জুমবাংলা ডেস্ক: ‘প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, তারাও সম্পদ’-এর শতভাগ প্রমাণ দিয়েছেন পটুয়াখালীর ছেলে মো. বেল্লাল হোসেন আকন। জন্ম থেকে দুই হাত নেই তাতে কি হয়েছে, প্রবল ইচ্ছা শক্তি ও একাগ্রতা দিয়েই শারীরিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে নিয়েছেন এই অপ্রতিরোধ্য প্রতিবন্ধী বেল্লাল আকন।
সে লেখাপড়া থেকে শুরু করে সমবয়সীদের সঙ্গে সমান তালে চালাচ্ছেন মোবাইল ফোন, খেলছেন ফুটবল, বাইছেন নৌকা, করছেন পড়াশুনা এবং আদায় করছেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও। ছোটো হোক আর বড় হোক একটি সরকারি চাকরি করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছেন অধম্য বেল্লাল আকন। নিন্দনীয় সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তিত্ব এবং সমাজের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন অদম্য বেল্লাল আকন।
পটুয়াখালী জেলা সদর থেকে ৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণে কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের উমেদপুরে অজোপাড়া এলাকায় রয়েছে প্রতিবন্ধী বেল্লাল আকনের দাদার বাড়ি। বাবা মো. খলিল আকন ও মা মোসা. হোসনে আরা বেগমের দুই মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে মো. বেল্লাল আকন কনিষ্ঠ সন্তান।
বড় ছেলে নেছার উদ্দিন আকন বরিশাল বিএম কলেজে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী এবং দুই মেয়ে খাদিজা বেগম ও রাহিমা বেগমের বিয়ে হওয়ায় তারা এখন স্বামীর সংসার করছেন। ছোট ছেলে বেল্লাল আকন ২০০০ সালে দুই হাত ছাড়াই জন্ম গ্রহণ করেন।
পরবর্তীতে মায়ের আপ্রাণ চেষ্টায় বেল্লাল আকন পায়ের আঙ্গুলের সাহায্যে লেখাশেখে। ২০০৭ সালে বাড়ির নিকটে উমেদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ২০১৬ সালে উমেদপুর দাখিল মাদরাসা থেকে জেডিসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ অর্জন করে সে। ২০১৮ সালে ওই মাদরাসা থেকে দাখিল পাশ করে একই ইউনিয়নের নাওভাঙ্গা সালেহিয়া ফাজিল মাদরাসায় ভর্তি হয় এবং সেখান থেকে ২০২০ সালে আলিম পাশ করেন। বেল্লাল আকন এখন রাষ্টবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স পড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
কিন্তু করোনার কারণে ভর্তি কার্যক্রমে দেরি হওয়ায় বর্তমানে বাড়িতেই রয়েছে সে। আত্মবিশ্বাসী ও অদম্য বেল্লাল আকন সমাজকে দেখিয়ে দিয়েছে দু’টি হাত ছাড়াও কর্মের মধ্যে দিয়েও মানুষ বেঁচে থাকতে পারে।
শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মগ্রহণ করার কারণে যে শিশু সন্তানকে মেরে ফেলার জন্য বাবা-মাকে পরামর্শ দিয়েছিল প্রতিবেশিরা, সেই শিশুটি মায়ের মমত্ববোধের কারণেই পা দিয়ে লিখে আজ সুশিক্ষায় মেধা ও দক্ষতায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। নিন্দনীয় সামাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে প্রতিবন্ধকতায় জয় করে দেশ ও সমাজের জন্য অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব এবং এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন অপ্রতিরোধ্য প্রতিবন্ধী বেল্লাল আকন।
করোনা পরিস্থিতিতে ঘরে বসেই অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল সেট দিয়ে অনলাইনভিত্তিক মিডিয়ার মাধ্যমে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নানা বিষয়ের খোঁজখবর রাখছে অদ্যম বেল্লাল আকন। তার শৈশবের বিদ্যাপিঠ মাঠে প্রতিবেশি কিশোরদের সঙ্গে ফুটবল খেলছে অবিশ্বাস্যভাবে এবং নামাজের ঈমামতি করছেন। শুধু তা-ই নয়, বাড়ির নিকটস্থ সোনাতলা নদীতে নৌকা বাইতেও দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে বেল্লাল আকন।
এ ব্যাপারে মো. বেল্লাল হোসেন আকন বলেন, জন্ম থেকেই আমার দুই হাত নেই। যার কারণে সকলেই মনে করে আমি পরিবারের একটা বোঝা হয়ে জন্মগ্রহণ করেছি। আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না। তাই ছোট বেলা থেকেই মনস্থির করি আমি লেখাপড়া করবো এবং উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে আমার নিজেকেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আমি প্রমাণ করে দিতে চাই, ‘প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, তারাও সম্পদ’।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার নিজের জীবন নিজেকেই গড়তে হবে’-এই মনোবল নিয়ে আমি লেখাপড়া শুরু করি। লেখাপড়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান আমার মায়ের। ছোট বেলা থেকে আমার মা পায়ের আঙুলের মধ্যে চক চেপে ধরে লেখা শিখিয়েছেন। এছাড়া স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সকলে আমার সঙ্গে ভালো আচরণ ও সহযোগিতা করেছেন। আমি এখন অনার্সে ভর্তি হবো।
বেল্লাল আকনের বড় ভাই মো. নেছার উদ্দিন আকন বলেন, বেল্লালের জন্মের পর থেকে নানা মানুষ নানান ধরণের খারাপ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু আমরা পরিবারের লোকজন বেল্লালকে নিয়ে কখনও বিব্রতবোধ করিনি, বরং ওকে নিয়ে আমরা গর্বিত। তাই পরিবারের সকল সদস্যরা বেল্লালকে মানসিক সহায়তা করেছেন। বাবা-মা উভয়েই আমাদের চেয়ে বেল্লালকেই ভালোবাসতো ও প্রধান্য দিতো বেশি।
উমেদপুর দাখিল মাদরাসার সহকারী সুপার মাওলানা মো. নুরুজ্জামান বলেন, বেল্লাল আমার এ প্রতিষ্ঠানে ৬ষ্ঠ থেকে দাখিল শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে এবং সে প্রতিটি শ্রেণিতে ভালো ফলাফল করেছে। বেল্লালের দুই হাত ছিলো না এবং পা দিয়ে লিখতো সে। বেল্লালের ভিতর শিক্ষার একটা প্রতিভা রয়েছে এবং তার এ প্রতিভা সকলের জন্য অনুকরণীয়।
উমেদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শাহ সুজা বলেন, লেখাপড়ার প্রতি বেল্লালের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। তবে আমার ভয় ছিল বেল্লাল শিক্ষার শেষ স্তর পর্যন্ত যেতে পারবে কি না। কিন্তু এখন মনে হয় বেল্লাল তার মনের আশা পূরণ করতে পারবে। বেল্লাল সকলের সহযোগিতা পাচ্ছেন। আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য আমরা রাষ্ট্রের প্রতি, সরকারের প্রতি, সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমরা বুঝতে পেরেছি প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, তারাও সম্পদ’।
এ প্রসঙ্গে সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শিলা রানী দাস বলেন, বেল্লাল আকন প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন। এছাড়া প্রতিবন্ধী সহায়ক কোনো উপকরণ প্রয়োজন হলে সেটাও দেওয়া যাবে এবং তার বাবা যদি আর্থিক সচ্ছলতার জন্য ক্ষুদ্র ঋণ নিতে চায় তাও সংশ্লিষ্ট উপজেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরে গিয়ে আবেদন করে নিতে পারবেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।