর গ্রামের বাসিন্দা তাইজুল ইসলাম ও শের আলী বলেন, আমরা আগে কখনোই দেখিনি হাঁসের পাল নিয়ে কেউ দেশান্তরী হয়েছেন। দেখিনি বা শুনিনিও। এই ছেলেটাকে দেখে ভালো লাগছে। প্রথম যেদিন সে এখানে আসে, সেদিন বেশ কয়েকটা হাঁস গরমে মারা যায়। এখন তারা এলাকার পতিত মাঠে হাঁস চরাচ্ছে, বিষয়টি বেশ নতুন।
চিকিৎসক যা বললেন : এই গ্রামের বাসিন্দা এবং পশু-পাখির প্রাথমিক চিকিৎসক আজিজুর রহমান বলেন, খাকি ক্যাম্পবেলের সাধারণত রানীক্ষেত, প্লেগ বা পা অবশ রোগ হয়। এগুলোর ভ্যাকসিন রয়েছে, ওষুধও সহজলভ্য। তিনি বলেন, এই হাঁস টানা ৬ মাস ডিম দেয়। এরপর কিছু সময় গ্যাপ দিয়ে আবারও ডিম পাড়ে। তখন অবশ্য ডিম দেওয়ার সংখ্যা কমতে থাকে। ডিম দেওয়া শেষ হলে হাঁসের ওজন কমতে থাকে। সে কারণে খামারিরা এক বছরের মধ্যে হাঁস মাংসের জন্য বিক্রি করে দেন। এরপর নতুন করে শুরু করেন।
সূত্র : যুগান্তর
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।